আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোতে কোনো শৃঙ্খলা নেই। দলের ভেতরেও গণতন্ত্র–স্বচ্ছতা নেই। এমন একটা পরিস্থিতিতে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তটিই ঠিক ছিল না। এর মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের একেবারে শেষ স্তরে একটা বিষবৃক্ষ স্থাপন করা হয়েছে। এ অবস্থায় মনোনয়ন–বাণিজ্য হচ্ছে। পাশাপাশি মারামারি ও হানাহানিতে রক্ত ঝরছে, প্রাণহানি হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভোটের সময় প্রতিপক্ষকে মাঠছাড়া করার মরিয়া চেষ্টা দেখা যায়। এবারের ইউপি ভোটে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নেই। ফলে তাদের মাঠছাড়া করার আর সেভাবে দরকার পড়ছে না। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর বিরোধ হচ্ছে। উভয়েরই যেহেতু খুঁটির জোর আছে, তাই কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। এর ফলাফল প্রভাব বিস্তার, জবরদখল এবং রক্তপাত।
এখানে ‘রেফারি’ হিসেবে নির্বাচন কমিশন (ইসি) দায়িত্ব পালন করতে পারত। কিন্তু ইসি এবারের নির্বাচনকে মনে হয় নির্বাসনে নিয়ে গেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মূল অনুষঙ্গ রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ইসি। রাজনৈতিক দল বা প্রার্থী প্রতিপক্ষকে হটিয়ে দিতে চাইবে—এটা বাংলাদেশের বাস্তবতায় স্বাভাবিক। বাকি তিনটি পক্ষ নিরপেক্ষ ও শক্ত ভূমিকা পালন করলে সমস্যা হতো না।
প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহায়তা না করলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে একা সুষ্ঠু ভোট করা সম্ভব নয়। তবে নির্বাচন কমিশন একা চাইলে খারাপ নির্বাচন এড়াতে পারে। যেমন আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে ইসি। যে প্রার্থীর পক্ষে আচরণবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে, তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে। নির্বাচনের দিন ভোট বাতিল করতে পারে ইসি। এমনকি চাইলে ভোটের পর ফলাফলও বাতিল করার এখতিয়ার তাদের আছে।
ভোটের মাঠে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইসির অধীনে। এ দুই জায়গায় থেকে পক্ষপাত হলে ইসি কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু তারা এর কোনোটাই করছে না। অর্থাৎ ইসি কাউকেই কোনো কড়া বার্তা দিতে পারেনি। প্রার্থী বা রাজনৈতিক দল বুঝে গেছে, যত অন্যায়ই করুক না কেন, নির্বাচন কমিশন কিছু করতে পারবে না। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা মনে করছেন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের পক্ষে। ফলে কেউ কোনো আইন বা রীতির তোয়াক্কা করছে না। যেকোনো মূল্যে জয় পেতে চাইছে।
এক ইউনিয়নের মনোনয়ন পেতে এক ব্যক্তি কোটি টাকা খরচ করেছেন বলে শোনা গেছে। অথচ অনেক ইউনিয়নে কোটি টাকার কাজই হয় না। এটা থেকে বোঝা যায়, রাজনীতিক, ব্যবসায়ীদের হাতে প্রচুর অবৈধ টাকা এসেছে। এ টাকা বিনিয়োগ করে চেয়ারম্যান হতে পারলে তা অন্য ফায়দা নেওয়ার ক্ষেত্রে কাজে লাগবে। রাজনীতি বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এখন একটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে যে সাংসদ হওয়ার অর্থ হচ্ছে সোনার হরিণ হাতে পাওয়া। পৌরসভা, উপজেলা কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কিংবা মেয়র পদও অনেক লোভনীয় হয়ে উঠেছে। এখানে জনস্বার্থ বা জনসেবার চেয়ে ফায়দা লোটাই মুখ্য উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছে। এ প্রতিযোগিতায় কেউ পিছিয়ে থাকতে চায় না।