খাদ্য ও পুষ্টি

দুধে অবহেলা নয়

পৃথিবীর সব খাদ্যের সেরা খাদ্য দুধ। সর্বোচ্চ পুষ্টিমানের জন্যই দুধের শ্রেষ্ঠত্ব। দুধের অপরিহার্য উপাদান ল্যাকটোজ, যা দৈহিক গঠন, বিকাশ ও মেধা বৃদ্ধিতে সহায়ক। মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষার মূল উপাদান দুধ। বাংলাদেশের জনগণের একটি বৃহৎ অংশ তরল দুধ পান থেকে বঞ্চিত। দুধকে আমরা বিলাস খাদ্যের তালিকায় বন্দী রেখেছি। গরুর দুধে আছে অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, খনিজ পদার্থ যেমন ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, কোবাল্ট, কপার, জিংক, আয়োডিন ও সেলিনিয়াম। গরুর দুধের কম্পজিশনে পানি ৮৬ দশমিক ৫ শতাংশ, ল্যাকটোজ ৪ দশমিক ৮ শতাংশ, ফ্যাট ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, প্রোটিন ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। গরুর দুধ সব পুষ্টির আধার ও শক্তির উৎস। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ক্যানসার ও হূদেরাগ প্রতিরোধে দুধের শক্তিশালী ভূমিকা প্রমাণিত হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রচলিত খাদ্য-সংস্কৃতি আমাদের মেধা ও স্বাস্থ্য রক্ষার পথে পর্বতপ্রমাণ বাধা। আমরা শিশুদের পান করাচ্ছি গুঁড়া দুধ এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার। বাবা-মা ও অভিভাবকদের অসচেতনতায় আমাদের সন্তানেরা ঝুঁকে পড়ছে চিপস, আচার, জুস ও আইসক্রিমের দিকে।
স্বাস্থ্যহানিকর এ খাদ্যাভ্যাসের জন্য মা-বাবার সঙ্গে শিক্ষকেরাও সমভাবে দায়ী। ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে প্রত্যক্ষ করেছি, বাংলাদেশের স্কুলগুলোর ফটকের সামনে ধুলাবালু ও আবর্জনাময় পরিবেশে বিক্রি হচ্ছে বিষাক্ত আচার, দূষিত আইসক্রিম, নিম্নমানের চকলেট, চানাচুর ও পচা ফলমূল। এ ব্যাপারে শিক্ষক ও অভিভাবকেরাও উদাসীন। পুলিশি ব্যবস্থা নয়, সামাজিক প্রতিরোধ ও সচেতনতার মাধ্যমে এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসচেতন করা ও সুস্থ জীবন সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া শিক্ষকদের কর্তব্য। ফাস্টফুডের প্রতি শিশুদের উদ্বেগজনক আসক্তি যে মাত্রায় বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অনিবার্যভাবেই মেধাশূন্যতার কবলে পড়বে। মুঠোয় মুঠোয় রঙিন খাবার আর চিপসের সঙ্গে শিশুর দেহে ঢুকছে নানা মরণব্যাধির উপকরণ।
আমাদের জাতির অপুষ্টির অন্যতম কারণ দুধের অভাব। জনপ্রতি বছরে দুধ পান করার পরিমাণ যেখানে যুক্তরাজ্যে ২৪২ কেজি, অস্ট্রেলিয়ায় ২৪১, যুক্তরাষ্ট্রে ২৫৪, জার্মানিতে ২৪৭, ফ্রান্সে ২৬১, ডেনমার্কে ২৯৬ ও সুইডেনে ৩৫৬; সেখানে বাংলাদেশে মাত্র ২৬ কেজি। সম্প্রতি ব্র্যাকের এক অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত তথ্যে জানা গেছে, দেশের তিন কোটি ৬০ লাখ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। সুইডেনে ৪৫ হাজার লোকের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, যারা সপ্তাহে দুই গ্লাস দুধ পান করে, তাদের চেয়ে যারা প্রতিদিন দেড় বা দুই গ্লাস দুধ পান করে, তাদের রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক কম। বাংলাদেশে চাহিদার চেয়ে দুধের ঘাটতি প্রায় ৮২ থেকে ৮৫ শতাংশ। ফলে পুষ্টিহীনতায় ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী। দেশে দুধের চাহিদা প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ টন, অথচ উৎপাদিত হচ্ছে মাত্র ২৩ লাখ টন।
আমরা আত্মীয়স্বজনের বাসায় বেড়াতে গেলে প্যাকেট-ভর্তি মিষ্টি বা পলিথিন-ভরা ফল নিয়ে যাই। অথচ এ দুটি খাদ্য ব্যয়বহুল এবং দূষণ বা ভেজালযুক্ত। মিষ্টিতে আছে স্যাকারিন, ক্ষতিকর হাইড্রোজ, নিম্নমানের গুঁড়া দুধ এবং ফলে আছে ফরমালিন—কোনোটাই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এর পরিবর্তে তরল দুধের প্যাকেট হাতে আত্মীয়স্বজনের বাসায় উপস্থিত হওয়া শ্রেয়। চট্টগ্রামে ২০০৭ সালে শীর্ষস্থানীয় এক কারখানায় ভেজালবিরোধী অভিযান চালিয়ে ম্যাড ইন ইউক্রেন লেবেল-যুক্ত ৪০০ মেট্রিক টন ভেজাল গুঁড়া দুধ আটক করেছিলাম। উচ্চ মহলের চাপে এ দুধ ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ করেছিলাম রাসায়নিক পরীক্ষায় মানুষের পান করার অনুপযোগী প্রমাণ করে। এভাবে মানুষের জীবন নীরবে ধ্বংস করা হচ্ছে। খাদ্যদূষণ, পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ—এ অভিশাপেই জর্জরিত এ দেশের মানুষের জীবন। চালে ইউরিয়া, সবজিতে কীটনাশক, মাছে ফরমালিন, মরিচে ইটের গুঁড়া, হলুদে সিসার গুঁড়া—কে দেবে জনগণের স্বাস্থ্যরক্ষার নিশ্চয়তা?
দুধের অভাবে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে মানুষের রোগব্যাধির হার বেড়ে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দুধের অভাবে শিশুদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস পেয়ে মস্তিষ্কের গঠন-প্রক্রিয়া ব্যাহত করে আইকিউ কমে যায়। এমনকি দুধের অভাবে হাড়ের গঠন দুর্বল হয়ে হাড় ভঙ্গুর হতে পারে। দুধের অভাবে যে স্বাস্থ্যগত ক্ষতি, তা কখনো পুষিয়ে দেওয়া যাবে না অন্য খাবার খেয়ে। স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী, প্রতিদিন একজন মানুষের দুধের চাহিদা ২৫০ মিলিলিটার, কিন্তু আমরা পান করছি মাত্র ৪৫ থেকে ৭০ মিলিলিটার। সুষম খাবারের পরিবর্তে আমরা প্রলুব্ধ থালাভর্তি ভাত, অত্যধিক মসলা, তেলযুক্ত তরকারি ও চর্বিময় মাংস খেতে। বিশেষ করে ভাতের ওপর নির্ভরশীলতা আমাদের বেশি। মসলা ও তেলযুক্ত খাবার তৈরিতে যে শ্রম, জ্বালানি ও অর্থ ব্যয় হয়, তা দিয়ে দুই বেলা দুধ কিনে পান করলে পুষ্টি নিশ্চিত হতো। আমাদের পুষ্টিবঞ্চিত হওয়ার মূল কারণটাই প্রথাগত ও ভ্রান্ত খাদ্যসংস্কৃতি।
দুধ উৎপাদন বাড়িয়ে বাংলাদেশে শ্বেত বিপ্লব ঘটাতে হবে। অদূরদর্শী শিল্পায়নের কবলে পড়ে বাংলাদেশে খাদ্য ফলানোর জমি কমছে, মাছ ধরার পানিপ্রবাহ কমছে এবং গবাদিপশুর চারণভূমি কমছে। পরিবেশদূষণবিরোধী অভিযানের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, শিল্পায়নের নামে ডাইং কারখানা আর ইটভাটা নির্মাণ করে কৃষিজমি ও জলাভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে। এসবের পরিবর্তে দুগ্ধ খামার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসার জন্য ব্যবসায়ীদের আহ্বান জানাচ্ছি। পার্বত্য ও উপকূলীয় এলাকায় সমবায় ভিত্তিতে দুগ্ধ খামার প্রতিষ্ঠার অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে।
দুধ অনন্যশক্তি ও অসাধারণ পুষ্টির আধার। দুধকে মূল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, পরিপূরক খাদ্য হিসেবে নয়। এক ব্রিটিশ নাগরিককে চিনি, যিনি ৭১ বছর বয়সেও দৈনিক দুই লিটার দুধ খেয়ে বার্ধক্যকে তারুণ্যে পরিণত করেছেন। দুধেই জীবন রক্ষা, দুধে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও জাতির অস্তিত্ব রক্ষা। দুধের অভাবেই জরাগ্রস্ততা, ব্যাধিগ্রস্ততা।

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মিল্ক ভিটা।
mmunirc@gmail.com