মতামত

ধর্ষণের বিচার হওয়া উচিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে

অলংকরণ : মাসুক হেলাল

নারী ও শিশুর প্রতি নির্যাতন বন্ধের জন্য আমাদের একাধিক আইন আছে; আইনে অত্যন্ত কঠোর শাস্তির বিধান করা হয়েছে; আলাদা বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে দেওয়া হয়েছে। এত কিছু সত্ত্বেও কোনো কিছুই ধর্ষকামী অপরাধীদের ভীত করতে পারছে না; বরং আরও অনেক ধর্ষক অপরাধ করার সাহস করছে। এতে এটা স্পষ্ট যে বর্তমান আইনি কাঠামো এসব অপরাধপ্রবণতা দমনে কার্যকর হচ্ছে না।

ধর্ষণ বন্ধে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শক্ত অবস্থান নেওয়া প্রয়োজন এবং আইনি কাঠামোতে তার প্রতিফলন জরুরি। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করছেন, কিন্তু সেখানেও ধর্ষণের বিচারে আলাদাভাবে নজর দিতে হবে এবং আরও দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা বেশি এমন কয়েকটি জেলায় একাধিক নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। এই একাধিক ট্রাইব্যুনালের মধ্যে যেকোনো একটি ট্রাইব্যুনালকে সংশ্লিষ্ট জেলার ধর্ষণের মামলা নিষ্পত্তির জন্য বিশেষায়িত ট্রাইব্যুনাল হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এই বিশেষায়িত ট্রাইব্যুনালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় আনা শুধু ধর্ষণের মামলাগুলোরই নিষ্পত্তি হবে। মামলার সংখ্যা কম হওয়ায় যে জেলাগুলোতে একটিই ট্রাইব্যুনাল রয়েছে, সেখানে ওই ট্রাইব্যুনালকে সপ্তাহের নির্দিষ্ট কয়েকটি দিন ধর্ষণের মামলার বিচারের জন্য বিশেষায়িত ট্রাইব্যুনাল হিসেবে ঘোষণা করা যেতে পারে।

এ জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে নতুন বিধিমালা তৈরির প্রয়োজন হবে; সেখানে দ্রুত বিচারপদ্ধতি, বিচারকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহির ব্যবস্থা ও বিশেষায়িত ট্রাইব্যুনালের পরিবর্তিত এখতিয়ার নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। এই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ধর্ষণের প্রতিটি মামলার অগ্রগতি পৃথকভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে। কোন মামলা কোন পর্যায়ে রয়েছে; কোনো মামলা নির্দিষ্ট সময়ে শুনানি না করা গেলে কেন করা যাচ্ছে না; কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির বিশেষ গাফিলতি রয়েছে কি না—এসব বিষয়ে জবাবদিহির ব্যবস্থা করা সহজ হবে।

এই জবাবদিহি নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারী নির্যাতনের বিচারব্যবস্থায় অদক্ষতা আর অনিয়মের যে অভিযোগ রয়েছে, সেসব গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা প্রয়োজন। জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিষয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনেই একটি বিধান রয়েছে। ধারা ৩১ ক অনুযায়ী, আইনের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না করা গেলে ট্রাইব্যুনাল, সংশ্লিষ্ট পাবলিক প্রসিকিউটর ও পুলিশ কর্মকর্তাকে ৩০ দিনের মধ্যে একটি লিখিত প্রতিবেদন সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করতে হবে; এর একটি কপি সরকারের কাছেও পেশ করতে হবে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করার পর বিলম্বের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তবে ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষ’ বলতে কাকে বোঝানো হচ্ছে, তা বলা হয়নি।

এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টে প্রতিবেদনটি কীভাবে দাখিল করা হবে বা কীভাবে তা পর্যালোচনা করা হবে, তা-ও অস্পষ্ট। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে জড়িত অনেকেই জানিয়েছেন, বাস্তবে এই ধারার প্রয়োগ নেই বললেই চলে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের যেকোনো ধারার প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য বিধি তৈরির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে আইনটিতে, কিন্তু এখন পর্যন্ত আইনটির অধীনে কোনো বিধিমালা তৈরি করা হয়নি। জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের এই ক্ষমতাকে বিধি দ্বারা সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন, যাতে করে বিশেষায়িত ধর্ষণ দমন ট্রাইব্যুনাল চিহ্নিত হলে অন্তত ধর্ষণের ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াটি চালু করা যায়।

ধর্ষণের বিচারে জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা গঠিত একটি পৃথক মনিটরিং কমিটির কথাও ভাবা যেতে পারে। প্রধান বিচারপতির আদেশে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির অধীনে এই বিশেষ মনিটরিং কমিটি গঠিত হতে পারে। এর উদ্দেশ্য হবে ধর্ষণের বিশেষায়িত ট্রাইব্যুনালের কার্যকারিতা নিরীক্ষণ করা এবং ধর্ষণবিষয়ক আইনি কাঠামো সার্বিকভাবে পর্যালোচনা করা। ধর্ষণের বিশেষায়িত ট্রাইব্যুনাল থেকে প্রাপ্ত যাবতীয় প্রতিবেদন, তথ্য-উপাত্ত পর্যবেক্ষণ করে এই কমিটি প্রধান বিচারপতিকে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়কে পদ্ধতিগত বা আইনি কাঠামোগত পরিবর্তনের বিষয়ে সুপারিশ করতে পারে। এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো সুপারিশ বিবেচনার সময় কমিটি বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ করবে এবং ধর্ষণের মামলার প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বা প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করবে।

ধর্ষণ বন্ধে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শক্ত অবস্থান নেওয়া প্রয়োজন এবং আইনি কাঠামোতে তার প্রতিফলন জরুরি। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করছেন, কিন্তু সেখানেও ধর্ষণের বিচারে আলাদাভাবে নজর দিতে হবে এবং আরও দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে

ধর্ষণের আইনি কাঠামোয় কার্যকর পরিবর্তন আনতে হলে প্রয়োজন ধর্ষণসংক্রান্ত আইনগুলোর আধুনিকীকরণ এবং লিঙ্গসংবেদনশীল পরিবর্তন। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণীত হয়েছে; কিন্তু আমরা ধর্ষণের সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে রয়ে গেছি ১৮৬০ সালের ব্রিটিশদের তৈরি ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে। বিশ্বের বহু দেশে যৌন অপরাধ আর ধর্ষণকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, আমরা তার থেকে অনেক পিছিয়ে আছি।

ধর্ষণের সংজ্ঞা শুধু নয়, ধর্ষণের শিকার নারীকে আদালতে কী ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন করা যাবে এবং কী করে তাঁর সম্মানহানি না করে বিচারকার্য চালানো যাবে, সেই বিষয়ক আইনগুলোও বিশ্বের অন্যান্য দেশে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কিন্তু আমরা একইভাবে সেই ব্রিটিশ আইনপ্রণেতাদের তৈরি ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন নিয়েই পড়ে আছি। সেখানে স্পষ্ট করা রয়েছে, একটি ধর্ষণের মামলায় দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারী নারী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্র, যা কিনা তাঁর অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতাকে দুর্বল করতে পারে।

আইনি কাঠামো কার্যকর করতে হলে ধর্ষণের ক্ষেত্রে আইন ও বিচারব্যবস্থার এই গলদগুলো খতিয়ে দেখে শুধরাতে হবে। সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে আইন ও বিচারব্যবস্থার সব স্তরে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন যে ধর্ষণের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র শক্ত অবস্থান নিতে চায়। কেননা আইন যতই ঢেলে সাজানো হোক না কেন, তার কার্যকর প্রয়োগের জন্য আইন প্রয়োগকারীদের ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির প্রতি সংবেদনশীলতা থাকতে হবে; বিচারিক দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। বিচার নিশ্চিত না করা গেলে ধর্ষকেরা সংখ্যায় বাড়বেই শুধু, আর নারীর পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগের যুদ্ধটা হবে কঠিন থেকে কঠিনতর।

তাসলিমা ইয়াসমীন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও গবেষক

taslima47@yahoo.com