ন্যাটো কেন এখনো টিকে আছে

ন্যাটোসহ আরও বড় বড় আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে যদি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হতো, তাহলে কি রাশিয়ার সাহস হতো কিংবা কোনো যুক্তি দেখাতে পারত ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর?
ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধবিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বপরিচিত ইতিহাসবিদ যুবাল নোয়া হারারি দাবি করেছেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমাদের বড় অর্জন হচ্ছে বিশ্বে এক দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ইউক্রেন আক্রমণ করে রাশিয়া সেই শান্তি নষ্ট করে বিপজ্জনক এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।’ নিশ্চয়ই ইউক্রেন আগ্রাসন এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে, কিন্তু ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে এক দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল’—এই দাবি সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশ্বের কাছে এক নিষ্ঠুর পরিহাসই বটে।

এ বিশ্বযুদ্ধের পরের কয়েক দশকে আমরা দেখেছি বহু যুদ্ধ ও আগ্রাসন। পঞ্চাশের দশকে কোরিয়া যুদ্ধ, ষাটের দশকে ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসন, কিউবার ওপর অব্যাহত মার্কিন অবরোধ, আশির দশক থেকে আফগানিস্তান, নব্বইয়ের দশক থেকে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ খুন হয়েছে। এর ৯০ শতাংশ বেসামরিক নাগরিক, এদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাই ৫ লাখের বেশি। এ ছাড়া মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় ইন্দোনেশিয়া, চিলি ও বাংলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা হয়েছে, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসন-খুন-জখম-সন্ত্রাস চলছে কয়েক দশক ধরে, ইয়েমেনে সৌদি আক্রমণ–ধ্বংসযজ্ঞ চলছে কয়েক বছর ধরে।

যুক্তরাষ্ট্রের শক্তির ভিত দেখতে গেলে চারটি প্রধান—সামরিক শিল্প কমপ্লেক্স, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির ওপর প্রায় একচেটিয়া কর্তৃত্ব, ডলার আধিপত্য এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ওপর নির্ধারক প্রভাব। ওয়ালারস্টেইন আধিপত্য রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া তিনটি কৌশলের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন—পশ্চিম ইউরোপ ও জাপানকে রাজনৈতিক অংশীদার বানিয়ে তাদের বশে রাখা; সামরিক আধিপত্য নিশ্চিত করার জন্য পরিধি ও আধা পরিধিভুক্ত দেশগুলোয় পারমাণবিক শক্তির বিকাশ বাধা দিতে সর্বোচ্চ সক্রিয়তা এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে মুনাফা ও আধিপত্য ধরে রাখতে বিশ্বব্যাংক আইএমএফের মাধ্যমে ‘নব্য উদারবাদী’ বা কট্টর পুঁজিপন্থী অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়নে চাপ রাখা।

বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা যে আসলে ভয়ংকর অব্যবস্থা, তার একটি বড় প্রমাণ জাতিসংঘের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তা পরিষদ। এর স্থায়ী সদস্য পাঁচটি—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া ও ফ্রান্স। কাগজে–কলমে এদের দায়িত্ব বিশ্বের নিরাপত্তা বিধান হলেও পারমাণবিক বোমাসহ সমরাস্ত্র উৎপাদন, মজুত, বিক্রি তাদেরই সবচেয়ে বেশি। এ কারণে যুদ্ধের উত্তেজনাসহ বিশ্বের নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টিতে এদের ভূমিকাই প্রধান। এদের আবার ভেটো ক্ষমতা আছে, যা দিয়ে তারা বিশ্বের বাকি সব দেশের সিদ্ধান্ত নাকচ করে দিতে পারে। সামরিক ঘাঁটি, পারমাণবিক বোমা, মহাকাশ শক্তিসহ সামরিক ক্ষমতার দিক থেকে এদের মধ্যে অতুলনীয় অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র।

বিশ্ব সামরিক খাতে ব্যয় নিয়ে নিয়মিত সমীক্ষা করে সুইডেনের প্রতিষ্ঠান সিপরি (স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট)। গত ২৫ এপ্রিল তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে আগের বছর, অর্থাৎ ২০২১ সাল পর্যন্ত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ বছর বিশ্বের সামরিক ব্যয় বেড়ে হয়েছে দুই ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে যথারীতি শীর্ষস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র, দ্বিতীয় স্থানের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি। যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ৮০১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চীন ব্যয় করে ২৯৩ বিলিয়ন। এখন অন্য অনেককে পেছনে ফেলে সামরিক ব্যয়ে তৃতীয় স্থান নিয়েছে ভারত, ৭৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন। রাশিয়ার অবস্থান পঞ্চম। ব্রিটেনের ৬৮ দশমিক ৪ বিলিয়নের পরে রাশিয়া ৬৫ দশমিক ৯। ফ্রান্স ও জার্মানি প্রায় সমান সমান (৫৬ দশমিক ৬ ও ৫৬)। এরপরই সৌদি আরব (৫৫ দশমিক ৬)।

ইউক্রেন সংকটকে কেন্দ্র করে বহু কিছুই টালমাটাল; ডলার আধিপত্যসহ অনেক স্থিতাবস্থাই পাল্টে যেতে পারে। এ প্রশ্ন তো এখন খুব জরুরি, যেখানে তুলনীয় কোনো প্রতিপক্ষ নেই, সেখানে কোন যুক্তিতে ন্যাটোর মতো সামরিক জোট এখনো টিকে আছে, যার নেতৃত্বে বিশ্বে বহু ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে? তার সম্প্রসারণ কার বিরুদ্ধে? আর যারা পারমাণবিক বোমার বস্তা নিয়ে বসে আছে, তাদের কি নৈতিক অধিকার আছে অন্যদের এ বিষয়ে বাধা দেওয়া? ক্ষুধা, দারিদ্র্যক্লিষ্ট বিশ্বে কেন সামরিক খাতে এ বিশাল বিনিয়োগ হবে? কিন্তু মিডিয়া একনায়কত্বের কারণে এসব প্রশ্ন সামনে আসে না।

ন্যাটো হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম সামরিক জোটের নাম, যার কর্তা যুক্তরাষ্ট্র, মোট বাজেটের ৭০ শতাংশ তারাই বহন করে, লাভও প্রধানত তাদের সামরিক-শিল্প জোটের। সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সমাজতন্ত্র মোকাবিলার অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই জোট। এর প্রতিক্রিয়ায় ১৯৫৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় পাল্টা সামরিক জোট ‘ওয়ারশ’। ১৯৯০ সালের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে এই জোটও লুপ্ত হয়, রাশিয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতন্ত্র পুঁজিবাদী বিশ্বে যোগ দেয়। সে সময় বিদায়ী সোভিয়েত নেতাদের সঙ্গে মার্কিন নেতাদের একটি বোঝাপড়া এ রকম হয় যে ন্যাটো আর সম্প্রসারিত হবে না। বিশ্বে তখন সাধারণভাবে এ ধারণাই প্রবল ছিল যে এরপর আর যুদ্ধের প্রাসঙ্গিকতা থাকবে না। কিন্তু এ ধারণা যে ভুল, যুদ্ধ যে পুঁজিবাদী বিশ্বের অস্তিত্বের অংশ, তা প্রমাণ হতে বেশি দেরি হয়নি। ১৯৯১ সালেই ইরাক আক্রমণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের নতুন প্রান্তর উন্মুক্ত হয়। ২০০১ থেকে ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’–এর নামে বিশ্ব সন্ত্রাস ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়। ন্যাটোর সম্প্রসারণও ঘটতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় ওয়ারশ জোটে যুক্ত সব কটি দেশই এখন ন্যাটোতে, আর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক প্রজাতন্ত্রও এখন ন্যাটোর সদস্য। মানচিত্র দেখলে দেখা যাবে, ইউক্রেন আর বেলারুশ বাদে রাশিয়া সীমান্তের সব কটি দেশই ন্যাটোতে যোগদান করেছে, এখন আক্ষরিকভাবেই তারা ন্যাটো দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছে।

এ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন, এতে জীবন ও সম্পদের বিপুল ক্ষতি হচ্ছে ইউক্রেনের, আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে রাশিয়ারও, সেই সঙ্গে আর্থিক ও অন্যান্য অনিশ্চয়তার চাপ বাড়ছে সারা বিশ্বের মানুষের। তবে লাভ হচ্ছে অস্ত্র ব্যবসা, ফাটকাবাজারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কতিপয় রাষ্ট্র এবং বড় ব্যবসায়ীদের।

রাশিয়ান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও প্রতিবাদ জোরদার হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্যোগে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বেশ কিছু অর্থনৈতিক ও মিডিয়া–নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশসহ বহু দেশে এখন রাশিয়ান টেলিভিশন প্রচার বন্ধ, ফেসবুক-টুইটারে রাশিয়ার অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ; তবে তার বিরুদ্ধে হিংসাত্মক প্রচার অনুমোদিত, রাশিয়ান বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বিমান চলাচল নিষিদ্ধ, রাশিয়ান আন্তর্জাতিক বাণিজ্য লেনদেন বন্ধ করতে ‘সুইফট’ থেকে তারা বহিষ্কৃত, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে পুতিনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে মামলা শুরুর প্রস্তুতি চলছে ইত্যাদি।

আমরা কল্পনা করি, এ রকম উদ্যোগ যদি আগে থেকেই ন্যাটোসহ আরও বড় বড় আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে নেওয়া সম্ভব হতো, তাহলে কি রাশিয়ার সাহস হতো কিংবা কোনো যুক্তি দেখাতে পারত ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর? যেমন যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরাক ও আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়ে লাখ লাখ মানুষ হত্যা করেছে, যখন ইসরায়েল দশকের পর দশক ফিলিস্তিনের ওপর আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে, তখন যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশ্ব তাদের ওপর এ রকম নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারত! যেমন অনুপ্রবেশ, স্বাধীন দেশ দখল, গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের দায়ে বিশ্ববাসী যদি মার্কিন সব বৃহৎ কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারত, যদি তাদের পালাপোষা বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের তৎপরতা বন্ধ করতে পারত, যদি সিএনএন–ফক্সসহ মার্কিন প্রচারমাধ্যমের প্রচার নিষিদ্ধ করা যেত, যদি পেগাসাসসহ ইসরায়েলের সব সামরিক তৎপরতা ও বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা যেত, যদি এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচার করা যেত, তাহলে বিশ্ব যে অনেক নিরাপদ ও শান্তিময় হতো, তাতে কি কারও সন্দেহ থাকতে পারে?

ইউক্রেন সংকটকে কেন্দ্র করে বহু কিছুই টালমাটাল; ডলার আধিপত্যসহ অনেক স্থিতাবস্থাই পাল্টে যেতে পারে। এ প্রশ্ন তো এখন খুব জরুরি, যেখানে তুলনীয় কোনো প্রতিপক্ষ নেই, সেখানে কোন যুক্তিতে ন্যাটোর মতো সামরিক জোট এখনো টিকে আছে, যার নেতৃত্বে বিশ্বে বহু ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে? তার সম্প্রসারণ কার বিরুদ্ধে? আর যারা পারমাণবিক বোমার বস্তা নিয়ে বসে আছে, তাদের কি নৈতিক অধিকার আছে অন্যদের এ বিষয়ে বাধা দেওয়া? ক্ষুধা, দারিদ্র্যক্লিষ্ট বিশ্বে কেন সামরিক খাতে এ বিশাল বিনিয়োগ হবে? কিন্তু মিডিয়া একনায়কত্বের কারণে এসব প্রশ্ন সামনে আসে না।

চাপা দেওয়া প্রশ্ন ধরে এগোতে গেলে তাই ইউক্রেনে রুশ সামরিক আগ্রাসন কিংবা এ রকম বা আরও ভয়াবহ আগ্রাসন ঠেকাতে ন্যাটোসহ সব সামরিক জোট ভেঙে দেওয়ার দাবিও তুলতে হবে। আমরা বৃহৎ শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়াসহ কোনো দেশের সামরিক খাতে আর সম্পদ অপচয় দেখতে চাই না, চাই না কোনো অস্ত্রের বাণিজ্য, অস্ত্রভান্ডার। কারণ, আমরা বিশুদ্ধ বাতাস, বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য ও নিরাপদ–মানবিক, সুস্থ–সজীব পৃথিবী চাই। এই বর্বর কালে কথাগুলো অবাস্তব মনে হলেও এসব আওয়াজেই গড়ে তুলতে হবে বৈশ্বিক সংহতি। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশ্বের এই শক্তি অর্জন ছাড়া বিশ্বশান্তির কোনো সম্ভাবনা নেই।

আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক

anu@juniv.edu