আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ গত ২৪ সেপ্টেম্বর পিআইবির এক অনুষ্ঠানে বলেন, সংসদের চলতি অধিবেশনেই ২০০৪ সালের দুদক আইনে সংশোধনী আনা হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত সংসদে বিল ওঠেনি। ‘নখদন্তহীন’ হিসেবে দুদক মিডিয়ায় আলোচিত। এটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে অপারগ। এর বড় কারণ এর প্রয়োজনীয় আইনি শক্তি নেই। একাধিক কমিটি তিন বছর ধরে কাজ করেছে, সুপারিশমালাও পেশ করেছে। কিন্তু তা বিল আকারে সংসদীয় কমিটিতে পড়ে আছে। এটি প্রস্তাবিত আকারে পাস হলে দুদক সত্যিকার অর্থে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংস্থা হবে। উদাহরণ দিই। বিদ্যমান আইনে সাক্ষীর প্রতি সমনের কথা আছে। আর প্রস্তাবে সাক্ষীর প্রতি নোটিশের কথা বলা হয়েছে। সাক্ষীর প্রতি সমন আদালতের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক, র্যাবের মহাপরিচালক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার কর্তৃক সময়ে সময়ে বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে ঘোষিত এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দুর্নীতি সম্পৃক্ত যেকোনো তথ্য চাইতে পারা দুদকের শক্তির অপার উৎস। বিলে এসব সংস্থা দুদককে সব তথ্য সরবরাহ করতে বাধ্য থাকবে মর্মে কথা আছে। তারা যথাসময়ে তথ্য না দিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে দুদক। দুদকের অনুসন্ধান, তদন্ত, মামলা ও চার্জশিটে আনীত অপরাধের ধরন হবে আমলযোগ্য, অ-আপসযোগ্য ও জামিনের অযোগ্য। বর্তমানে দুদক আইনে এ বিধান নেই।
বিলে দেশ-বিদেশে সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের সম্পত্তি রাখা এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা আছে। এটি আইনে পরিণত হলে এনবিআর, পুলিশ, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, ব্যাংক ও ভূমি অফিসের কাছ থেকে দুর্নীতির বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য মিলবে। কমিশন হবে একটি স্বশাসিত সংস্থা। দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তকাজের সুবিধার জন্য সরকারের অধীন যেকোনো কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা থেকে যেকোনো প্রতিবেদন বা তথ্য চাইতে পারবে। এমনকি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও পারদর্শী এক বা একাধিক কর্মকর্তার সহায়তাও চাইতে পারবে।
বিদ্যমান আইনের কারণে দুদকের কাছে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তি দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করতে ভরসা পাচ্ছে না। কারণ, তথ্য প্রদানকারীর পরিচয় গোপন রাখার রক্ষাকবচ নেই। দুদককে আদালতের মামলায় ‘পক্ষভুক্ত’ করার বিষয়টি বিরাট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, তাকে পক্ষভুক্ত করার বাধ্যবাধকতা না থাকায় আসামিরা অন্যায্য সুযোগ নিয়ে থাকেন। নতুন সংশোধনী পাস হলে এটা আর ঐচ্ছিক বিষয় থাকবে না। দুদককে একদম না শুনে কারও জামিন কিংবা অন্য কোনো প্রকার প্রতিকার মিলবে না। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দুটি রায়ে দুদককে প্রয়োজনীয় পক্ষ হিসেবে অভিহিত করেছেন। দুদককে শুনতেও পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।
দুদক আইনের তফসিল থেকে দণ্ডবিধির ৪০৮ ধারা বাতিল করা জরুরি। এটি কর্মচারী কর্তৃক অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গকরণ-সংক্রান্ত। দণ্ডবিধির ৪০৮ ধারাটি দুদক আইন ২০০৪ আগে আপসযোগ্য ছিল। তবে আপস চাইলে আদালতের অনুমতি লাগবে। যেমন একজন কর্মচারী তাঁর মালিক বা প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত হলেন। এরপর তিনি যদি আদালতে বিচার চলাকালে দোষ স্বীকার করে মেরে দেওয়া টাকা ফেরত দিতে চান, তাহলে আদালতের অনুমতি নিয়ে মামলাটি আপস করা যেত। মামলার বাদী তাঁর টাকা ফেরত পেলে তাঁরও কোনো অভিযোগ থাকত না। কিন্তু এখন আর তেমন অবস্থায় মামলাটি আপসের কোনো সুযোগ নেই। বর্তমানে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিশেষ আদালতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মামলার বিচারকাজ চলছে দণ্ডবিধির ৪০৮ ধারায়। মামলার বাদী আত্মসাৎ করা টাকা ফেরত পেলে তিনি মামলায় সাক্ষ্য দিতে চান না। মামলার তদবিরও করতে চান না সংগত কারণেই। কিন্তু দুদক যদি মামলা প্রমাণ করতে পারে, তাহলে সাজা নিশ্চিত। কিন্তু এ কেমন আইন, টাকাও ফেরত দিতে হবে আবার সাজাও খাটতে হবে।
অপার সম্ভাবনাময় এ দেশটি যে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নসূচকে পৌঁছতে পারছে না, তার মূলে রয়েছে দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে শুধু দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে না, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও নষ্ট হচ্ছে আমাদের ভাবমূর্তি। এর লাগাম টানতে সদুপদেশ খুব একটা কাজে আসবে না। এ জন্য চাই দুর্নীতি দমনে শক্তিশালী সংস্থা। দুর্নীতি দমন ব্যুরোকে একটি কমিশনে রূপান্তর ঘটানোর পর সংস্থাটি যখন দুদক নাম ধারণ করেছিল, তখন সবাই আশাবাদী হয়ে উঠেছিল এই ভেবে যে এবার একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে দুদক দুর্নীতি দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সমর্থ হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
দুদক আইনে উপযুক্ত সংশোধনী আনা জরুরি। চলতি সংসদের শেষ অধিবেশনেও যদি আইনটি পাস না হয়, তা হবে দুর্ভাগ্যজনক। আশা করব, আইনপ্রণেতারা কয়েকটি নতুন বিষয় বিবেচনায় নেবেন। কমিশনারদের মেয়াদ চার বছরের পরিবর্তে পাঁচ বছর হওয়া উচিত। আর যে সংশোধনী না আনলেই নয়, সেটি হলো কমিশন চেয়ারম্যান এবং কমিশনারদের মধ্যকার বৈষম্য দূর করা। বর্তমান আইনে অনেক ক্ষেত্রে কমিশনারদের চেয়ারম্যানের অধীন করা হয়েছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, চেয়ারম্যানসহ প্রত্যেক কমিশনারই আধা সাংবিধানিক পদমর্যাদায় আছেন। তাঁদের প্রত্যেকের জবাবদিহি কার্যত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে নিশ্চিত করা আছে। তাঁদের নিয়োগও অভিন্ন বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ঘটছে। অথচ আইনের একটি অদ্ভুত বিধান হলো চেয়ারম্যান সার্বিক তত্ত্বাবধান করবেন আর কমিশনাররা প্রশাসনিক বিষয়ে চেয়ারম্যানের কাছে জবাবদিহি করবেন। প্রশাসনিক বিষয়ের সংজ্ঞা বিদ্যমান আইনে নেই। এই বিধান কমিশনারদের স্বাধীনতার জন্য অস্বস্তিকর। এটি অপ্রয়োজনীয় মনস্তাত্ত্বিক বাধা।
খুরশীদ আলম: প্যানেল আইনজীবী, দুদক।