>গত ২৭ নভেম্বর ২০১৮, প্রথম আলোর আয়োজনে ও অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের সহযোগিতায় ‘নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে রাজনৈতিক ইশতেহার: বাস্তবতা ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা হলো।আলোচনায় সুপারিশ
■ নির্বাচনী ইশতেহারে নারীর নিরাপত্তাবিষয়ক যুগোপযোগী পরিকল্পনা থাকতে হবে
■ নির্বাচনে নারী প্রার্থী ও ভোটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে
■ রাজনীতিসহ দেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে হবে
■ নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে জাতীয় পর্যায়ে জিরো টল্াারেন্স ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে
■ নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের ক্ষেত্রে যেসব হটলাইন সেবা আছে, সেগুলোকে সঠিক নীতিমালায় পরিচালনা করতে হবে
■ সাধারণ জনগণের মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমের ভূমিকাকে প্রাধান্য দিতে হবে
■ ছাত্ররাজনীতিতে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে উৎসাহী করে তুলতে হবে
■ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারী ও শিশু ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারগুলোকে আরও সক্রিয় করে তুলতে হবে
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
নির্বাচন উপলক্ষে প্রতিটি দলের নির্বাচনী ইশতেহারে বরাবরই নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কিছু কর্মপরিকল্পনা থাকে। আগামী বছরগুলোতে এই সহিংসতা রোধে তাদের কী পরিকল্পনা আছে, সেগুলো বাস্তবায়নে তাদের কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে, এসব বিষয়ে আজকের আলোচনা।
আমাদের দেশীয় আইনব্যবস্থায় গত কয়েক বছরে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় সাজা পেয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ আসামি। এটা বিরাট ব্যর্থতা। তবু আশার কথা এই যে সামাজিক মাধ্যমগুলোর লেখালেখিতে নাগরিক সমাজ এ বিষয়ে সোচ্চার। আজকের আলোচনায় এসব বিষয় বিস্তারিত আসবে। এখন আলোচনা করবেন ফারাহ্ কবির।
ফারাহ্ কবির
নারীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বারবার নারীর প্রতি বৈষম্য, প্রাপ্য অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করাসহ নারীর প্রতি অমানবিক সহিংসতার প্রমাণ পেয়েছি। আন্তর্জাতিক মহলেও এই বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে পরিশেষে বারবার আমাদের সামনে একই সহিংসতার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠেছে, যে বিষয়টি ভীষণভাবে বারবার ভাবিয়েছে।
দেশের অর্ধেক জনগণ যেহেতু নারী, তাই যে দলই নির্বাচনে আসুক না কেন, তাদের অবশ্যই নারীদের প্রতি সহিংসতা রোধ এবং নারীর অধিকার পূরণের লক্ষ্যে বিস্তারিত নির্বাচনী ইশতেহার দিতে হবে। দেশের অর্ধেক জনগণকে বাদ দিয়ে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কোনোমতেই সম্ভব নয়। নারীর উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক—বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। সম্প্রতি অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ পরিচালিত এক গবেষণার তথ্যমতে, নির্যাতিত প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন।
তাই আগামী নির্বাচনে প্রতিটি দলের নির্বাচনী ইশতেহারে অবশ্যই নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে যুগোপযোগী প্রস্তাব থাকতে হবে।
এ ছাড়া দেখা গেছে যে পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও সেটা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা লক্ষ করা যায়নি।
রাজনৈতিক পর্যায়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ বা ক্ষমতায়নের ব্যাপারেও কিন্তু বিষয়টি সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বেইজিং সম্মেলনে আমাদের পক্ষ থেকে নির্বাচনে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলা থাকলেও বর্তমানে ৩০ শতাংশের কম। এসব বিষয়ের প্রতি লক্ষ রেখে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহার দিতে হবে। কেননা, আগামী বছরগুলোতে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও নারীর ক্ষমতায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি সবাইকে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা রোধে উদ্বুদ্ধ করবে।
রেখা সাহা
একজন নারী যখন সহিংসতার শিকার হয়, তখন শুধু একজন নারী নয়, বরং একজন অর্থনৈতিক চালিকা শক্তিসম্পন্ন মানুষ তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। দেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী হওয়ার ফলে তাদের প্রতি সহিংসতার অর্থ হলো একটা বৃহৎ অংশের মানুষকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা।
নারী উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের অবশ্যই মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও যৌক্তিকতাসম্পন্ন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে।
রাজনীতি, নীতিনির্ধারণী ও সিদ্ধান্তগ্রহণের ধাপগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সামনের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অবশ্যই অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি মাথায় রেখে নির্বাচনী ইশতেহার দিতে হবে।
ফারজানা শাহ্নাজ মজিদ
আমাদের জানতে হবে ঠিক কী পদক্ষেপ নিলে, কোথায় পরিবর্তন করলে আইনি প্রক্রিয়াগুলো আরও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে।
প্রয়োজনে নারীর সহিংসতা প্রতিরোধে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে। নারীর প্রতি সহিংসতা মোকাবিলায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর বিশেষ প্রশিক্ষণ থাকা প্রয়োজন। কেননা, নারীরা নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর, তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর, সবার আগে ছুটে যাবে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছে। তাই সেই অবস্থায় একজন নারীকে ভরসা দেওয়ার জন্য ঠিক কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে, সে বিষয়ে একজন আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তার সঠিক ধারণা থাকা প্রয়োজন।
দেশের প্রাথমিক স্কুলগুলো থেকে শুরু করে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীদের জন্য আলাদা স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নারীর প্রতি যে মূল্যায়ন, তা বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। পারিবারিকভাবে এই বিষয়গুলোতে সচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব হলে মানুষের মানবিক দিকগুলোতে পরিবর্তন আনা সম্ভব।
গণপরিবহনে নারীদের যে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়, সে বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে যেসব হটলাইন কাজ করে, সেগুলোর কার্যক্রমকেও সঠিক নীতিমালায় আনতে হবে।
মমতাজ আরা বেগম
ইশতেহারের সিংহভাগই দলগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারে না। কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনের আগে যখন তাদের এসব বিষয়ে জবাবদিহির মুখোমুখি করা হয়, তখন তারা পাশ কাটিয়ে যায়।
পরিবার থেকে সংসদ পর্যন্ত যদি আমরা নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করতে চাই, তাহলে প্রথমেই আমাদের নারী-পুরুষের মতামতের সমান মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যখন শিক্ষকের দ্বারা নারীরা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, স্থানীয় পুরুষনিয়ন্ত্রিত সমাজব্যবস্থা কিন্তু সে বিষয়ে উদাসীন থাকে। তখন আসলে নারীদের সহিংসতা প্রতিরোধে রুখে দাঁড়ানো বেশ মুশকিল হয়ে পড়ে।
রাজনৈতিক দলগুলোকে আগামী নির্বাচনী ইশতেহারে এমন সুপরিকল্পিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে, যেন দেশের প্রতিটি পর্যায়ের নারী-পুরুষের মতামতকে সমান গুরুত্বে বিবেচনা করা সম্ভব হয়।
শাহ্নাজ মুন্নী
নির্বাচনী ইশতেহারে আমরা যখন নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কথা বলার চেষ্টা করি, তখন আমাদের প্রথমেই খেয়াল করতে হবে যে এসব নির্বাচনী ইশতেহার কে বা কারা তৈরি করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান নীতিনির্ধারণী নেতারাই কিন্তু এই ইশতেহার সম্পাদনা করেন।
বিগত প্রতিটি নির্বাচনী ইশতেহারেই নারী ও শিশুনিরাপত্তা বিষয়ে বিভিন্ন নীতিমালার কথা এসেছে। প্রতিটি দলই কমবেশি এ বিষয়ে কথা বলেছে। কিন্তু এ বছর নির্বাচনের আগে আমরা আবার সেই একই দাবি নিয়ে কথা বলছি যে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে সুপরিকল্পিত নীতিমালা থাকতে হবে। ফলে বোঝা যায়, ইশতেহারের অঙ্গীকারগুলোর তেমন কোনো প্রয়োগ বাস্তবে থাকে না।
অন্যদিকে এসব রাজনৈতিক দলে নারীদের থেকে পুরুষ সদস্যদের অংশগ্রহণের হার বেশি। ফলে দলীয় কার্যক্রমে পুরুষের একচেটিয়া মতামত বেশি থাকে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শুধু স্থানীয় মানুষের ক্ষমতার কারণে নারী নেতৃত্ব লক্ষ করা যায় না। ওই সব এলাকায় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দাপট দেখা যায়। নারী-পুরুষের সমতা সৃষ্টি, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করাসহ নারীদের জন্য যেসব অধিকার নিয়ে কথা বলা হয়, সেগুলো এখন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জন্য শুধু মুখের বুলি হয়ে থেকে গেছে। বাস্তবে তাদের প্রতি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কিন্তু সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না।
এ ক্ষেত্রে আমাদের এখন প্রশ্ন তোলা উচিত, রাজনৈতিক দলগুলো বিগত নির্বাচনে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কতটুকু বাস্তবায়ন করেছে। পাশাপাশি এই নির্বাচনী ইশতেহারে একই বিষয়ে তাদের যে প্রস্তাব, সেটা কতটা যৌক্তিক, তা আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে।
গণমাধ্যমগুলো এ ক্ষেত্রে বেশ বড় ভূমিকা রাখতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো যে মনোনয়ন দিচ্ছে, সেখানে নারীদের মনোনয়ন পাওয়ার হার তুলনামূলকভাবে বেশ কম। নির্বাচনী নীতিমালাতে প্রতিটি দলে ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও নির্বাচনের মূল কার্যক্রমে সেটি কিন্তু মানা হচ্ছে না।
সংসদে নারীদের জন্য বরাদ্দ আসন বা দলের নারীবিষয়ক অংশের যে কার্যক্রম, সেখানেই শুধু নারী নেতৃত্বের অংশগ্রহণ দেখা যায়। দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা নীতিনির্ধারণী অংশে কিন্তু নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পুরুষের যে সচেতনতামূলক অংশগ্রহণ, সে বিষয়েও এগিয়ে আসতে হবে।
কেননা, নারীর প্রতি এসব সহিংসতা ঘটাচ্ছে সমাজের পুরুষেরাই। তাদের সচেতন না করে আমরা কখনোই এ বিষয়ে গোটা সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারব না। পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনই নারীদের জন্য সমাজে একটি নিরাপদ স্থান গড়ে তুলতে পারে। ফলে, রাজনৈতিক কর্মী থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি পর্যায়ের নারী-পুরুষকে সমন্বিতভাবে নারীর প্রতি সহিংসতামূলক আচরণ বন্ধে এগিয়ে আসতে হবে।
কাশফিয়া ফিরোজ
নির্বাচন–পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে নারীর নিরাপত্তা ও কোন ক্ষেত্রে কী ধরনের সহিংসতার শিকার হয় সেটা চিন্তা করে নির্বাচনী পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া নারী ও শিশু অধিকারবিষয়ক প্রতিশ্রুতির অনেকটাই গতানুগতিক। সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনার উল্লেখ থাকে না।
কিছু সাধারণ বাক্যে তারা যখন প্রতিশ্রুতি সংযোজন করে, তখন আমাদের জন্য তাদের কার্যপদ্ধতি এবং সুনির্ধারিত কার্যপরিকল্পনা বোঝা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
এমনকি নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে যেসব সহিংসতার ঘটনা ঘটে, সেখানে নারী প্রতিনিধিদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। আর মূলত এই পরিস্থিতি বিবেচনায় নারীদের সাধারণ আসনে তুলনামূলক কম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেখা যায়।
তা ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে যে সহিংসতার শিকার রাজনৈতিক নেতাদের হতে হয়, সেখানেও নারী প্রতিনিধিদের জন্য আলাদা কোনো নিরাপত্তা বা আস্থার জায়গা থাকে না।
নারীর প্রতি সহিংসতার কথা চিন্তা করে যেন নির্বাচনী পরিবেশ গড়ে তোলা হয়, সেটাও আমাদের জন্য একটি বড় প্রত্যাশা।
প্রান্তিক অঞ্চলে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় জনপ্রতিনিধিদের যেভাবে এগিয়ে আসার কথা, তঁারা ততটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, নির্যাতনকারীরা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছেই আশ্রয় খোঁজে।
অথচ এ ক্ষেত্রে ওই সব এলাকার জনপ্রতিনিধিরাই কিন্তু তাদের ভরসা দিয়ে, তাদের আস্থা অর্জন করে সাধারণ মানুষকে নারীর সহিংসতা রোধে সচেতন করে তুলতে পারেন। সব মিলিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে রাজনৈতিক দলগুলো এসডিজি-৫ অর্জনে গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করলে আমার মনে হয় তা লিঙ্গভিত্তিক সমতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
শর্মিলা রসুল
আমাদের সবার জানা উচিত যে নারী-পুরুষের এই যে বৈষম্য, সেটা শুধু বাংলাদেশের জন্যই আলোচনার বিষয় নয়, বরং সারা বিশ্বে এখন নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে প্রতিটি দেশ, সমাজ ও সংস্থা তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করে চলেছে।
নারীর লড়াই এখন শুধু নারী-পুরুষের বৈষম্য নিয়ে নয়, বরং মানুষের গোঁড়ামি, একগুঁয়ে নিয়মকানুনের বিরুদ্ধেও এখন নারীকে লড়াই করতে হয়। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীকে তার প্রাপ্য অধিকারের জন্য লড়াই করতে হয়। কেননা, ছোট-বড় বিভিন্ন ক্ষেত্রেই নারী বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের জন্য এখন নারীর অধিকার রক্ষায় শুধু নির্ধারিত ইস্যু নয়, বরং সামগ্রিক বিষয় নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। নারীর সামাজিক ক্ষমতায়ন, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, নারীর নিরাপত্তাসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে যেসব সংস্থা কাজ করে, তাদের একই নীতিমালা অনুসরণ করে একই লক্ষ্যে সব সময় অবিচল থাকতে হবে।
সারা বিশ্বেই নারীরা ঘরে-বাইরে তাদের পরিবার কিংবা বাইরের কারোর কাছ থেকে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। আমাদের হাতে আসা গবেষণার ফলাফল অনুসারে বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর একজন তাদের জীবনে একবার হলেও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এসব তথ্য আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে বর্তমান সময়ে নারীদের যে সংগ্রাম, তা কোনোভাবেই সহজ নয়।
দেশের ৫২ শতাংশ ভোটার নারী, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে নারীদের অংশগ্রহণ ছাড়াই ক্ষমতা পাচ্ছে, সেটাও কিন্তু ভেবে দেখার বিষয়।
নারীদের মতামতের যে ক্ষমতা, সেটি কাজে লাগাতে হবে। তাদের সব সময় দুর্বলভাবে না দেখিয়ে রাষ্ট্রগঠনে যে বলিষ্ঠ অবদান থাকতে
পারে, সেই বিষয়টি তাদের সামনে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে।
শিরীন পারভিন হক
আমাদের প্রথমেই লক্ষ করতে হবে যে আগামী নির্বাচন যেন নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক হয়। নারী-পুরুষ সব প্রার্থী ও ভোটার যেন নির্ভয়ে তাঁদের সমান অধিকার পান। সেই বিষয়টি নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। নির্বাচনকালে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে অবশ্যই নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতির চর্চা কমে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও নামমাত্র ছাত্ররাজনীতি চললেও সেগুলো বেহাল। এমনকি সেসব কমিটিতেও নারী সদস্যদের অবস্থান বেশ পেছনে। দেশের রাজনীতির কান্ডারি তৈরি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি থেকে। সেখানেই নারীকে এভাবে অবহেলা করা হলে ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিতে তো নারী তার ক্ষমতায়ন সৃষ্টি করতে পারবে না।
রাজনৈতিক দলগুলো ইশতেহারে উল্লিখিত বিষয়াবলি কতটুকু বাস্তবায়ন করেছে, সেটা তাদের বছর শেষে সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। সেটা শুধু নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে নয়, বরং ইশতেহারের সব প্রস্তাবের জন্যই এই জবাবদিহি প্রয়োজন।
ইশতেহারগুলোতে ধর্মীয়, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের ওপর যে সহিংস আচরণ আমরা দেখেছি, তা প্রতিরোধে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা দেখতে চাই।
এসব কাজের জন্য নারী-পুরুষ সদস্যদের সমান অগ্রাধিকার দিয়ে সাংবিধানিক কমিশন গঠন করতে হবে।
তানিয়া আমীর
আমাদের দেশে গত কয়েক দশকের নির্বাচনের সার্বিক চিত্র যদি আমরা দেখি, তাহলে বুঝতে পারব যে আমরা আসলে সঠিক পরিকল্পনামতো এগোচ্ছি না। আমরা প্রতিবার রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার দেখছি। সেগুলোর ভালো-খারাপ নানা দিক নিয়ে ভিন্নভাবে চিন্তা করছি। আবার সময়কাল চলে গেলে সবাই ভুলে যাচ্ছি। এখন আসলে সময় এসেছে আরও খুঁটিয়ে সবকিছু জানার।
রাজনৈতিক দলগুলো সরকার গঠনের পর তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের কী কী কাজ সম্পন্ন করেছে এবং সেগুলোর অগ্রগতি নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাই এখন আসলে সঠিক কাজ হবে বলে মনে করি।
এখন আমাদের নিজস্ব ক্ষমতায়নে এগোতে হবে। জনগণের একাত্ম শক্তির চেয়ে বড় কোনো শক্তি হতে পারে না। আমাদের মানুষের তাদের ভোটাধিকার নিয়ে সচেতন করতে হবে।
বাংলাদেশের জন্মই হয়েছিল ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করতে। আমাদের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে সচেতন থাকতে হবে।
একজন নারী শুধু শারীরিকভাবেই কিন্তু সহিংসতার শিকার হয় না। বরং প্রতিনিয়ত মানসিকভাবেও সমাজে, পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে নারীকে হেয় করা হচ্ছে। নারীদের প্রতি এই বিদ্বেষমূলক যে আচরণ, তার জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, সেটা আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন।
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রেও একজন পুরুষ বা নারী কতটা যোগ্য, তিনি সমান অধিকারে বিশ্বাসী কি না, তিনি নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সচেতন কি না, এসব বিষয়ও বিশদভাবে যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন।
খুশী কবির
আমাদের দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে অবশ্যই অভিন্ন পারিবারিক আইন থাকা প্রয়োজন। নির্বাচনে যেসব প্রার্থী মনোনয়ন পাচ্ছেন, তাঁদের নারীর প্রতি সহিংসতা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারের কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমরা যদি সম্মিলিতভাবে তাদের ওপর জনচাপ সৃষ্টি করতে পারি, দলগুলোকে বোঝাতে পারি যে জনগণই তাদের মূল শক্তি, তাহলে ভবিষ্যতে তারা এই গণজবাবদিহির মুখে পড়ে ইশতেহারে করা প্রস্তাবগুলো পূরণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।
নারীর প্রতি সহিংসতামূলক আচরণে যে বিচার, সেটাকে বারবার মূল্যায়ন করতে হবে। কেননা, সবাই সম্মিলিতভাবে সচেতন হলে কোনো রাজনৈতিক চক্রই এ ধরনের বিচারকার্যকে প্রভাবিত করতে পারবে না।
নুসরাত জাহান
২০০৯ সালে ইউএনডিপির সহায়তায় এ ধরনের সাপোর্ট সেন্টারের কাজ শুরু হলেও ২০১১ সাল থেকে সরকার এগুলো পরিচালনা করছে। বর্তমানে সারা দেশে প্রায় আটটি এ রকম ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার আছে।
আমাদের দেশে সহিংসতার হার দিন দিন বাড়ছে। তবে এখনকার নারীরা সচেতন হয়েছে অনেক। এখন তারা সহিংসতার শিকার হলে আমাদের কাছে সাহায্যের জন্য আসে। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, তাদের আইন সম্পর্কে সচেতন করা।
একজন নারী সমাজে, পরিবারে বা তার কর্মস্থলে যৌন নিপীড়ন বা যেকোনো ধরনের সহিংসতার শিকার হলে তার জন্য আসলে কোন আইন কাজ করবে, সে কীভাবে তার প্রতি এই ঘৃণ্য আচরণের বিচার পাবে, সেটা জানা তার জন্য জরুরি। আবার কিছু ক্ষেত্রে আইনের আওতায় আনাও বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
আমরা প্রস্তাব করেছিলাম, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এ রকম নারী ও শিশু ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার গড়ে তোলা জরুরি। এখানে নারী সদস্যরা সহিংসতার ব্যাপারে সাহায্য করবে। কিন্তু দুই লাখ সদস্যের পুলিশ বাহিনীতে মাত্র ৭ শতাংশ নারী পুলিশ আছে। ফলে পুরুষ পুলিশ সদস্যের কাছে নারীরা কথা বলতে চায় না।
সার্বিক এই বিষয়গুলো নিয়ে আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে এসব সমস্যা সমাধানে সুপরিকল্পিত প্রস্তাব থাকবে বলে আমি আশা করি।
আবুল হোসেন
সরকার ব্যবস্থাপনায় যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, নির্বাচনী ইশতেহার প্রতিটি দলের জন্য আসলে একটি প্রাথমিক পরিকল্পনার মতো। এরপর তারা যখন সরকার গঠন করে, তখন বাস্তব চিত্র বিবেচনা করে ইশতেহারের সব প্রতিশ্রুতি পূরণ করা আসলে সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে বাস্তবায়ন না করতে পারার পেছনের সীমাবদ্ধতা নিয়েও আমাদের ভাবা উচিত।
সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের সচিবদের চেয়ে রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমতা বেশি। সচিব কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন মাত্র। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা সংসদে এক হয়ে কোনো আইন পাস করাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ওই সব রাজনৈতিক নেতার তাঁদের নির্বাচনী ইশতেহারে উত্থাপিত প্রস্তাবগুলো মাথায় রেখে কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হবে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে আমরা নারী নির্যাতন রোধে মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের মাধ্যমে ১২টি অন্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করি। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে জাতীয় পরিকল্পনা, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জাতীয় পরিকল্পনাসহ নারীর অধিকার নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন আইন প্রণয়নে আমরা সরাসরি যুক্ত ছিলাম।
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সরকার কাজ করছে। সেটা সম্পূর্ণভাবে পূর্ববর্তী ইশতেহারকে পূরণ না করলেও আমাদের কাজ প্রাথমিকভাবে এগোচ্ছে। সরকার নারীদের জন্য যেসব সেবার ব্যবস্থা করেছে, সেগুলো সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য গণমাধ্যমই পারে তাদের কাছে পৌঁছে দিতে। এসব সেবা তাদের সহিংসতা থেকে রক্ষা করতে পারবে বলে মনে করি।
গ্রামপর্যায় থেকে শুরু করে সংসদেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নারী ও শিশুবিষয়ক উন্নয়ন কমিটি আছে। এই কমিটিগুলোর কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে হবে। জনগণ যেন তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়, সে ব্যাপারে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।
আমরা হয়তো আমাদের আশানুরূপ উন্নয়ন দেখছি না, কিন্তু সরকার ও মন্ত্রণালয়গুলো নিজ নিজ জায়গা থেকে তাদের কাজ করে যাচ্ছে। তাই রাজনৈতিক ইশতেহার পূরণে সরকার পুরোটা ব্যর্থ নয়। আমাদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। পরিবর্তন একদিন আসবেই।
আব্দুল কাইয়ুম
দেশে নারীদের প্রতি যেসব সহিংসতামূলক ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে আগামী বছরগুলোতে দেশের এই পরিস্থিতি বদলের কথা চিন্তা করে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া নির্বাচনে নারী প্রার্থীদেরও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
যাঁরা অংশ নিলেন
আবুল হোসেন: প্রকল্প পরিচালক, নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্প, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়
ফারাহ্ কবির: কান্ট্রি ডিরেক্টর, অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ
নুসরাত জাহান: সহকারী ডেপুটি পুলিশ কমিশনার, উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন
শর্মিলা রসুল: চিফ টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার, ইউএনডিপি হিউম্যান রাইটস প্রোগ্রাম
খুশী কবির: কো-অর্ডিনেটর, নিজেরা করি
তানিয়া আমীর: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ
মমতাজ আরা বেগম : চেয়ার, জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ফোরাম (জেএনএনপিএফ)
রেখা সাহা: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
শিরীন পারভিন হক: সদস্য, নারীপক্ষ
শাহ্নাজ মুন্নী: প্রধান বার্তা সম্পাদক, নিউজ টোয়েন্টি ফোর
ফারজানা শাহ্নাজ মজিদ: জেন্ডার অ্যান্ড ডাইভারসিটি স্পেশালিস্ট, আইসিডিডিআরবি
কাশফিয়া ফিরোজ: ম্যানেজার, উইমেন রাইটস অ্যান্ড জেন্ডার ইক্যুইটি, অ্যাকশনএইড, বাংলাদেশ।
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো