পঞ্চায়েতের 'বিচার' নিয়ে তোলপাড়

গণধর্ষণের দায়ে অভিযুক্তদের আটক করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ ছবি: রয়টার্স
গণধর্ষণের দায়ে অভিযুক্তদের আটক করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ  ছবি: রয়টার্স

এই ভোটের বাজারে সবাই যখন দলের হয়ে প্রচারে ব্যস্ত, তখন পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীন জনজাতি সাঁওতাল সমাজের মধ্যে আলোড়ন চলছে অন্য একটি বিষয় নিয়ে। বীরভূমের সুভলপুরের একটি গ্রামে গত জানুয়ারি মাসের ২১ তারিখে এক সাঁওতাল মেয়েকে একটি মুসলমান ছেলের সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগে প্রথমে সাঁওতাল গ্রাম পঞ্চায়েতে বিচার হয় এবং পরে তাদের অনুমতি পেয়ে মেয়েটিকে গণধর্ষণ করে ‘শাস্তি’ দেয় বলে অভিযোগ।
এর পরেই সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে সেই খবর প্রকাশ পেলে সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হস্তক্ষেপ করেন এবং দ্রুত অপরাধীদের বিচার করতে বলেন। একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সরকার থেকে মেয়েটিকে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হয়। অন্যদিকে রাজ্য সরকারের প্রশাসন থেকে নির্দেশ পাঠিয়ে সাঁওতাল সমাজের গ্রাম পঞ্চায়েতে সালিসি সভা করার ব্যাপারে নিষেধ করা হয়। এ ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় সাঁওতাল সমাজে। তারা মনে করছে, সেদিনের সেই ঘটনা আদৌ সাঁওতালদের নিজস্ব সালিসি সভা থেকে শুরু হয়নি। কারণ, সালিসের উদ্যোগ নিয়েছিলেন শাসক দলের এক স্থানীয় নেতা। তিনি আবার স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতেরও সদস্য। এভাবে সাঁওতালদের মর্যাদা নষ্ট করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বহু শতাব্দীর প্রাচীন সামাজিক প্রথা (গ্রাম পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া) বন্ধ করে তাদের স্বাধিকার খর্ব করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে লাভপুর থানায় ভুক্তভোগী মেয়েটি অভিযোগ (এফআইআর) করেছে এবং অভিযুক্ত ১২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও আদালতে জমা দিয়েছে। মেয়েটির অভিযোগ ছিল, পাশের গ্রামের শেখ খালেকের সঙ্গে তার বিয়ের কথা ঠিক হয়। এ ব্যাপারেই সে গত ২০ জানুয়ারি তার বাড়িতে এসেছিল বিয়ে নিয়ে কথা বলতে। এমন সময় গ্রামের কিছু মানুষ সেখানে জড়ো হয়ে তাদের আটক করে এবং জোর করে বেঁধে রাখে। পরদিন সালিসি সভায় তাদের আর্থিক জরিমানা করা হয়। কিন্তু গরিব ওই মেয়েটি জরিমানার টাকা দিতে অক্ষম হওয়ায় তাকে অত্যাচারের শিকার হতে হয়।
সালিসি সভার যে লিখিত সিদ্ধান্ত রয়েছে, তাতে দুজনের সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু জরিমানার উল্লেখ নেই, শুধু এটাই বলা হয়েছে যে আদিবাসী সমাজের প্রথা অনুযায়ী সব ফয়সালা করা হয়েছে এবং তাদের দুজনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই সিদ্ধান্তে শেখ খালেকের সই থাকলেও মেয়েটির টিপসইও নেই। এ ছাড়া আরও যে দুজনের সই রয়েছে, তারা কেউই সাঁওতাল নয়। এটা দেখিয়েই লক্ষ্মণ সোরেন, বাসু সোরেন, শিবু সোরেন, হারাধন সোরেনেরা দাবি করছেন, সাঁওতালেরা নয়, গোটা কাণ্ডের পেছনে বর্ণ হিন্দুরাই ছিল। এমনকি পরে মেয়েটির হয়ে থানায় যে এফআইআর করা হয়, সেটিও অনির্বাণ মণ্ডল নামের একজনের লেখা।
সাঁওতাল সমাজের মধ্যে এই গণধর্ষণের নজিরবিহীন ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংবাদমাধ্যমে আদিবাসী সমাজের কুসংস্কার, অশিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে সমালোচনা শুরু হওয়ার প্রতিক্রিয়া এখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে গোটা রাজ্যের সাঁওতালদের মধ্যে। সাঁওতালদের মধ্যে যারা কিছুটা লেখাপড়া শিখেছে, তারা এখন এগিয়ে এসে সাঁওতালদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেছে।
৩ এপ্রিল কলকাতার বুকে প্রায় ২৫ হাজার সাঁওতাল এসে জমায়েত করে তাদের সমাজকে কালিমালিপ্ত করার প্রতিবাদ জানায়। লক্ষ্মণ সোরেনদের আফসোস, কলকাতার পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল এ ঘটনাকে কার্যত উপেক্ষা করল। লক্ষ্মণ নিজে এমএড করে এখন শিক্ষা বিষয়ে গবেষণা করছেন বিশ্বভারতীতে। হারাধন সোরেন বিশ্বভারতীর স্কুল পাঠভবনে বাংলার শিক্ষক। শিবু সোরেন দুবরাজপুরের স্কুলশিক্ষক। তাঁরা মনে করিয়ে দেন, হিন্দুদের মতো সাঁওতাল সমাজে কখনোই সতীদাহ ছিল না, বিধবাবিবাহ বরাবরই চালু ছিল, মেয়েদের স্বাধীনতাও বরাবরই ছিল। অথচ তাঁদেরই এখন

কুসংস্কারে মজে থাকার অপবাদ নিতে হচ্ছে। কয়েক বছর আগে চার্লস ডারউইনের (বিবর্তনবাদতত্ত্বের প্রবক্তা ও অষ্টাদশ শতাব্দীর চিন্তাবিদ) বংশধর ও নৃতত্ত্ববিদ ফেলিক্স প্যাডল কলকাতায় এসেছিলেন। পূর্ব ভারতের আদিবাসীদের নিয়ে তাঁর গবেষণার কাজ আগেই সাড়া ফেলেছে। তিনি জানান, সাঁওতাল সমাজে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার যে রীতি প্রচলিত, তা অনুকরণযোগ্য।
কিন্তু যে সাঁওতাল সমাজ বহু শতাব্দী ধরেই সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে অভ্যস্ত, এখন লাভপুরের ঘটনার পরে তাতেও বাধা আসছে। তবে তারা নিজেরা স্বীকার করে, ‘ডাইনি প্রথা’র মতো কুসংস্কারের ব্যাপার থেকে সাঁওতাল সমাজ এখনো মুক্ত হতে পারেনি। লাভপুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এবার সমাজকে ভেতর থেকে ধাক্কা দেওয়া শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে তারা এটাও জানায়, সাঁওতাল যুবতীর নিজের সমাজের বাইরে, বিশেষ করে মুসলমান যুবকের সঙ্গে বিয়ে নতুন ব্যাপার নয়। এ নিয়ে সমাজে আপত্তিও হয় না। সে জন্যই তাদের সন্দেহ, লাভপুরের ঘটনায় সাঁওতাল সমাজকে অপবাদ দিয়ে অন্যরা নিজেদের আড়াল করতে চাইছে।
সম্প্রতি বোলপুরের শ্রীনন্দা হাইস্কুলে ৪৫টি গ্রামের মোড়লদের নিয়ে এক সভার আয়োজন করেন এসব শিক্ষিত যুবক। শিবু সোরেন জানান, ওই সভায় ঠিক হয়েছে, সাঁওতাল সমাজের মধ্যে মদপান (প্রধানত হাঁড়িয়া খাওয়ার যে চল রয়েছে) বন্ধ করতে লোকজনকে সচেতন করতে হবে। সেই ডাইনি প্রথার মতো কুসংস্কার থেকেও সমাজকে মুক্ত করতে হবে। এসবের জন্য প্রথমে জোর দিতে হবে ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ওপর। বীরভূমের ঝাড়খন্ড সীমান্ত এলাকা রাজনগরে বহু গরিব আদিবাসীর বাস। সেখানকার স্কুলের প্রবীণ শিক্ষক তপন রায় জানান, এসব এলাকায়ও তিনি দেখেছেন, বেছে বেছে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীরা অবহেলার শিকার হয়। অমর্ত্য সেনের প্রতীচী ট্রাস্ট থেকে কয়েক বছর আগেই গ্রামবাংলার প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার ওপর সমীক্ষা করে বলা হয়েছিল, যেসব স্কুলে আদিবাসী ও সমাজের নীচুতলার ছাত্রদের সংখ্যা বেশি, সেখানে শিক্ষকেরা (প্রধানত উচ্চবর্ণের) বেশি করে অবহেলা করেন। শান্তিনিকেতনের গায়েই চারটি সাঁওতাল গ্রাম—বালিপাড়া, কালিগঞ্জ, বাগানপাড়া ও পিয়ার্সনপল্লি। ২০১২ সালে ওই চার গ্রামে সমীক্ষা করে লক্ষ্মণ সোরেনেরা দেখেছেন, রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীর ঠিক পাশের ওই চার গ্রামেই শিক্ষার আলো ছড়ায়নি, এখনো সেখানে ৮০ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর। মাত্র ছয়জন স্নাতক, একজন মাস্টার্স ডিগ্রিধারী।
বাসু সোরেন এমনই একজন মোড়ল বা সাঁওতালি ভাষায় গাঁও হারাম, যিনি ওই বৈঠকে ছিলেন। তিনি জানান, এখন চেষ্টা চলছে বীরভূম জেলার অন্তত ২০০ সাঁওতাল গ্রামের মোড়লদের এভাবে জড়ো করার। পশ্চিমবঙ্গের এই আদি বাসিন্দাদের সংখ্যা এখন ৬০ থেকে ৭০ লাখের মতো। সবচেয়ে বেশি সাঁওতাল রয়েছে দুই মেদিনীপুর জেলায়, প্রায় ১৪ লাখ। বীরভূমে দেড় লাখের বেশি, বাঁকুড়া ও বর্ধমানে প্রায় চার লাখ করে, পুরুলিয়ায় সাড়ে তিন লাখ মানুষের বাস। ওই সব জেলায়ও সাঁওতাল সমাজের মানুষ এখন নিজেদের মধ্যে বৈঠক করতে শুরু করেছে, যার প্রমাণ ৩ এপ্রিল কলকাতার জনসভায় বহু মানুষ ওই সব জেলা থেকেও এসে প্রতিবাদে শামিল হয়।
সব মিলিয়ে লাভপুরের ঘটনা সাঁওতাল সমাজকে এমনভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে যে তারা এখন ভেতর থেকে তাদের সমাজকে সংস্কার করতে উদ্যত। শিবু সোরেনদের নিজস্ব নাটকের দল রয়েছে ‘সেপজুলু গায়েন গাঁওতা’। ওই নাটকের দল এখন নিজেদের সমাজের যাবতীয় দুর্বলতা, শিক্ষার অভাব, হাঁড়িয়া আসক্তি, ডাইনি প্রথা ইত্যাদির বিরুদ্ধে নাটক নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরছে। না, বামপন্থী বা দক্ষিণপন্থী প্রতিষ্ঠিত কোনো রাজনৈতিক দলের কাছেই তারা সাহায্যপ্রার্থী নয়। শিবুর বক্তব্য, ‘আমাদের তো শুধু ভোটের সময় ওদের মিছিলে ও সভায় নিয়ে যায়। ওদের ভোট দিতে বলে। তারপর আর ওদের মাথাব্যথা নেই। এটা আমাদেরই করতে হবে, বাইরে থেকে এসে কেউ করে দেবে না।’
যদি শেষ পর্যন্ত এভাবে শিক্ষিত সাঁওতালেরা নিজেদের সমাজের সংস্কারে এগিয়ে আসে, তাহলে আগামী দিনে এই সমাজেও পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।

রজত রায়: ভারতীয় সাংবাদিক।