দ্বিতীয় তরঙ্গের ঝাপটা একটু কমতে না কমতেই করোনার বিরুদ্ধে আরও একবার জয় ঘোষিত হলো। ঘোষণা করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। অথচ দেশে এখনো দৈনিক সংক্রমণ লাখ দেড়েক। প্রাণ হারাচ্ছেন দুই-আড়াই হাজার। প্রতিদিন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এত দিন নিস্তরঙ্গ দেশ শাসনের পর নরেন্দ্র মোদিকে এই প্রথম চিন্তিত লাগছে। পারিষদবর্গ তো বটেই, সরকারের সার্বিক আচরণেও তা স্পষ্ট। সেই অস্বস্তি কাটাতেই কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই নির্ঘোষ?
সাড়ে ছয় বছরে যা অদৃশ্যমান, কিছুদিন হলো তা বেড়েছে। বিরোধীদের সমালোচনা তীব্রতর হয়েছে। রাজনীতির পরিসরের বাইরে যুক্ত হয়েছে সমাজ। সমর্থকেরাও ভাবছেন, যা হচ্ছে সব মঙ্গলজনক তো? সোশ্যাল মিডিয়ার এমন বিরুদ্ধাচরণ আগে দেখা যায়নি। আদালতও অতি সক্রিয়। যাবতীয় সরকারি যুক্তি অগ্রাহ্য করে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট যে ধরনের মন্তব্য করছেন, তা প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি ও সরকারের সাফল্যের সেরা বিজ্ঞাপন নয়।
মনমোহন সিংয়ের দ্বিতীয় দফার অবস্থানের সঙ্গে মোদি-জমানার এই সময়কার মিল খুব। দুজনকেই সামাল দিতে হয়েছে ও হচ্ছে ‘অনিয়ম’, ‘অপশাসন’ ও প্রশাসনিক ‘নির্লিপ্ততার’ অভিযোগ। দুই প্রধানমন্ত্রীই এই সময়ে বিপন্ন বোধ করেছিলেন। তবে অমিলও আছে। মনমোহন সিংয়ের বিরুদ্ধাচরণকারীরা দলে ভারী ছিলেন। তুলনায় মোদির বিরুদ্ধপক্ষ ছন্নছাড়া। অমিল বিরোধিতার চরিত্রেও। মনমোহন সরকারের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিল দুর্নীতি ও ‘পলিসি প্যারালাইসিস’–এর। মোদির বিরুদ্ধে অভিযোগ দুর্নীতিকেন্দ্রিক নয়। অভিযোগ ‘অপশাসনের’। ‘একদর্শী’ শাসনের। বিরোধীদের ‘গুরুত্ব না দেওয়ার’। ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নষ্টের’। এবং অবশ্যই কোভিড নিয়ন্ত্রণে ‘চূড়ান্ত ব্যর্থতার’।
কোভিড ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার অঙ্গ সরকারের টিকানীতি; এত দিন তারা যা গায়ে মাখেনি। তুমুল আত্মবিশ্বাসী প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদের বিন্দুমাত্র কলকে না দিয়ে একা হাতে সব সামলাচ্ছিলেন। বাদ সাধে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনী ফল। ক্ষমতা দখলের স্বপ্নে বুঁদ থাকা বিজেপি ধরাশায়ীই শুধু হলো না, কাণ্ডজ্ঞানও হারাল। সেই সুযোগে দ্বিগুণ তেজে সরকারকে চেপে ধরেছে বিরোধীকুল। কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গ লাগামছাড়া হওয়ায় সমালোচনার পালে বাড়তি হাওয়া জুগিয়েছেন আদালত। সরকারকে এখন নীতি বদলে টিকাকরণের পূর্ণ দায়ভার গ্রহণ করতে সুপ্রিম কোর্ট বাধ্য করেন কি না, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল আকর্ষণ।
সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য খুবই কড়া। বিচারপতিরা বলেছেন, সরকারের টিকানীতি ‘খামখেয়ালি’ ও ‘অযৌক্তিক’। কেন দেশের নাগরিকদের টিকাকরণের দায় কেন্দ্রীয় সরকার নেবে না, সে প্রশ্ন তুলে বিচারপতিরা টিকার জন্য বরাদ্দ ৩৫ হাজার কোটি রুপি খরচের হিসাব দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন। কোন টিকার কত বরাত, কবে তা দেওয়া হয়েছে, কী দামে, কবে সেই টিকা মিলবে, শহর ও গ্রামের কত মানুষ কত টিকা পেয়েছে—কেন্দ্রকে সব জানাতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি নীতিগত। কেন দেশের সবার টিকার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকার নেবে না? কেন একটা বড় দায় রাজ্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হবে? দাম কেন একেক রকম?
যাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘বিশ্বগুরু’ হতে চান, সেই দেশগুলোর নেতারা কিন্তু সবাই নাগরিকদের টিকাকরণের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ইউরোপের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দেশগুলো ছাড়াও সেই দায়ভার নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে উৎসাহ ভাতাও দেওয়া হচ্ছে। টিকা নাও, ডলার পাও। কানাডা, ব্রিটেন, সিঙ্গাপুর, মায় ব্রাজিলেও টিকার সব খরচ সরকারের। এমনকি ঘরের পাশে বাংলাদেশেও! এটাও এক অর্থনৈতিক তত্ত্ব। সরকার খরচটা করছে নাগরিকদের সুস্থ রাখতে, যাতে দেশের অর্থনীতি সচল থাকে। ভারতের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে যেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে কিছু না হলেও ২০ শতাংশ মানুষের বাস, সেখানে সরকার খরচ না জোগালে গরিব মানুষ টিকাই নেবে না। তারা অসুস্থ হবে, সম্পন্নদেরও অসুস্থ করবে। অতএব দেশের স্বার্থেই সরকারের ব্যয় বহন করা দরকার। কোন যুক্তিতে কে জানে, মোদি সরকার বিনা পয়সায় সবাইকে টিকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও পিছিয়ে এসে রাজ্যের ঘাড়ে একটা বড় দায় চাপিয়ে দিয়েছে। এখন দেখার, সুপ্রিম কোর্ট কী বলেন।
সন্দেহ নেই, কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গে প্রধানমন্ত্রী অনেকাংশেই বেআবরু। টিকার দাতা এখন গ্রহীতা। পরমুখাপেক্ষী। কোভিডের মাশুল গুনতে হচ্ছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্তরে। গত এপ্রিল ও মে মাসে বেকারত্বের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়াজ ইকোনমি’ (সিএমআইই) জানিয়েছে, গত দুই মাসে ভারতে কাজ হারিয়েছেন ২ কোটি ২৭ লাখ শ্রমিক-কর্মী। ৯৭ শতাংশ পরিবারের মাসিক আয় কমেছে। রোজগার বেড়েছে মাত্র ৩ শতাংশ পরিবারের, বিরোধীদের চোখে ‘সরকার যাদের স্বার্থ রক্ষা করে’। সিএমআইই এই সমীক্ষা চালিয়েছে ১ কোটি ৭৫ লাখ পরিবারের সঙ্গে কথা বলে।
এ পরিস্থিতিতে সরকার কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বিরোধী মহল ও আদালতের পাশাপাশি চাপ বেড়েছে দলেও। অসন্তোষ মাথাচাড়া দিচ্ছে। বিশেষ করে উত্তর প্রদেশে। এই রাজ্যে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চে বিধানসভার ভোট। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের কাজের স্টাইলে অনেকেই রুষ্ট। গোদের ওপর বিষফোড়া মাত্রাছাড়া কোভিড সংক্রমণ ও চরম অব্যবস্থা। কৃষক অসন্তোষেও উত্তর ভারত জেরবার। সব মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি এই প্রথম কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি।
কথায় বলে, বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক দু-একটি সিদ্ধান্ত সে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের নারদ মামলায় গ্রেপ্তার ও রাজ্যের মুখ্য সচিবকে শোকজ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির পায়ের তলার জমি ঝুরঝুর করে তুলছে। প্রাধান্য পাচ্ছে ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’। শোরগোল তুলেছে অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের মুখ বন্ধ রাখতে কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া ফরমানও, যাতে বলা হয়েছে, দেশের নিরাপত্তা, সংহতি, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে যুক্ত অবসরপ্রাপ্ত আমলারা কোনো স্পর্শকাতর ঘটনার কথা বিনা অনুমতিতে বলতে বা লিখতে পারবেন না। তেমন করলে পেনশন আটকে যাবে। ঘটনা স্পর্শকাতর কি না, সরকারি কর্তারাই তা ঠিক করবেন।
লোকসভা ভোটের এখনো তিন বছর বাকি। সেটা স্বস্তির। অস্বস্তির খচখচানি উত্তর প্রদেশে। কোভিড-ক্ষত কতটা গভীর, উত্তর প্রদেশই তা দেখাবে। উতরে গেলে এক রকম, না হলে ছন্নছাড়া বিরোধীকুলও শান্তিতে থাকতে দেবে না। নরেন্দ্র মোদির কাছে ‘সে বড় সুখের সময় নয়, সে বড় আনন্দের সময় নয়’।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি