ভূমি প্রশাসন

নতুন বছরের প্রত্যাশা

বাংলাদেশের মানুষের কাছে একখণ্ড ভূমি এখন সাত রাজার ধন। ১৯৫২ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল যেখানে সাড়ে চার কোটি, ১৯৭১ সালে তা দাঁড়ায় সাড়ে সাত কোটিতে। বর্তমানে তা প্রায় ১৬ কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। ৪২ বছরে দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হলেও আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে এক-তৃতীয়াংশ।
দ্রুত নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও উন্নয়ন ভূমির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করায় এ নিয়ে বিরোধ বাড়ছে দিন দিন। ভূমিদস্যু ও টাউট-বাটপারদের কাছে অনেকে ভূমির মালিকানা হারাচ্ছে। ভূমি আইন ও বিধিবিধান সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতায় মানুষ সংকটে পড়ছে। নানা কায়দাকৌশল কিংবা জোর জবরদস্তির মাধ্যমে ভূমি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। ভূমি অফিস থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ড হারিয়ে যাওয়ায় অসাধু লোকজন মূল্যবান সরকারি জমির মালিক হয়েছে। দেশের ৮০ শতাংশ মামলা ভূমিবিরোধকে কেন্দ্র করে।
ভূমি আইনকানুন ও বিধিবিধানগুলো ব্রিটিশ আমল থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। ভূমি অফিসে নামজারির জন্য কত মাস অপেক্ষা করতে হবে, প্রার্থিত খতিয়ান বা পর্চা কখন হাতে পৌঁছাবে, ভূমি রাজস্বের সঠিক পরিমাণ কত হবে—অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব প্রশ্নের সদুত্তর ভূমি কর্মকর্তারা দিতে পারেন না।
ভূমি প্রশাসনসংক্রান্ত আইনকানুন ও বিধিবিধান মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নের মৌলিক দায়িত্ব সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদের ক্যাডার কর্মকর্তাদের। তাঁদের সততা ও নৈতিকতার ওপর নির্ভর করে দুর্নীতি ও হয়রানিমুক্ত ভূমি প্রশাসন। শুধু রাজস্ব আদায়ই সহকারী কমিশনারদের একমাত্র দায়িত্ব নয়। তার চেয়েও মৌলিক দায়িত্ব হলো, ভূমির সঠিক মালিকানা নিশ্চিত করা, মালিকানা পরিবর্তনের পর রেকর্ড সংশোধন করা, যথাসময়ে নামজারি সম্পাদন, ভূমির অপদখল ও অপব্যবহার রোধ করা, ভূমির ইজারা প্রদানে দুর্নীতি রোধ, খাসজমি ও অর্পিত সম্পত্তি সঠিক ব্যবস্থাপনায় আনা, সঠিকভাবে ভূমিহীন বাছাই, রেকর্ড রেজিস্ট্রার নির্ভুলভাবে সংরক্ষণ এবং সরকারি জমি রক্ষায় সাহসী ভূমিকা পালন।
দেশের উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের ভূমি অফিসগুলো অধিকাংশই মাটির ঘর, টিনের ঘর কিংবা সেমি পাকাঘর। চাকচিক্যবিহীন অফিসগুলো শ্যামল ছায়ায় ঘেরা। গ্রামীণ ঐতিহ্য এবং প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম, সঙ্গে আছে মানুষের দুঃখ ও কান্না। এক কথায় সুশাসনের প্রকট সংকট, তথাপি কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়ার জন্য মানুষের আকুতি। হয়রানিমুক্তভাবে কাজ সমাধা হলে অন্তর থেকে দিয়ে যায় আশীর্বাদ, নতুবা অভিশাপ।
ভূমি নিয়ে মানুষের ভোগান্তির মূল ক্ষেত্রগুলো হলো রেকর্ডিংয়ে ত্রুটি, নামজারিতে হয়রানি, খাসজমি বন্দোবস্ত এবং অর্পিত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, ভূমি রাজস্বের দাবি নির্ধারণে গরমিল এবং রাজস্ব আদায়ে ফাঁকি, খতিয়ানে ভুল তথ্য সন্নিবেশ, খতিয়ানের পাতা বিনষ্ট করা, বেআইনিভাবে জমির শ্রেণী পরিবর্তন, অকৃষিজমিকে কৃষিজমি হিসেবে দেখানো, একজনের জমি অন্যের নামে রেকর্ড করা, সরেজমিনে তদন্ত ছাড়াই নামজারির প্রতিবেদন তৈরি, রেকর্ড রুমে হয়রানি, মালিকানা পরিবর্তন হলেও আগের মালিকের নামে রেকর্ড বহাল রাখা, এলটি নোটিশমূলে নামজারি না করা, রাজস্ব আদায়ের পর ভলিউমে এন্ট্রি না করা ইত্যাদি।
ভূমি অফিসে এসে অনেক ক্ষেত্রে মানুষ দুর্ব্যবহারের শিকার হয়। এ বৈরী আচরণ সুশাসনের পথে অন্তরায়। অথচ ভূমি প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভূমির মালিক হিসেবে নিজেরাই যখন ভুক্তভোগী হয়ে হয়রানির শিকার হন, তখন তাঁরা বুঝতে পারেন, এ কষ্টের মাত্রা কত ব্যাপক! সুতরাং সাধারণ মানুষের কষ্টের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করতে পারলে হয়রানির জালে বন্দী ভূমি মালিকদের উদ্ধার করা সম্ভব হবে। ভূমি অফিসে মানুষের প্রবেশ সহজ করে দিতে হবে। ১৯৭৪ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ বিলুপ্ত হয়, পঞ্চাশের দশকে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হয়। সুতরাং মানুষের অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
ভূমির মালিকদের যন্ত্রণা উপলব্ধি করার মানসিকতা ও দূর করার কঠোর প্রত্যয় সহকারী কমিশনারদের থাকতে হবে। ভূমির মালিকদের মুখে হাসি ফোটানো তাদের নৈতিক দায়িত্ব। ভূমি প্রশাসনে দুর্নীতি নির্মূলে যে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা, তা ভাঙতে এগিয়ে আসতে হবে সহকারী কমিশনারদের (ভূমি)। জনগণের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে উদাসীন থাকা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার সমান অপরাধ। দালালদের তাড়িয়ে সরাসরি জনগণকে সেবা দিয়ে মুছে দিতে হবে মানুষের ভোগান্তির ক্ষত ও যন্ত্রণা। ভূমি আইনকানুনগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
ভূমি প্রশাসনকে দুর্নীতির জাল থেকে বের করে আনতে হলে নিজের চিন্তাচেতনাকে শুদ্ধ এবং দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছতা প্রমাণ করতে হবে সহকারী কমিশনারদের। সৎ থাকার জন্য অধীন ব্যক্তিদের শপথ করাতে হবে। দুর্নীতির দুর্গ ভেঙে দিতে পারলে সৎ প্রশাসনের প্রতি মানুষের আস্থা তৈরি হয়ে যাবে, অধীন ব্যক্তিরাও বড়কর্তার সততার সঙ্গে নিজেদের অভিযোজন করে নিতে সক্ষম হবেন। একজন সৎ কর্মকর্তা থেকে অনুপ্রাণিত হবেন আরও ১০ জন, যার প্রভাব পড়বে পুরো অফিসে। ন্যায়ের দণ্ড সমুন্নত রাখলে দুর্নীতিপরায়ণেরা দুর্বল হয়ে যাবে। ভূমি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ‘মিশন হোক জনসেবা’ ও ‘ভিশন হোক ভূমি ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা’। জীবনের একমাত্র অবলম্বন ভূমি নিয়ে মানুষ সুস্থ ও সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে চায়—ভূমি অফিসকে জবাবদিহিমূলক করে ভূমির মালিকানা রক্ষার নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত করতে হবে—২০১৪ সালে এ প্রত্যাশা রইল সহকারী কমিশনারদের কাছে।
মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: সাবেক এসি (ল্যান্ড) ও এডিসি (রাজস্ব), বর্তমানে এমডি, মিল্ক ভিটা।
mmunirc@gmail.com