উচ্চশিক্ষা প্রশাসন

নারীর প্রতি বৈষম্য কেন?

এ দেশে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়-নির্বিশেষে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এখনো বেশ লিঙ্গবৈষম্য রয়েছে। তবে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে এ বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, কোষাধ্যক্ষ ইত্যাদি পদে নারীদের নিয়োগ অত্যন্ত বিরল, নেই বললেই চলে। শুধু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও।
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা যথাক্রমে ৩৩ ও ৫৪। এসবের মধ্যে শুধু সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যই নারী। এমনকি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইমেনের উপাচার্যও একজন পুরুষ।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনকাঠামোতে রয়েছেন আচার্য মনোনীত নির্বাচিত (ভিসি প্যানেল থেকে) একজন উপাচার্য, সরকার মনোনীত দুজন সহ-উপাচার্য, একজন কোষাধ্যক্ষ। তা ছাড়া রয়েছেন একজন রেজিস্ট্রার, একজন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। সিনেট, সিন্ডিকেট, অনুষদের ডিন, হল প্রাধ্যক্ষ, ইনস্টিটিউটের পরিচালকদের মধ্যে নারী শিক্ষক নেতৃত্ব থাকলেও ২ মার্চ ২০১৪ পর্যন্ত কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা থেকে আজ ২০১৪ সাল, নয় দশকেরও বেশি সময় লেগেছে এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে একজন নারীকে নিয়োগ দিতে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নারী শিক্ষককে ভিসি প্যানেল মনোনয়ন দিয়েছে, যিনি সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন এবং আচার্য কর্তৃক মনোনীত হয়ে সর্বপ্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। সাধুবাদ ও অভিনন্দন সরকারকে এই লিঙ্গবৈষম্য নিরসনের প্রাথমিক উদ্যোগ গ্রহণের জন্য। আচার্য একজন অধ্যাপককে নিয়োগ না দিয়ে একজন পুরুষ শিক্ষককেও নিয়োগ দিতে পারতেন। আচার্যকেও ধন্যবাদ উচ্চশিক্ষা তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে নারী নেতৃত্বের এ সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। এ দেশের সব ক্ষেত্রের প্রশাসনসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও অন্য সব দেশের মতোই নারীদের উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে একধরনের ‘অদৃশ্য দেয়াল’ কাজ করে। অধ্যাপক ফারহানা ইসলাম উপাচার্য হওয়ায় সেই দেয়াল যেন সরে গেল; তাঁকে জানাই অজস্র অভিনন্দন!
সাধুবাদ বিগত বিএনপি সরকারকেও দিতে হয়। বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম একজন নারী সহ-উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছেন। সর্বপ্রথম একজন নারী শিক্ষককে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। লিঙ্গবৈষম্য নিরসনের এই প্রশংসনীয় উদ্যোগ কেবল আমাদের নারী শিক্ষকদের যোগ্যতারই স্বীকৃতি দেয় না, নারীরা যে সফল নেতৃত্ব দিতে পারেন, তাও প্রমাণ করেছে। অধ্যাপক ড. জিন্নাতুন্নেছা তাহমিদা প্রথম সহ-উপাচার্য এবং পরবর্তী সময়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রথম নারী চেয়ারম্যান। এবং তিনি এ ক্ষেত্রেও অন্য অনেকের চেয়ে সফল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করতে হলে নারী-পুরুষ সব শিক্ষককেই সমযোগ্যতার অধিকারী হতে হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচ্চ পদে নারী শিক্ষকদের যোগ্যতা বিবেচনার ক্ষেত্রে এই একুশ শতকেও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা প্রবল। ৯৩ বছরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নারী শিক্ষক নিয়োগ তো দূরের কথা, ভিসি নির্বাচন প্যানেলে নারী শিক্ষক মনোনয়ন দেওয়া হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির যাঁরা খুব সক্রিয় নন, তাঁদের মধ্যেও এই লিঙ্গবৈষম্য না ভাঙার মনোবৃত্তি আছে। শিক্ষা প্রশাসন, বিশেষত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন পরিচালনা অতি জটিল কাজ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা দেখিয়ে দিচ্ছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসকেরাসহ সরকারকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিছুদিন আগের বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক, একাডেমিকসহ নানা কার্যক্রমের অচলাবস্থা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
কৌশলগত কারণে বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয় না বা অদূর ভবিষ্যতেও হবে না, এ কথা সবাই জানেন। কিন্তু তাতে কি প্রমাণিত হচ্ছে যে নারীরা প্রশাসক এবং নেতা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে পারবেন না? তাঁরা অসফল হবেন? যে দেশে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদের স্পিকার, স্বরাষ্ট্র, কৃষি, পররাষ্ট্র, মহিলা ও শিশু, শ্রম ইত্যাদি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব নারীরা পালন করতে পারেন, সে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন চালানো কি নারীর পক্ষে অসম্ভব? সফল নারী নেতৃত্বের এ রকম উদাহরণ সারা পৃথিবীতে কোথাও নেই। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এই এক ব্যতিক্রম। এ দেশে লিঙ্গবৈষম্য নিরসনের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তা নিরসনের জন্য আরও পদক্ষেপ নিতে হবে।
পরিশেষে আমার একটি বিশেষ প্রস্তাব: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের মতো ‘বিশ্ববিদ্যালয় নারী শিক্ষক ফেডারেশন’ তৈরি করা যেতে পারে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষকেরাই ‘নারী শিক্ষক সমিতি’ গঠন করতে পারি। এগিয়ে নিতে পারি ‘অদৃশ্য দেয়াল’ (যা চরম প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে) ভাঙার ক্ষেত্রে নানা পদক্ষেপ। প্রমাণ করতে পারি, আমরাও পারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সফল নেতৃত্ব দিতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিরাপদ জ্ঞানচর্চা, জ্ঞান সঞ্চালন ও জ্ঞান সৃষ্টির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে। সরকারি তথা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষককে লিঙ্গবৈষম্য নিরসনের সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।

সালমা আখতার: অধ্যাপক ও সাবেক পরিচালক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।