লঞ্চ দুর্ঘটনা

নৌপথে আইনের শাসন ও শৃঙ্খলা

মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে এমভি মিরাজ-৪ নামক লঞ্চডুবিতে ৪৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। যত দূর জেনেছি, ওই দিন বেলা দুইটা থেকে আবহাওয়া বিভাগের ২ নম্বর সতর্কসংকেত ছিল। ঝড়টির বার্তা সদরঘাট নদীবন্দরে পৌঁছেছিল। সে সংকেত অমান্য করে লঞ্চটি কীভাবে সদরঘাট টার্মিনাল ছাড়ল? বিআইডব্লিউটিএর টার্মিনাল কর্মকর্তারা কেন লঞ্চটির যাত্রা বন্ধ করলেন না? ঝড়ের সংকেত থাকুক কিংবা কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা থাকুক, লঞ্চমালিক ও চালকেরা কেউ আইন মানতে চান না।
মেরিন ম্যাজিস্ট্রেটের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, লঞ্চমালিকেরা কালবৈশাখীর মতোই আইনকে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলেন। এ ঝড়ের প্রভাবে নিস্তেজ হয়ে যায় বিআইডব্লিউটিএ ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের তৎপরতা! ফলে িফ্র স্টাইলে এ দেশে ব্যবহার হয় জলপথের এবং হাঁস-মুরিগর মতো যাত্রী ভরানো হয় নৌযানে। মালিকেরা বলেন, তাঁরা অনেক শক্তিশালী। আমার দৃষ্টিতে, ‘আইন তার চেয়েও অনেক বেিশ শক্তিশালী, যদি প্রয়োগকারীরা আইন প্রয়োগে সৎ ও সাহসী থাকেন।’ এই একটি ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতায় বারবার লঞ্চ ডুবছে। এ জন্য মেঘনা নদী কিংবা কালবৈশাখী দায়ী নয়। দায়ী তাঁরাই, যাঁরা নৌযান নির্মাণ, পরিচালনা ও চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন।
২০০৩ সালের জুলাই মাসে মেঘনা নদীর মোহনায় ‘এমভি নাসরিন’ লঞ্চ ডুবলে কীটপতঙ্গের মতো ছয় শতাধিক যাত্রীর মৃত্যু হয়। তদানীন্তন নৌমন্ত্রী কর্নেল আকবর হোসেনের পদত্যাগের দািবতে দেশব্যাপী জনরোষ সৃষ্টি হলে আগস্টে সরকারের নির্দেশে মেরিন ম্যাজিস্ট্রেট পদে যোগ দিয়ে শুরু করি সাঁড়াশি অভিযান। কর্নেল আকবর নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘কোকো’ লঞ্চ ধরা যাবে না। কিন্তু সদরঘাট টার্মিনালে প্রথম অভিযানেই তাঁর নির্দেশ অমান্য করে ক্ষমতাসীনদের মালিকানাধীন ‘কোকো’ লঞ্চসহ আটটি লঞ্চকে আটক এবং সর্বোচ্চ অঙ্কের জরিমানা করি। বাস্তবতা হলো, স্বল্পমাত্রার দণ্ডে বা চুনোপুঁটিদের ধরে অপরাধ দমন হয় না। এ অসহনীয় (!) দণ্ডের প্রতিবাদে ঘাট ছেড়ে বুড়িগঙ্গার মাঝ নদীতে অবস্থান নেয় সব লঞ্চ। লঞ্চমালিকদের আকস্মিক ধর্মঘটে নৌপথ অচল হয়ে যায়।
লঞ্চমালিকেরা এর আগে মোবাইল কোর্টকে মাত্র ২০০ টাকা জরিমানা দিয়ে আইনকে ‘উপহাসে’ পরিণত করেন। এ সংস্কৃতি ভেঙে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করায় তাঁরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। প্রায় এক সপ্তাহ ধর্মঘট চললেও লঞ্চমালিকদের অন্যায় দািবর কাছে মাথা নত করিনি। বরং অভিযান জোরালো করে আরও কিছু রাঘববোয়াল ধরে কঠোর দণ্ড দিলে সর্বত্র সঞ্চারিত হয় আইন-মান্যতা। ম্যাজিস্ট্রেিসর অভিজ্ঞতায় অবলোকন করেছি, সনদধারী মাস্টারের অভাব, ওয়াটার প্রুফবিহীন ইঞ্জিন, বেআইনিভাবে ডিজাইন পরিবর্তন, ÿক্ষমতার দেড় থেকে দুই গুণ বেিশ পণ্য বা যাত্রী বোঝাই, ঝড়ের সংকেত অমান্য করা, হাইড্রোলিক স্টিয়ারিং ব্যবহার না করা, মেয়াদোত্তীর্ণ জাহাজ চলাচলের অনুমতি না দেওয়া, জাহাজের খোলে মালামাল সুষমভাবে বণ্টন না করা

ইত্যাদি নৌ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। নৌযানের নিরাপদ চলাচলের জন্য বাংলাদেশে ‘মেরিন ট্রাফিক কন্ট্রোল/সার্ভিলেন্স সিস্টেম’ নেই।
অতিরিক্ত যাত্রী বা পণ্যবোঝাই অবস্থায় লঞ্চ বা জাহাজগুলো নদীর বুকে মনে হয় কচুিরপানার ওপর পানির মতো টলমলে। বাইরের আবরণ ঝকঝকে অথচ ২৫ থেকে ৩০ বছরের পুরোনো জাহাজসহ চলাচল-অযোগ্য বহু নৌযান অবলীলায় সমুদ্র পরিবহন বা নৌ-বািণজ্য অধিদপ্তরের সার্ভে-সনদ পেয়ে যায়। মোবাইল কোর্টে ধরা পড়লেই মালিক-মাস্টাররা বুক ফুলিয়ে বলেন, ‘আমাদের সার্ভে সনদ আছে’। অথচ সরেজমিনে জাহাজ পরীক্ষা করে দুর্ঘটনারোধক আবশ্যকীয় যন্ত্রপাতি বা নিরাপত্তাব্যবস্থা খুঁজে পাওয়া যায় না। এ কারণে নৌপথে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা বাস্তবে কঠিন।
২০০১ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত মেরিন ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালনকালে নানামাত্রিক অপরাধে অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছেয়ে যাওয়া অন্তত দুই হাজার কিলোমিটার নৌপথ ঘুরে দেখেছি বিচিত্র রূপে আইন ভঙ্গের নমুনা। তবে নৌ–দুর্ঘটনার জন্য শুধু নাবিকেরা দায়ী নন। অনেক জাহাজের মালিক বেিশ মুনাফার আশায় অতিরিক্ত যাত্রী বা পণ্য পরিবহনে চালকদের বাধ্য করেন। এর ব্যত্যয় ঘটলে অনেকে চাকিরচ্যুত হন। অদম্য লোভে প্রলুব্ধ মালিকদের লোভের অংশীদার আইনের রক্ষকেরাও।
নৌ–দুর্ঘটনা রোধে কারিগির কয়েকটি দিক আইিন বাধ্যবাধকতায় এনে তার বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। যেমন: ভারসাম্য রক্ষার্থে নৌযানের তলদেশে সলিড-ব্যালােস্টর (ভারী পদার্থ) ব্যবহার, উপযুক্ত ফেন্ডার ব্যবহার, ওয়াটারপ্রুফ ইঞ্জিনরুম, হাইড্রোলিক ্টিয়ারিং এবং দুই ইঞ্জিনের ব্যবহার। নৌযান শিল্পে বাংলাদেশের মেধার সাফল্য ম্লান হচ্ছে আইন প্রয়োগের ব্যর্থতায়। নৌনিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন আইনের কঠোর ও নির্ভয় প্রয়োগ। শুধু বিলাসবহুল লঞ্চ বানানো গৌরবের বিষয় নয়।
আইনের প্রতি লঞ্চমালিকদের থাকতে হবে শ্রদ্ধা এবং সীমিত রাখতে হবে লোভের মাত্রা। যাঁরা নৌ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁদের দক্ষতা ও সততা না থাকলে আইনকানুন, যাত্রী ও জীবন সবকিছুরই সলিলসমাধি ঘটবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, শুধু লোভের কাছে পরাজিত হচ্ছে আমাদের জীবন ও নিরাপত্তা। মোবাইল কোর্টে দণ্ডিত এক লঞ্চমালিক বলেছিলেন, ‘স্যার, আপনি আমাদের আইন মানা শিখিয়েছেন’।
২০০১-২০০৭ পর্যন্ত বন্দর থেকে বন্দরে এবং বিস্তীর্ণ নৌপথে সাত হাজার জাহাজ দণ্ডিত, রেকর্ড পরিমাণ জরিমানা আদায়, অবাধ্য নাবিকদের কারাদণ্ড প্রদান এবং সহস্রাধিক ত্রুটিপূর্ণ নৌযান আটকের নিরবচ্ছিন্ন এক অভিযানে নৌপথে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আইনের শাসন। প্রতিটি চিন্তা, প্রচেষ্টা ও কাজকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে পারলে আইন প্রয়োগে বলিষ্ঠতা আসে। নৌপথে শাসন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পথনির্দেশনা থাকল।

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী:ø সাবেক মেরিন ম্যাজিস্ট্রেট৷