২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। বর্তমান মেয়াদের তিন বছর পার হয়ে চতুর্থ বছরসহ টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় আছে দলটি। এ সময়ের মধ্যে সরকারের নেওয়া বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বেশ প্রশংসিত হয়েছে দেশে-বিদেশে। বিশেষ করে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সবার মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে।
দেশের অন্যতম মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান, ২০২২ সালের মাঝামাঝি যান চলাচলের জন্য ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনার কথা বলেছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। পদ্মা সেতু চালু হলে দুর্ভোগ কমবে দক্ষিণবঙ্গের ২১টি জেলার মানুষের। বিশ্লেষকদের মতে, দেশের অর্থনীতিতেও বড় ভূমিকা রাখবে পদ্মা সেতু। এ ছাড়া দেশের আরও একটি মেগা প্রকল্প মেট্রোরেল এখন দৃশ্যমান। বাংলাদেশ সরকারের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্পগুলোর একটি মেট্রোরেল। এটি চালু হলে ঢাকার তীব্র যানজট সমস্যার অনেকাংশে সমাধান হবে বলে সবাই আশাবাদী। অন্য মেগা প্রকল্পগুলোর কার্যক্রমও চলছে বেশ ভালোভাবেই। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—পায়রা সমুদ্রবন্দর, এলএনজি টার্মিনাল, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর ইত্যাদি।
বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নের সুফল পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে দুই দশক ধরে তৈরি পোশাক খাতের উন্নতি যেন চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশ এখন পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বের ২য় অবস্থানে আছে। গত এক দশকে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের উন্নতি বেশ আশা জাগানিয়া। জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। মাথাপিছু আয় ছাড়িয়ে গেছে ২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার! তবে সব থেকে বড় অর্জন অর্থনীতির তিনটি সূচক পূরণ করায় বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করা। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও করোনা মহামারি যেন হঠাৎ করেই চোখ রাঙাচ্ছিল দেশের অর্থনীতিকে। মহামারির কারণে বিশ্বের অর্থনীতিতে বেশ ধাক্কা লাগে। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা মহামারির প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। এর প্রভাব সব থেকে বেশি পড়েছে দেশের শিক্ষা খাতে। দীর্ঘদিন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকায় ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেশনজট তৈরি করছে চরম হতাশা, বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষা বন্ধ থাকায় বেকারদের মধ্যেও হতাশা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে জনসাধারণের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আর সামনের নির্বাচনকে ঘিরে এ সবকিছু যেন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ!
গত দুই বছর বাজার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চাল-ডাল-তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে গেছে। এমনিতেই মহামারির কারণে দেশে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের আয় কমেছে, এর মধ্যে দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বগতিতে জীবিকা নির্বাহ করা যেন কষ্টসাধ্য। এ ছাড়া জ্বালানি তেলের দাম ও যানবাহনের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে অনেকটা অযৌক্তিকভাবে। সর্বশেষ ২০১৫ সালে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য পে–স্কেল দেওয়া হয়েছিল বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদকালে। তবে সেটা পুনর্বিবেচনা করার এখনই সঠিক সময় বলে অনেকে মনে করেন। গত সাত বছরে দ্রব্যের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ, যানবাহন ভাড়া ও অন্য সবকিছুর মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে সে তুলনায় বেতন আর বাড়েনি! এতে করে বর্তমান বাজারের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া শুধু কঠিনই নয়, বরং ধুঁকতে হচ্ছে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষকে। টিসিবির লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে তাদের। পে–স্কেলের বিষয়ে সিদ্ধান্তের পাশাপাশি বাজারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য চেষ্টা করা উচিত সরকারের।
করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশে সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থার। অনেকটা বাধ্য হয়ে প্রায় আঠারো মাস বন্ধ রাখতে হয়েছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে করে নিম্ন আয়ের পরিবারের শিশু-কিশোরদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বেড়েছে। এ ছাড়া ব্যাপক হারে সেশনজটে পড়েছে বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে যখন চাকরির পরীক্ষায় বসার কথা, তখন কিনা তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় কিংবা চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত! এতে তৈরি হচ্ছে চরম হতাশা, যার প্রমাণ মেলে গত দুই বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীর আত্মহননের ঘটনায়। শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে সেশনজট কমিয়ে আনা ও চাকরির বয়স বাড়ানোসহ আরও বেশি কর্মসংস্থানের সৃষ্টির পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষাগুলো যাতে স্বচ্ছ হয়, সেসব চ্যালেঞ্জ নিয়েও যুগান্তকারী কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরকারকে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ২০১৬ সালে দেশের যেসব উপজেলাতে সরকারি কলেজ নেই, সেসব উপজেলাতে একটি করে কলেজকে সরকারীকরণ করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও পার হয়ে গেছে ছয় বছর। তবে এখনো এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি, আর কবে হতে পারে সে বিষয়ে একেক সময় একেক রকম কথা বলা হলেও কলেজগুলোর শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এমতাবস্থায় এসব কলেজের অনেক শিক্ষক গত কয়েক বছরে অবসরে গেলেও নতুন করে নিয়োগ না হওয়ায় লোকবল–সংকটে ভুগছে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একদিকে অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের অনিশ্চয়তা, অন্যদিক লোকবলের ঘাটতি—এসব বিষয়ও ভাবতে হবে সরকারকে। প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিয়েও ক্ষোভ বাড়ছে। তাঁদের ন্যূনতম সম্মানজনক বেতন-ভাতার নিশ্চিত করাও জরুরি হয়ে পড়েছে।
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। আগের দুই কমিশন নিয়ে সমালোচনার শেষ ছিল না। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশের বিকল্প নেই। সেই গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষায় নির্বাচন কমিশনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দায়িত্ব নিয়েই নাগরিক সমাজের সঙ্গে সংলাপসহ নানা ধরনের গঠনমূলক তৎপরতা শুরু করেছে নতুন কমিশন। তবে সদ্য বিদায় নেওয়া নূরুল হুদা কমিশন কিছুটা বিতর্কিত হওয়ায় একটি স্বচ্ছ নির্বাচন উপহার দেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ হবে নতুন কমিশনের জন্য। স্বাভাবিকভাবেই বিরোধী দলগুলো নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আন্দোলনে যেতে চাইবে। বিরোধী দলের আস্থা তৈরিতেও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এটি সরকারের জন্যও নিঃসন্দেহে বড় চ্যালেঞ্জ, যেহেতু একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের দিকেই মনোযোগ দেশ-বিদেশের সবার।
কে এম মাসুম বিল্লাহ
ব্যাংক কর্মকর্তা
দুমকি, পটুয়াখালী