মতামত

দুর্নীতি ও সরকারি ব্যয় কমাতে না পারলে যে পরিণতি অপেক্ষা করছে

দুর্নীতি ও একটি অকার্যকর রাজনৈতিক ব্যবস্থা সত্ত্বেও মোটামুটি উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সূচকের কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৭ সালে, মার্কেট এক্সচেঞ্জ রেটে মার্কিন ডলারে রূপান্তরিত করার পর জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যায়। যদিও বাংলাদেশ তার যাত্রা শুরু করে অনেক নিম্ন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও উন্নয়ন সূচক থেকে। যাত্রা শুরু করেছিল এমন একটা ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে, যা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। কিছু কিছু উন্নয়ন সূচকে একই আয়ের অন্য সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। ছাড়িয়ে গেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর ভারতকেও। অবশ্য এই সামাজিক-মানবিক উন্নয়ন অনেকটাই ঘটেছে এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলোর কল্যাণে। একই সময়ে অনেক গবেষক ও উন্নয়ন সহযোগী পাকিস্তান একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।

সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অনেক পণ্ডিতও বাংলাদেশের উন্নয়নকে পাকিস্তানের উন্নয়নের সঙ্গে তুলনা করেন এবং গত তিন দশকে বাংলাদেশ কীভাবে পাকিস্তানের চেয়ে ভালো করছে, সেই গল্প করে তাঁদের উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের উন্নয়নের সঙ্গে যে কিছু আশঙ্কার দিকও আছে, সেই সাবধানবাণী উচ্চারণ করতে তাঁরা ভুলে যান। দুর্নীতি ও মাত্রাতিরিক্ত অ–উন্নয়নমূলক সরকারি ব্যয় দেশটিকে ভেতর থেকে ক্ষয় করে ফেলার ঝুঁকির মধ্যে রেখেছে।

পাওলো মওরো, বিশ্বব্যাংক ও আরও বহু গবেষণা থেকে জানা যায় যে দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রবৃদ্ধি হারাচ্ছে। ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক রিপাবলিক ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে পরিচালিত এক সার্ভেতে ব্যাপক দুর্নীতি ও বৈষম্য বিষয়ে মানুষ গভীর হতাশা প্রকাশ করেছে এবং তারা দুর্নীতিকে দেশের ১ নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

২০২০-এর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাকিস্তানের নিচে ও শুধু আফগানিস্তানের ওপরে। আফগানিস্তান তার অবস্থান ২০১২-এর পর থেকে ১১ ধাপ উন্নতি করেছে আর নেপাল করেছে ৬ ধাপ। এমনকি মিয়ানমারও ২০১৩-এর পর থেকে ১৩ ধাপ উন্নতি করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্কোর ২০২০ সালে ছিল ২৬, যা তার ২০১২-এর স্কোরের সমান।

পাকিস্তানের বিখ্যাত সাংবাদিক তাহা সিদ্দিকী আল-জাজিরা নিউজে ২০১৯-এর জুলাইয়ে প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের অর্থনীতি কেন ডুবে যাচ্ছে’ শীর্ষক নিবন্ধে পরিষ্কার জানান, দুর্নীতির কারণেই দেশটির বড়লোকেরা কর ফাঁকি দিতে পারছেন। পাকিস্তানে মাত্র ১ শতাংশ মানুষ কর দেন এবং পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নিম্ন ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাতের দেশগুলোর অন্যতম। তিনি ব্যাখ্যা করছেন, একদিকে মাত্রাতিরিক্ত অনুন্নয়নমূলক সরকারি ব্যয়, যার ৩০ শতাংশ চলে যায় প্রতিরক্ষা খাতে এবং বাজেটের একটা বড় অংশ ব্যয় হয় সুদ পরিশোধ করতে, যার কারণে আরও বেশি ঋণ নিতে হয়—এ রকম একটি দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ে গেছে পাকিস্তান। অন্যদিকে কর থেকে আয়ের পরিমাণ খুবই সামান্য। পাকিস্তানে এ রকম অবস্থা অনেক দিন ধরে বিরাজ করছিল, যা দেশটিকে বর্তমানের এই সংকটের দিকে ধাবিত করেছে। যেখানে এখন এক-তৃতীয়াংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন, মুদ্রার মান ক্রমাগতভাবে নেমে চলেছে, প্রবৃদ্ধির হার অতিমারির আগেই ৬ দশমিক ২ থেকে ৫০ শতাংশ কমে ৩ দশমিক ৩-এ নেমে এসেছে, মুদ্রাস্ফীতি ১৩ শতাংশের দিকে ওঠানামা করছে।

সম্ভবত পাকিস্তান জিডিপির অনুপাতে সরকারি ব্যয় কমানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। ২০০৪-এ পাকিস্তান সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমিয়ে ১৯ দশমিক ৮৪ শতাংশে নিয়ে এসেছে, যেখানে বাংলাদেশ ২০০৮ সালে বাজেটে ব্যয় বাড়িয়ে ১৮ দশমিক ৩৯ শতাংশে উন্নীত করেছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সরকারি ব্যয় প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছিল, জিডিপির অনুপাতে যা ছিল বাংলাদেশে ১৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ ও পাকিস্তানে ২৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। দুই দেশেই অপারেটিং কস্ট বা চলতি ব্যয়, তথা অনুন্নয়নমূলক ব্যয় মোট ব্যয়ের একটা বড় অংশ।
জিডিপির অনুপাতে চলতি ব্যয়ের অংশগুলো, অর্থাৎ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, মালামাল ও সেবা ক্রয়; ‘নানাবিধ’ বা আকস্মিক ব্যয় ইত্যাদি আসলে অদক্ষতা ও দুর্নীতির মাত্রারই নির্দেশক। নিম্ন সরকারি আয় মানে নিম্ন কর আদায় আর উচ্চ সরকারি ব্যয় মানে মাত্রাতিরিক্ত চলতি তথা অনুন্নয়নমূলক ব্যয়। দুই ক্ষেত্রেই দুর্নীতি নির্দেশ করে। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে ভুটানের মোট অপারেটিং ব্যালান্স (৭ দশমিক ৯৮) বাংলাদেশের (০ দশমিক ৯৩) চেয়ে অনেক বেশি ছিল। এটা খুবই উদ্বেগজনক। কারণ, পাকিস্তানের অর্থনীতির অধোগতির প্রধান কারণ তাদের ঋণাত্মক মোট অপারেটিং ব্যালান্স, যা ২০১৫ সালে ছিল মাইনাস ৩ দশমিক ২৯।

গত তিন দশকে বাংলাদেশ কীভাবে পাকিস্তানের চেয়ে ভালো করছে, সেই গল্প করে অনেককে উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের উন্নয়নের সঙ্গে যে কিছু আশঙ্কার দিকও আছে, সেই সাবধানবাণী উচ্চারণ করতে তাঁরা ভুলে যান। দুর্নীতি ও মাত্রাতিরিক্ত অ–উন্নয়নমূলক সরকারি ব্যয় দেশটিকে ভেতর থেকে ক্ষয় করে ফেলার ঝুঁকির মধ্যে রেখেছে।

কর আদায়ের পরিমাণকে দুর্নীতির সূচক হিসেবে গণ্য করা যায়। কারণ, কত লোক কর ফাঁকি দেন, এটা তা নির্দেশ করে। ২০১৪ সালে পাকিস্তান জিডিপির অনুপাতে আয়কর, মুনাফা কর ইত্যাদি মিলিয়ে মোট আদায় করেছিল ৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যেখানে বাংলাদেশ করেছে ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ। তার মানে হলো, পাকিস্তানে বাংলাদেশের চেয়ে দুর্নীতির মাত্রা একটু হলেও কম।

বাংলাদেশে আমরা দুর্নীতির অনেক চিত্র খবরের কাগজে দেখি। পত্রিকার রিপোর্ট থেকে কিছু ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যাক। ‘বেক্সিমকো প্রতিটি ভ্যাকসিন থেকে ৭৭ টাকা করে মুনাফা করবে’, এটা ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের একটা উদাহরণ, যেখানে তারা সরকারকে টিকে থাকতে সাহায্য করে। বিনিময়ে সরকার তাদেরকে জনগণের স্বার্থের বিপরীতে অন্যায্য সুবিধা দেয়। ‘একটা বালিশ কেনা হয়েছে ৫৯৫৭ টাকায়’; ‘একটা চামচের দাম পড়েছে ৯৭ হাজার টাকা’; ‘৫৫০০ টাকার বই কিনতে লেগেছে ৮৫,৫০০ টাকা’; ‘একটা পর্দার দাম ধরা হয়েছে ৩৭,৫০০ টাকা’। এই ঘটনাগুলো মালামাল ও সেবা ক্রয় এবং ‘নানাবিধ’ বা আকস্মিক খরচ ইত্যাদির নামে আসলে রাষ্ট্রের কোষাগার লুণ্ঠনের উদাহরণ। অন্য আরেক রকম তছরুফের ঘটনার উদাহরণ হলো, ‘চিনাবাদাম চাষ শিখতে ১১৬ কর্মকর্তা বিদেশে যাবেন’; ‘পুকুর খনন শিখতে ১৬ জন কর্মকর্তা বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত’।

কোন মন্ত্রণালয়ে কত টাকা বরাদ্দ করা হবে, তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে ও পরে ক্যাবিনেটে অনুমোদন করতে হয়। কোনো মন্ত্রণালয়ে কেনাকাটায়, অনর্থক বিদেশ গমনে ও ‘নানাবিধ’ বা আকস্মিক ব্যয়ের নামে অর্থ তছরুফের ঘটনা যাতে না ঘটে, তা রোধ করতে হলে ইফিসিয়েন্সি রেটিং করতে হবে। এই রেটিংয়ের ওপর ভিত্তি করে চলতি ব্যয় বরাদ্দ করতে হবে এবং দুর্নীতির বিচারের পাশাপাশি চলতি ব্যয় কমিয়েও শাস্তি দিতে হবে। আর ইফিসিয়েন্সি মানে হলো কম সময়, কম খরচ, কিন্তু উচ্চ মান। এই তিনের সমন্বয়ে গঠিত কম্পোজিট ইনডেক্স দিয়ে মন্ত্রণালয়ের মান নির্ধারণ করতে হবে।
অন্যদিকে জিডিপির অনুপাতে স্বাস্থ্য ব্যয়ে ২০১৮ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ সর্বনিম্ন এবং শিক্ষায় ২০১১ সালে সর্বনিম্নের সামান্য ওপরে। শিক্ষা ব্যয়ে বাংলাদেশ ২০১২ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে বরাদ্দ কমাচ্ছে, যাতে ঠিক পাকিস্তানের লক্ষণগুলো স্পষ্ট। যদিও স্বাস্থ্য ও শিক্ষা হলো হিউম্যান ক্যাপিটাল তথা মানবসম্পদের ভিত্তি। যেখানে মাত্রাতিরিক্ত প্রতিরক্ষা ব্যয় পাকিস্তানের অর্থনীতি ধ্বংসের কারণ, সেখানে বাংলাদেশ ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতিরক্ষা ব্যয় (২৫৫২-৪৩৩৫ মিলিয়ন) বাড়িয়ে চলেছে।

উচ্চ দুর্নীতি, যা ওপরের তছরুফের ঘটনাগুলোতে প্রতিফলিত, ব্যবসায়ীদের অন্যায্য সুবিধা প্রদান, ক্রমবর্ধমান প্রতিরক্ষা ও অনুন্নয়নমূলক ব্যয় আজকের বাংলাদেশের জন্য সত্যিই খুব উদ্বেগজনক; যে উপসর্গগুলো পাকিস্তানে দেখা দিয়েছিল অনেক আগে থেকেই।

(বিশ্লেষণটা করা হয়েছে ‘যে সালে যে ডাটা সব দেশের জন্য পাওয়া গেছে’, তার ভিত্তিতে)

এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। ই–মেইল: nntarun@gmail.com