যুদ্ধাপরাধের বিচার

ন্যায় ও সত্যের জয়ধ্বনি

বধ্যভূমি
বধ্যভূমি

বাংলাদেশে একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের নিষ্ঠুরতা ছিল মর্মান্তিক, অধিকন্তু এর দুই নিষ্ঠুরতর দিক হচ্ছে নারীদের ওপর নেমে আসা নির্যাতন ও বুদ্ধিজীবী হত্যা। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারকাজে নারী নির্যাতনের গুটিকয় ঘটনা উঠে এলেও এর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সংঘটিত এই অপরাধের একধরনের স্বীকৃতি মিলেছে। বুদ্ধিজীবী হত্যা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে আলী আহসান মুজাহিদের মামলায়, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের অপহরণ ও হত্যার ঘটনায়, গোলাম আযমের মামলায় এই হত্যাযজ্ঞে তাঁর ঊর্ধ্বতন দায়বদ্ধতার বিষয়টি স্বীকৃত হয়েছে, কাদের মোল্লার মামলায় কবি মেহেরুননিসা ও সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবের হত্যার অভিযোগ উত্থাপিত ও প্রমাণিত হয়েছে; কিন্তু সামগ্রিকভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যা যে উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা নিয়ে আলবদর বাহিনী সংঘটিত করেছে, তা আদালতের বিচারভুক্ত হয়েছে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে আনীত মামলায়। এই মামলায় ১১টি অভিযোগে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ ও হত্যার জন্য এই দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ পর্যালোচনা করে অবশেষে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর আদালত রায় ঘোষণা দেন। এই রায় ইতিহাসের এক বিশাল দায় মোচন করল এবং রায়ের মধ্য দিয়ে আইনের পথে ইতিহাসের অনেক বড় সত্য উন্মোচিত হয়েছে। আদালত ১৮ জন বুদ্ধিজীবীর হত্যা প্রসঙ্গ বিবেচনাকালে এই হত্যাকে চিহ্নিত করেছেন ‘এক্সটারমিনেশন’ বা ‘নিশ্চিহ্নকরণ’ হিসেবে, যা ছিল ব্যাপক আকারে ও পাইকারিভাবে পরিচালিত হত্যাকাণ্ডের নিদর্শন। আদালত সুস্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আলবদর বাহিনীর সম্পর্ক, যে বাহিনী কাজ করেছে গোপন হন্তারক সংগঠন হিসেবে। এই রায় সবার জন্য অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত, বর্বরতার মাত্রা ও গভীরতার ইঙ্গিত এখানে মেলে, তবে বড়ভাবে পাওয়া যায় এই নিষ্ঠুরতা পরিচালনার সাংগঠনিক কাঠামোর পরিচয়।

আদালত যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের বিধি-বিধান অনুসরণ করেন, ক্ষেত্রবিশেষে অন্যান্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের অভিজ্ঞতার আলোকে, সিদ্ধান্ত টেনেছেন, সেই পরিচয় নানাভাবে মেলে। আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার কথা ছিল অধ্যাপক শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলে মিশুক মুনীরের, তদন্ত কর্মকর্তার কাছে তাঁর জবানবন্দি লেখা ছিল, কিন্তু অকালদুর্ঘটনায় প্রয়াত মিশুক মুনীরের আর আদালতে উপস্থিত হওয়া হলো না। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধের ক্ষেত্রে প্রচলিত ফৌজদারি মামলার বিধি-বিধান প্রচলিত নয়। আন্তর্জাতিকভাবেই এই আইন অভিযুক্তের প্রতি কঠোর, পীড়নের শিকার ব্যক্তির প্রতি সহানুভূতিশীল। তাই লোকমুখে প্রচলিত কথা বা ধারণাও এই আদালতে প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হতে পারে। একইভাবে আদালত মনে করলে গরহাজির সাক্ষীর কোনো আনুষ্ঠানিক জবানবন্দি অথবা লিখিত বক্তব্য সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। সেই বিবেচনা থেকে মিশুক মুনীর-প্রদত্ত ভাষ্য ১৯৭৩ সালের আইনের ধারা ১৯(২) অনুসারে আদালত সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

আদালতের বিবরণী থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার পরপর বঙ্গবন্ধুর সরকারের নির্দেশনায় আলবদর পরিচালিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শুরু হয়। পুলিশ কর্মকর্তা আবদুস সালাম তালুকদার এই তদন্ত পরিচালনা করেন এবং তিনি টাঙ্গাইলের দূর গ্রাম থেকে ধরে এনেছিলেন ইপিআরটিসির মাইক্রোবাসের চালক মফিজকে, যাঁর গাড়ি নিয়ে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীকে তুলে এনেছিলেন এবং আটজন বুদ্ধিজীবীকে মিরপুরে আশরাফুজ্জামান খান ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা কীভাবে হত্যা করে, সেটা মফিজ দেখেছিলেন। পরে মফিজের দেওয়া তথ্য অনুসারে মিরপুরের ইটখোলা থেকে ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি, হত্যাকাণ্ডের ২২ দিন পর, সাতজনের পচা-গলা লাশ উদ্ধার করা হয়। মফিজ অনেক আগেই প্রয়াত, তবে আবদুস সালাম তালুকদার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে বিস্তারিত বক্তব্য লিপিবদ্ধ করেছিলেন, বলেছিলেন মফিজের ভাষ্য। এরপর বিচার শুরুর আগে তিনি মৃত্যুবরণ করলেও সাক্ষী হিসেবে তাঁর বক্তব্য তাই আদালতে রয়ে গিয়েছিল, তেমনি যুক্ত হয়েছিল মফিজের ভাষ্য।

বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হয়েছিলেন দেলোয়ার হোসেন। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের এই কর্মকর্তাও বন্দী হয়ে বধ্যভূমিতে নীত হয়েছিলেন এবং সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। তিনি বর্ণনা দিয়েছেন, কীভাবে বন্দী অবস্থায় অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও মুনীর চৌধুরীর ওপর অত্যাচার চালানো হয়। তিনি আদালতে জানান, ১৫ ডিসেম্বর রাত আটটা থেকে সাড়ে আটটার দিকে দুই ব্যক্তি হারিকেন হাতে তাঁদের ঘরে ঢোকে। পেছনে ছিল লোহার রড হাতে ১০ থেকে ১২ জন মানুষ। হারিকেনের আলোয় তিনি দেখেন, এই দুজন ব্যক্তি মুনীর চৌধুরীর কাছে গিয়ে বলে, ‘এত দিন তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মন্ত্র পড়িয়েছ, এবার আমরা তোমাকে কিছু মন্ত্র শেখাব।’ এরপর তারা প্রথম মুনীর চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করে, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর বই লিখেছেন কি না। একই প্রশ্ন করে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে। তারপর সঙ্গীদের বলে, ‘এরা হলো ভারতের চর, এদের আজ কতল করা হবে।’ এর পরই শুরু হয় এলোপাতাড়িভাবে দুজনকে প্রহার।

রোমহর্ষক এসব সাক্ষ্য-প্রমাণের মধ্য দিয়ে আদালত তাঁদের রায়ে উপনীত হয়েছিলেন। বুদ্ধিজীবীদের জীবনকৃতির যৎসামান্য পরিচয়দানের চেষ্টাও নেওয়া হয়েছে রায়ে। বলা হয়েছে, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডেল-প্রাপ্ত ছাত্র, ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক এবং প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডের সমর্থক। কিন্তু আরও অনেক কথা তো বাকি রয়ে যায় মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী সম্পর্কে, আদালতে বিবেচিত হত্যাকাণ্ডের শিকার আরও ১৭ বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে। নোয়াখালীর দূর গ্রামের মসজিদের ইমামের এই ছেলে ম্যাট্রিক পরীক্ষায়
সারা বাংলায় কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে বৃত্তি পেয়ে পড়তে এসেছিলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখান থেকে বিএ পাস করেন বাংলায় রেকর্ড নম্বর পেয়ে। বাংলায় তাঁর প্রাপ্ত সেই নম্বর আজও কেউ অতিক্রম করতে পারেননি।

১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদ্যাপনকালে কর্তৃপক্ষ তাঁকে বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বক্তৃতা করার জন্য। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর রক্তে বোধ হয় অন্য স্পন্দন ছিল। হাজার হলেও মসজিদের ইমামের সন্তান, তিনি অনুভব করতে পারেন স্রষ্টার মাহাত্ম্য ও সৃষ্টির বিশালতা, জাগতিক বিবিধ আয়োজনের তুচ্ছতা। আর তাই তো, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পরীক্ষা দেওয়ার সব আয়োজন ও মোহ ত্যাগ করে চলে যান শান্তিনিকেতনে, রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীতে পড়বেন বলে; যে প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রির কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি তখন ছিল না, শিক্ষার বাজারে তার কানাকড়ি মূল্য নেই। শান্তিনিকেতনে সবাই তাঁকে জেনেছিল ‘মুখোজ্জ্বল’ হায়দার চৌধুরী বলে। কেন এমন নামকরণ, তার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। দেশভাগের পর ঢাকায় এসে জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতায় তিনি যোগ দেন। পরে বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই তাঁকে নিয়ে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু কাজে যোগদানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর ডিগ্রি। কাগজে-কলমে তিনি কেবল একজন গ্র্যাজুয়েট মাত্র, এমএ পাসের সনদ তাঁর নেই, বিশ্বভারতীর সেকালে প্রাপ্ত ডিগ্রি তো স্বীকৃত নয়। অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন এমএ প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিয়ে দিতে। বিষয় তো তাঁর সবই জানা। কেবল পরীক্ষায় বসলেই হবে, কোনোরকমে পাস করে ডিগ্রি হাতে পেলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে আর বাধা থাকবে না। এই পরীক্ষা দিতে মোটেই সম্মত ছিলেন না মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। কেননা, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষালয়ের সনদ তাঁর কাছে ছিল অনেক উচ্চ মূল্যের। শেষ পর্যন্ত সবার পীড়াপীড়িতে, পরিবারের কারণে তিনি অনিচ্ছুক পরীক্ষার্থী হতে বাধ্য হলেন এবং পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন।

‘সদাশিব’ বলে বাংলায় যে শব্দ রয়েছে, তার অর্থ সদা-বিনম্র, অল্পেই তুষ্ট এবং এমন একজন ব্যতিক্রমী মানুষই ছিলেন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। রোগা-পাতলা, পলকা শরীর। কেবল চোখ দুটো বিশাল, যেন দুচোখ ভরে তিনি আহরণ করবেন সৃষ্টিসুধা, জীবনের আনন্দ, আর কিছুই তাঁর কাম্য নয়। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও এই বোধ সঞ্চারে তিনি নিবেদিত ছিলেন, এমন মন্ত্রই তিনি সঞ্চার করে চলছিলেন অকাতরে। তাঁর জীবনের শেষ রাতটুকু, শেষ প্রহর কেমন কেটেছে, লোহার রডের আঘাতের পর আঘাত তাঁর শরীরে কী বিপুল যন্ত্রণার জন্ম দিয়েছিল, বধ্যভূমিতে যখন তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো, তখন তাঁর মনে কোন বোধ সঞ্চারিত হয়েছিল—সেসব কিছু আদালত বলেননি। তবে বিচারের রায়ের ছত্রে ছত্রে আছে তা অনুধাবনের সূত্র, আছে এমন বীভৎস, নারকীয় হত্যার কার্যকারণ বুঝতে পারার অবলম্বন। ঘাতক অসহিষ্ণু হয়েছিল বুদ্ধিজীবীদের সঞ্চারিত মানবিক
মন্ত্রে, তাঁদের দ্বারা প্রদত্ত রাবীন্দ্রিক শিক্ষায়, তাঁদের বাঙালিয়ানায়, অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। তাই তো তারা হয়ে উঠেছিল সদলবলে অমন নিষ্ঠুর ঘাতক।

গণহত্যাবিষয়ক খ্যাতিমান গবেষক গ্রেগরি স্ট্যানটন গণহত্যার আটটি ধাপ সূত্রায়িত করেছিলেন, এর সূচনা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে আলাদা বা অপর হিসেবে চিহ্নিত করে, কলঙ্কিত করে তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা সঞ্চার দ্বারা। এই ঘৃণারই প্রতিফলন আমরা দেখি বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে। আর গণহত্যার সপ্তম ধাপ হচ্ছে ‘এক্সটারমিনেশন’, যা রূপ নেয় জেনোসাইডে অথবা ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটিতে। লক্ষণীয় যে গণহত্যার অষ্টম একটি ধাপও চিহ্নিত করেছিলেন গ্রেগরি স্ট্যানটন। তাঁর মতে, সর্বশেষ এই ধাপ হচ্ছে ডিনাইয়াল বা অস্বীকৃতি। যারা গণহত্যাকারী, তারা অস্বীকার করে যে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে এই সূত্রগুলো মিলে যায় আমাদের বাস্তবতার সঙ্গে, যারা গণহত্যা ঘটিয়েছে, তারা ধর্মকে অবলম্বন করে ঘৃণা সঞ্চার করেছিল অন্যের বিরুদ্ধে, কেবল অন্য ধর্ম নয়, নিজ ধর্মের ভিন্নমতাবলম্বী মানবতাবাদী অসাম্প্রদায়িক মানুষও হয় ঘৃণার উদ্দিষ্ট। সবশেষে গণহত্যাকারীরা বিচারহীনতা চাপিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি প্রচার করছিল গণহত্যার অস্বীকৃতি, ৩০ লাখ মানুষের জীবনদান নিয়ে করেছ রঙ্গ-তামাশা এবং ক্রমান্বয়ে বিরামহীনভাবে অপমানে বিদ্ধ করেছে জাতিকে। আজ সব মিথ্যার আবরণ ঘুচিয়ে ন্যায় ও সত্যের জাগরণ ঘটল বিচারের মাধ্যমে।

রায় বলছে অনেক কথা, শুনতে কি পাই আমরা?

মফিদুল হক: লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।