নিজের জন্মভূমিকে ধনধান্য পুষ্পভরা বসুন্ধরা হিসেবে কল্পনা করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। এ দেশের প্রকৃতির ভান্ডারের বিবিধ রত্নে উল্লসিত হয়েছিলেন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়তায় গড়ে উঠেছে জীবন ও জনপদ। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, ওষুধ, খাওয়ার পানি, জ্বালানি, দৈব-দুর্বিপাকে আশ্রয় হিসেবে মানুষ প্রকৃতির ওপরই নির্ভর করে চলেছে। আবার প্রকৃতিকে লোকজ ও সহজাত কায়দায় লালন ও পালন করেছে।
প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা মাছ বিশ্বের প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের প্রাণিজ আমিষের ২০ শতাংশ পূরণ করছে। ৮০ শতাংশেরও বেশি খাদ্য আসে গাছপালা থেকে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত ৮০ শতাংশ মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য বনজ ওষুধের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে স্থলজ পরিবেশের তিন-চতুর্থাংশ এবং সামুদ্রিক পরিবেশের প্রায় ৬৬ শতাংশে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন হয়েছে। ফলে বিশ্বে প্রায় ১০ লাখ প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি এখন বিলুপ্তির হুমকিতে।
বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস সাধন, জলবায়ু পরিবর্তন ও কোভিড-১৯ অতিমারির মতো নতুন রোগ মোকাবিলায় বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবসটির গতবারের প্রতিপাদ্য ছিল—‘প্রকৃতিতেই রয়েছে আমাদের সমাধান’। তারই ধারাবাহিকতায় এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘আমরাও সমাধানের অংশ’। এবারের প্রতিপাদ্যও বাংলাদেশের মানুষের সহজিয়া ও লোকজ কায়দায় প্রকৃতি এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অনাদিকালের প্রচেষ্টার অনুরণন। দেখা যাক কীভাবে প্রকৃতি মানুষকে রক্ষা করে চলেছে এবং বিপরীতে মানুষ প্রকৃতিকে রক্ষা করছে না ধ্বংস করছে!
এককভাবে সুন্দরবন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভাসমান ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলীয় বন। একই সঙ্গে বন, জলাভূমি, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত বন পৃথিবীতে বিরল। বঙ্গোপসাগরের উপকূলে সুন্দরবনের অবস্থান ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়গুলোর তীব্রতা অনেকাংশে কমিয়ে দেওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে সুন্দরবন একটি ঢাল। বাংলাদেশ অংশের বঙ্গোপসাগর চোঙার (ফানেল) মতো হওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা ঢের বেশি। তীব্র বাতাস সাগরের পানিকে ঠেলতে থাকে, ফুঁসে ওঠা পানি চোঙা বরাবর তীব্র বেগে উপকূলে আঘাত হানে। আবহাওয়াবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড’-এর তথ্য অনুসারে বিশ্বের ৩৫টি সবচেয়ে ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ২৬টিই বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট।
রামপাল কয়লাভিত্তিক প্রকল্প এলাকায় মাত্র সাত বছরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার একর সবুজ জমি বালু দিয়ে ভরাট করে ধূসর ভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। গত চার বছরে ছয়টি ঘটনায় সুন্দরবনের নদ-নদীতে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন কয়লা ডুবেছে। কয়লার রাসায়নিক উপাদান নদীর পানিকে বিষাক্ত করে পরিবেশের ও বনজীবীদের জীবিকা মারাত্মক হুমকিতে ফেলছে।
মানবসৃষ্ট চাপ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। আন্তদেশীয় নদীতে উজানের দেশ কর্তৃক বাঁধ নির্মাণের কারণে ভাটির নদীগুলোয় পানিপ্রবাহ কমে পলি জমেছে এবং নদী ভরাট হয়ে পড়ছে। পলি জমে সুন্দরবনের ভূমির (ফরেস্ট ফ্লোর) উচ্চতা দেড় থেকে ২ ফুট বেড়ে যাওয়ায় জোয়ারের পানি ঢুকতে পারছে না। শ্বাসমূলের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস ও বংশবিস্তার ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে উঁচু হওয়া অঞ্চলে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন প্রজাতির গাছ বাড়ছে। জোয়ারের পানি আসতে না পারায় পাতা ও গুল্মের পচন হচ্ছে না। তা শুকিয়ে প্রায় প্রতিবছরই অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। গত দুই দশকে আগুন লেগেছে প্রায় ২৪ বার এবং অন্তত ৮২ একর বনভূমির গাছপালা পুড়েছে। উজানে দেওয়া ফারাক্কাসহ অন্যান্য বাঁধের কারণে মিঠাপানি কমে গিয়ে পানির লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বনে লবণাক্ত পানির প্রবেশ বেড়েছে। বাণিজ্যিকভাবে চিংড়ি চাষের কারণে মাটিতে লবণাক্ততার আগ্রাসনে সুন্দরীর মতো কম লবণসহিষ্ণু গাছ মরতে বসেছে। এ ছাড়া উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয় জেলেরা জানিয়েছেন, পটুয়াখালীর গলাচিপায় সম্প্রতি শ্বাসমূলীয় ছয়টি বনে কমপক্ষে ২০টি খালে বাঁধ ও কীটনাশক ছিটিয়ে অবৈধ মাছ শিকার চলছে। বাঁধ দেওয়ায় জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিকতা বিনষ্ট হচ্ছে। শ্বাসমূলীয় বনে পানিপ্রবাহ না থাকলে গাছও প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। একইভাবে কীটনাশকমিশ্রিত পানি ভাটার টানে নদীর দিকে যাওয়ায় মাছও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বনে পরিবেশগত দিক থেকে সংকটজনক এলাকার মধ্যে বাণিজ্যিক ও ‘উন্নয়ন’ কর্মকাণ্ড বাড়ায় জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থান নষ্ট হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, রামপাল কয়লাভিত্তিক প্রকল্প এলাকায় মাত্র সাত বছরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার একর সবুজ জমি বালু দিয়ে ভরাট করে ধূসর ভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। গত চার বছরে ছয়টি ঘটনায় সুন্দরবনের নদ-নদীতে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন কয়লা ডুবেছে। কয়লার রাসায়নিক উপাদান নদীর পানিকে বিষাক্ত করে পরিবেশের ও বনজীবীদের জীবিকা মারাত্মক হুমকিতে ফেলছে।
বিপরীতে বনজ সম্পদ আহরণে নির্দিষ্ট লোকজ ও ঐতিহ্যগত জ্ঞান ব্যবহারের মাধ্যমে বনজীবীরা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। যেমন, সুন্দরবনের মৌয়ালরা এপ্রিল, মে ও জুন মাসে মৌচাকের একটি নির্দিষ্ট অংশ (প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ) কেটে বাকি অংশ পরবর্তী প্রজননের জন্য রেখে দেন। ধাতব সরঞ্জাম ব্যবহার না করে হাত দিয়ে এবং আগুন না লাগিয়ে শুধু শুকনো পাতা দিয়ে ধোঁয়া তৈরি করায় অল্পবয়স্ক মৌমাছি মারা যায় না এবং মৌচাকটি পুনরায় ব্যবহার করা যায়।
কৃষক, জেলেসহ অগণিত মানুষ জলজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। নদীকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠেছে। খুব কম দেশেই ২৪ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ নদী বয়ে গেছে। এ ছাড়া হাওর, বাঁওড়, বিল ও ঝিল নিয়ে মোট ৩৭৩টি জলাভূমির আয়তন ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৪৬০ হেক্টর।
বর্তমানে মুক্ত জলাশয়—যেমন নদী-খালে মাছ আহরণ মোট উৎপাদিত মাছের এক-চতুর্থাংশে নেমেছে। গত প্রায় এক দশকে হাওর অঞ্চলের ১৪০ প্রজাতির মাছের মধ্যে প্রায় ৬২ প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। এর মধ্যে সুস্বাদু পাঙাশ, সরপুঁটি, রিঠা, মহাশোল, একথুটি, বামোশ, বাঘাড়, পিপলা, তিলা শোল, ঘাউড়া, বাচা, বাটা, কালিয়া, ঘইন্যা, শাল বাইম, কুমিরের খিল, গুইজ্জা, চিতল, নান্দিনা, ঘোড়া মুইখ্যা, রানি, চাকা, গজার, কাশ খাউড়া, কালাবাটা, নেফতানি, ডানকুনি, ঢেলা, বিষতারা, শিলং, গুজি আইড়, ছেপ চেলা ও রায়েক, কানি পাবদা, মধু পাবদা, পাবদা প্রধান।
ক্ষমতাশালীদের নদী ও জলাভূমি দখল অব্যাহত রয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৭৭০টি নদীর জমি দখল করেছে ৫৭ হাজার ৩৯০ ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান। প্রাকৃতিক জলাধারে সরকারের অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ ও ভরাটে এবং ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পের ফলে নদীপথ পরিবর্তিত হচ্ছে। অনেক নদীর প্রবাহ কমে গিয়ে বাস্তুসংস্থানের জীববৈচিত্র্য ও মানুষের জীবনযাত্রার ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
বেশির ভাগ নদী ও জলাভূমি সুরক্ষিত নয়। নদী ও জলাভূমিগুলো সংরক্ষণ করলে বাস্তুসংস্থানের ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, মা ইলিশ সংরক্ষণে সরকার ছয়টি অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইলিশের উৎপাদন অনেক বেড়েছে। অন্যান্য বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণ বা অভয়াশ্রম গড়ে তোলা গেলে বিভিন্ন মাছের উৎপাদনও বাড়বে। নিশ্চিত হবে অগণিত মানুষের জীবিকা।
বঙ্গোপসাগরে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি রাষ্ট্রীয় বা টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশ পর্যন্ত বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানা।
এ বিশাল নীল জলরাশিতে তেল, গ্যাস, বিভিন্ন খনিজ সম্পদসহ বিচিত্র সামুদ্রিক প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদ রয়েছে। দেশের স্থলভাগে যে পরিমাণ সম্পদ বিদ্যমান, তার প্রায় সমপরিমাণ (৮১ শতাংশ) সম্পদ রয়েছে সমুদ্রের তলদেশে। এখানে প্রায় ৫০০ প্রজাতির মাছ, ২০ প্রজাতির কাঁকড়া, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৩০০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক পাওয়া যায়। বঙ্গোপসাগরের সংরক্ষিত অঞ্চল সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে নানা জাতের মাছের পাশাপাশি আছে বিশাল তিমি, ডলফিন, হাঙর, কচ্ছপ আর বিরল প্রজাতির জলজ প্রাণী।
কিন্তু অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য নির্গমন, অবৈধ ও অপরিকল্পিত সম্পদ আহরণ এবং বিভিন্ন ‘উন্নয়ন’ কর্মকাণ্ডে বঙ্গোপসাগরের বাস্তুসংস্থানও হুমকিতে।
বঙ্গোপসাগর এ অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীর জন্য অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। তেমনি নতুন অস্থিরতা ও আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে বঙ্গোপসাগরের বিপুল সম্পদের সুফল কাজে লাগাতে হলে এ অঞ্চলটিকে ঘিরে টেকসই, সবুজ, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন কৌশলের আলোকে এগোতে হবে। দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনে বহুপক্ষীয় শান্তিপূর্ণ পথে যেতে হবে।
বন স্বাস্থ্যকর বাতাস, পুষ্টিকর খাবার, পরিষ্কার পানি, বিনোদন ইত্যাদির উৎস। উন্নত দেশগুলোতে ওষুধের ২৫ শতাংশ উদ্ভিদ থেকে আসে। আর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই অবদান ৮০ শতাংশের বেশি। বন থেকে বিশ্বব্যাপী ৮৬ কোটিরও বেশি মানুষের কাজের ব্যবস্থা হয়।
বাংলাদেশে বৃক্ষ ও বন থেকে ঔষধি উপকার পেয়ে থাকে ৫৪ শতাংশ পরিবার। দেশের মাটির ওপরের বৃক্ষসম্পদ, মাটির নিচের বৃক্ষসম্পদ এবং মাটির মধ্যে (৩০ সেন্টিমিটার গভীরতা পর্যন্ত) সঞ্চিত কার্বনের পরিমাণ ১২৭ কোটি ৬০ লাখ টন। এ কার্বনের প্রায় ২২ শতাংশ বনাঞ্চলের মধ্যে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ ও অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, কৃষি সম্প্রসারণ ও নগরায়ণে বন ও বনভূমি কমছে। আইনের তোয়াক্কা না করে অবৈধ দখল এবং অতিরিক্ত সম্পদ আহরণে বন ধ্বংস হচ্ছে। ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৫৮ একর বনভূমি দখল হয়ে গেছে। রাজধানী ঢাকায় গাছপালা ক্রমশ কমে কংক্রিটের আচ্ছাদন বাড়ায় সবুজের পরিমাণ মোট আয়তনের মাত্র ৯ দশমিক ২ শতাংশ।
বাংলাদেশে ৪১টি এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। ২২টি সংরক্ষিত বন এলাকায় সরকার, স্থানীয় জনগণ এবং আইইউসিএনের মতো বিভিন্ন সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জনসম্পৃক্ত ‘সহ-ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি’ চালু করায় বাঘ, ঘড়িয়াল, ডলফিন, শকুন ইত্যাদি প্রজাতি সংরক্ষণে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে। বেশি জোর দিতে হবে কমিউনিটি সংরক্ষিত এলাকার ওপর। জনসম্পৃক্ত সম্মিলিত উদ্যোগই আগামীর পথচলা।
সবুজ উৎপাদনব্যবস্থা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিই আমাদের ভবিষ্যৎ। আমাদের জন্য সুখবর হলো দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কিছু উদ্যোক্তা সবুজ প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে। গ্যাস বার্নার থেকে বর্জ্য তাপশক্তি কাজে লাগাতে নতুন তাপ পুনরুদ্ধার প্রযুক্তি গ্রহণ করেছে। সবুজ প্রযুক্তিতে রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে কর্মদক্ষতা বাড়ায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতাও বাড়ছে। টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশে বৃক্ষ ও বন থেকে ঔষধি উপকার পেয়ে থাকে ৫৪ শতাংশ পরিবার। দেশের মাটির ওপরের বৃক্ষসম্পদ, মাটির নিচের বৃক্ষসম্পদ এবং মাটির মধ্যে (৩০ সেন্টিমিটার গভীরতা পর্যন্ত) সঞ্চিত কার্বনের পরিমাণ ১২৭ কোটি ৬০ লাখ টন। এ কার্বনের প্রায় ২২ শতাংশ বনাঞ্চলের মধ্যে।
জীববৈচিত্র্যবিষয়ক আন্তদেশীয় প্রতিবেদন—আইডিবির মতে, মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে ভূপৃষ্ঠের ক্ষয় বিশ্বে প্রায় ৩২০ কোটি মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ভূমি ক্ষয়ের কারণে জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতান্ত্রিক সেবা-পরিষেবা বিনষ্ট হয়ে ক্ষতির পরিমাণ বৈশ্বিক মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশ। ভূমি ক্ষয় রোধ করা ছাড়া বনজ সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
‘মোদের গরব, মোদের আশা’র বাংলাদেশের পথযাত্রায় নতুন চিন্তা, আইন, কৌশল ও বাস্তবায়ন অতীব প্রয়োজনীয়। প্রাণ-প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষ সহাবস্থান করতে চায়। জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থানের বর্তমান নেতিবাচক প্রবণতা রুখতে সক্রিয় তরুণ সমাজ বিজ্ঞানভিত্তিক অভিযোজনের সৃজনশীল কাঠামো দেখতে চায়।
নতুন কাঠামোর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই অভীষ্ট অর্জনে বাংলাদেশের মোট স্থলভূমির ৩০ শতাংশ এবং জলভূমির ৩০ শতাংশের (৩০: ৩০: ৩০) সংরক্ষণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা যেতে পারে। এ জন্য পুরোনো আইনের অনুবাদ নয়, ঔপনিবেশিক বাণিজ্যপ্রধান বন আইন বা পুঁজিস্বার্থ সংরক্ষণকারী আইন পরিবর্তন জরুরি। একইভাবে নদীসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নতুন আইন প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় লোকজ জ্ঞানের সঙ্গে বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের সমন্বয় করে নদী ও জলাভূমিগুলোর লালন ও পালন করতে হবে। আশার কথা, দেশের উচ্চ আদালত নদীকে জীবন্ত সত্তা (লিভিং এনটিটি) হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। এর আলোকে নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রেখে ভারসাম্যপূর্ণ পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করা যেতে পারে। কৃষক, মৎস্যজীবী, বনজীবীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলে সংরক্ষিত এলাকায় সহ-ব্যবস্থাপনা জোরদার হবে। স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্তকরণ ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে কমিউনিটি বন সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার হবে। সবুজ উৎপাদনব্যবস্থা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি নতুন কর্মসংস্থান দেবে। সঠিক পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজন বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যানের। সবচেয়ে দরকার জনগণের কাছে জবাবদিহির। আইনের প্রয়োগ; ক্ষমতাশীলদের আজ্ঞাবহনের নয়। বিপন্ন প্রকৃতি প্রাণ ফিরে পেয়ে জীবনানন্দের রূপসী বাংলায় পরিতৃপ্ত হবে জীবন।
* রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর চেয়ারপারসন। আইইউসিএন এশীয় অঞ্চলের সদস্যদের কমিটির ভাইস চেয়ারপারসন এবং বাংলাদেশের আইইউসিএন জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন।
rt@du.ac.bd