ফজলে হাসান আবেদকে আমি ‘আবেদ ভাই’ বলে ডাকতাম। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক ছোটবেলায়। তাঁর এক চাচা ছিলেন আমার বাবার বন্ধু। সেই সূত্র ধরেই একটা পারিবারিক যোগাযোগ ছিল তাঁদের সঙ্গে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্বাধীনতার পরে। অবশ্য একই সময়ে আমরা ব্রিটেনে ছিলাম। তবে ওখানে তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল না। আবেদ ভাই আইএসসি পাস করে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় চলে যান। প্রথমে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। কিন্তু শিগগির অনুধাবন করেন, দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কিছু করতে হলে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে লেখাপড়া কোনো কাজে আসবে না। তাই তিনি চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিংয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। লেখাপড়া শেষ করে অনেক দিন ব্রিটেনে ছিলেন। তারপর ১৯৬৮ সালে চলে আসেন দেশে। চট্টগ্রামে একটি কোম্পানিতে চাকরির মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপরই তো সেই ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। তখন বিদেশি কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ত্রাণকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আবার দেশের বাইরে চলে যান। বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে ব্রিটেনে গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন জোগাড় করেন। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে কাজ শুরু করেন। তখন থেকেই মূলত ব্র্যাকের যাত্রা শুরু। প্রথম দিকে এর পূর্ণ নাম ছিল বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিস্ট্যান্সি কমিটি। প্রথমে এর কার্যক্রম ছিল, দেশ থেকে যেসব মানুষ যুদ্ধের সময় দেশের বাইরে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন করা। সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে ব্র্যাকের কার্যক্রম শুরু। এরপর আবেদ ভাই ব্র্যাকের কার্যক্রম বিস্তৃত পরিসরে নিয়ে যান। তখন এর নামের অর্থ বদলে যায়। ব্র্যাকের নতুন নাম হয় বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি।
যাহোক, ঝড়-বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের পাশাপাশি ব্র্যাক আরও নানা পরিসরে কাজ শুরু করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ওরাল স্যালাইন নিয়ে কাজ। আইসিডিডিআরবি ওরাল স্যালাইন উদ্ভাবনের পর সেটা তৃণমূল মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া সহজ ছিল না। সেই চ্যালেঞ্জটাই নেয় ব্র্যাক। সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ওরাল স্যালাইন জনপ্রিয় করার কাজটা ব্র্যাকই করেছে।
ব্র্যাকের অন্যতম সাফল্য হলো নন-ফরমাল শিক্ষাপদ্ধতি চালু করা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনার জন্য গ্রামে গ্রামে ব্র্যাক স্কুল প্রতিষ্ঠা করার ভাবনাটাও আবেদ ভাইয়ের মাথা থেকে এসেছিল। একটি ক্লাসরুম আর একজন মাত্র শিক্ষিকার মাধ্যমে অনন্য এক উদাহরণ তৈরি করেছিলেন গোটা বিশ্বেই।
লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে আবেদ ভাইয়ের অবদান সবচেয়ে বড়। সারা দেশে ব্র্যাকের যত কর্মী আছেন, তাঁদের ৭০ ভাগই নারী। এ কাজটা কিন্তু সহজ ছিল না। সে সময় কয়েকটি গোঁড়া গোষ্ঠী ব্র্যাকের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু আবেদ ভাই তাতে বিচলিত হয়ে পিছিয়ে আসেননি। আজ যে নারী স্বাধীনতা, নারী অধিকার অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এটার পেছনে আবেদ ভাইয়ের দূরদর্শী চিন্তা বড় ভূমিকা পালন করেছে।
২০০১ সালের মধ্যেই আবেদ ভাই দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন, অনেক পুরস্কার উঠেছে তাঁর ঝুলিতে। সে বছরই একদিন আমার বাসায় হাজির তিনি। বললেন, একটা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে চান। সরকারের কাছে আবেদন করেছেন। আশা করছেন, শিগগিরই অনুমোদন পেয়ে যাবেন। সরাসরি আমাকে তিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার প্রস্তাব দিলেন। আমি তখন বুয়েটের অধ্যাপক। বুয়েটের উপাচার্য হওয়ার প্রস্তাবও আমি সরকারের কাছ থেকে পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি শিক্ষক হিসেবেই ছাত্র পড়াতে চেয়েছিলাম, উপাচার্য হওয়ার ইচ্ছে ছিল না কখনো। কিন্তু আবেদ ভাই আমাকে ভেবে দেখতে বললেন, কয়েক দিন সময় দিলেন। আমি ভাবলাম, মনে হলো নতুন একটা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে, এখানে উপাচার্য হলে নতুন কিছু করার সুযোগ থাকবে। তাই রাজি হলাম।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পর আবেদ ভাইকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাঁর ব্যক্তিসত্তাকে ভালোভাবে দেখার সুযোগ হলো। প্রায়ই প্রতিদিন তাঁর সঙ্গে দেখা হতো, কথা হতো। তাঁর নতুন নতুন ভাবনার কথা বলতেন। সেসব ভাবনায় দূরদর্শিতার ছাপ থাকত স্পষ্ট। এ জন্যই তাঁর কোনো পরিকল্পনা বিফলে যায়নি। তিনি নিজের অর্থবিত্ত নিয়ে কখনো ভাবেননি। থেকেছেন প্রতিষ্ঠানের বাসায়। নিজের জন্য বাড়ি-গাড়ি, শানশওকত করেননি। তাঁর চিন্তা ছিল অত্যন্ত স্বচ্ছ। এমনকি ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার পেছনেও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চিন্তা তাঁর ছিল না। ব্র্যাক ব্যাংকই মূলত ব্যাংকিং সেবাকে প্রথম নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেয়।
বিদেশি সংগঠনগুলো সততা ও স্বচ্ছতার কারণেই আবেদ ভাইকে পছন্দ করত। তাই অনুদান প্রদানের ক্ষেত্রে ব্র্যাকই ছিল তাদের পছন্দের তালিকায় ওপরের দিকে। প্রথম দিকে বিদেশি অনুদানের মাধ্যমেই ব্র্যাক তাদের সমাজসেবামূলক কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করেছে। বিকাশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ব্র্যাক এখন স্বাবলম্বী। বিকাশের লভ্যাংশের বড় অংশ ব্যয় হয় ব্র্যাকের অলাভজনক কার্যক্রমে।
পরিশেষে আমি বলতে চাই, এমন দূরদর্শী, স্বচ্ছ চিন্তার মানুষকে হারানোর ক্ষতি অত সহজে পূরণ হওয়ার নয়।
লেখক: জাতীয় অধ্যাপক