টানা ৪০ দিন। দিল্লিতে হু হু করে নেমেছে তাপমাত্রা। শেষে শূন্য ডিগ্রিতে। হাড় হিম করা ঠান্ডা। সঙ্গে বৃষ্টি। তবু অনড় কৃষকেরা। তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবি থেকে তাঁরা সরেননি একচুলও। পাঁচ শর বেশি কৃষক সংগঠন কথা বলছে এক সুরে।
কেন্দ্রের মন্ত্রীরা কখনো দেগে দিয়েছেন ‘খালিস্তানি’। কখনো বলেছেন, পাকিস্তান কিংবা চীনের এজেন্ট। কখনো আবার এই আন্দোলনে দেখেছেন আরবান নকশাল, মাওবাদীদের ইন্ধন। কৃষকদের এই প্রতিবাদ নাকি হাইজ্যাক করে নিয়েছে অতি-বাম ও মাওবাদীরা। শেষে ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাংয়ের সদস্য’ বলে পর্যন্ত দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এত কিছুর পরেও কৃষকদের একতায় এতটুকু ফাটল ধরাতে পারেনি সরকার।
স্বাধীনতার পর এমন ঐক্য অভূতপূর্ব। কৃষক আন্দোলনের চরিত্র ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন থেকে মৌলিকভাবে আলাদা হওয়া সত্ত্বেও গড়ে উঠেছে এক ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ। কৃষকদের মধ্যে রয়েছে শ্রেণিগত তারতম্য। অনিবার্যভাবেই রয়েছে কিছু সংঘাতও। তা সত্ত্বেও মোদি সরকারের তিনটি কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ বিলের প্রস্তাবিত সংশোধনীর বিরুদ্ধে এই ঐক্য নজিরবিহীন। লড়াকু কৃষকদের একটাই পরিচয়: কৃষক। কেউ হিন্দু না, মুসলমান না, শিখ না। সবাই কৃষক। দেশের কৃষক আন্দোলনে এক অনন্য নজির।
শ্রেণি সংঘাত স্পষ্ট। প্রকট শ্রেণি বিভাজন। আসলেই এক শ্রেণিযুদ্ধ। সামনে আসছে এক নতুন শ্রেণি দ্বন্দ্ব। আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির সঙ্গে সহযোগিতায় বৃহৎ বুর্জোয়া বনাম ধনী কৃষক ও জোতদারসহ সমগ্র কৃষকের দ্বন্দ্ব। বিভাজনরেখা স্পষ্ট। করপোরেটমুখী কৃষি আইনগুলো নিয়ে সংঘাতের একদিকে বৃহৎ বুর্জোয়ারা। অন্যদিকে ধনী কৃষকসহ তাবৎ কৃষকসমাজ। এমনকি পুঁজিবাদী জোতদারদের মধ্যেও রয়েছে বিভাজন। দেখা যাচ্ছে শাসক শ্রেণির শরিকদের মধ্যে সংঘাত। শুরু হয়েছে বৃহৎ বুর্জোয়ার সঙ্গে অ-বৃহৎ বুর্জোয়াদের দ্বন্দ্বও। বিশেষত, বৃহৎ বুর্জোয়ার সঙ্গে ছোট ও মাঝারি উদ্যোগের মধ্যে দ্বন্দ্ব। এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে নানা সম্ভাবনার রাস্তা।
রাজধানী অবরোধ করে থাকা কৃষক আন্দোলন যেন গাইছে ‘হুইচ সাইড আর ইউ অন?’ গত শতকের তিরিশের দশকের গোড়ায় কেনটাকির খাদান শ্রমিকদের আন্দোলন নিয়ে লেখা ফ্লোরেন্স রিসের লেখা গান, পরে যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় পিট সিগারের গলায়। আজ ‘কোন দিকে সাথি তুই, কোন দিক বেছে নিবি বল?’
কৃষক আন্দোলনের নতুন স্লোগান: ‘আদানি, আম্বানি অউর জমাখরি!’
কৃষির কালা কানুন মানে থাকবে না কৃষিপণ্য মজুতের কোনো ঊর্ধ্বসীমা। মজুতদার, ফাটকাবাজদের পৌষ মাস!
কৃষক আন্দোলনে এই সার্বিক ঐক্যের নেপথ্যে আসলে গত তিন দশকের নয়া উদারনীতি। যার অবধারিত পরিণতিতে বেড়েছে চাষের খরচ। বীজ, সার, কীটনাশকের দাম। অন্যদিকে কমেছে ফসলের দাম। কৃষকের অভাবী বিক্রি। আত্মহত্যার মহামারি। আজকের জরুরি দাবি তাই ফসলের দেড় গুণ দাম।
শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থগুলোর ক্রমবর্ধমান একাত্ম হওয়া। মোদি সরকারের করপোরেটমুখী তিনটি কৃষি আইন ও তিনটি শ্রম আইনের বিরুদ্ধে তাঁরা। এই জোড়া হামলার বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষকেরা ক্রমেই এক জোট হচ্ছেন। মজদুর কিষান এক বেনজির ঐক্য। সমাজের দুই প্রধান উৎপাদক শক্তি এক জোট। একে অপরের সঙ্গে। নীতি বদলের লড়াইয়ে।
মজদুর-কিষান নজিরবিহীন মৈত্রী বাধ্য করেছে বিরোধীদের এক বিন্দুতে আনতে। লোকসভা ভোটের পর এই প্রথম। তৃণমূল, বিএসপি ছাড়া হরতালের সমর্থনে পঁচিশটি সর্বভারতীয়, আঞ্চলিক দল।
মজদুর, কৃষক খেতমজুর—এই মেহনতি শ্রেণির যোগফলই জনসংখ্যার চার ভাগের তিন ভাগ। ঐক্যের এক অনন্য নজির। এই অভূতপূর্ব ঐক্যই উদ্দীপ্ত করছে সমাজের বাকি শোষিত অংশকে। বার্তা দিয়েছে এক নতুন অভিমুখের। এক বিকল্পের। এক নতুন ভোরের। মজদুর কিষান মৈত্রীই বিকল্প। এই মুহূর্তের জরুরি চাহিদা। বুকভরা প্রত্যয়: ‘দৌলত কী আন্ধেরি রাত মে মেহনত কা সুরজ ছুপা লিয়া/ দৌলত কী আন্ধেরি রাত সে হাম আপনে সাবেরা মাঙ্গেগে।’
সরকার আভাস দিয়ে চলেছে করপোরেটমুখী পদক্ষেপ প্রত্যাহারের কোনো প্রশ্নই নেই। করপোরেট মিডিয়াতে বৃহৎ বুর্জোয়াদের শ্রেণি স্বার্থের স্পষ্ট প্রকাশ। তারা যথারীতি সরকারকে নিজের অবস্থানে অনড় থেকে কৃষকদের দাবি প্রত্যাখ্যান করে যাওয়ার আরজি জানিয়ে চলেছে।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদকীয় এই অবস্থান জানিয়ে বলেছে, ‘সরকার যদি প্রতিবাদীদের চাপে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য অথবা কৃষি আইন নিয়ে সমঝোতা করে, তাহলে তা হবে ভারতে কোনোরকম সংস্কার-প্রয়াসে কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী অন্তর্ঘাত হানতে পারে, কিংবা রাজধানী অবরুদ্ধ করে দিতে পারে, তার জন্য এক স্পষ্ট বার্তা।’
বিপরীতে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে শ্রমজীবী ভারত। এই যুদ্ধে কৃষকেরা যে চমৎকার ঐক্য দেখিয়ে চলেছেন, তাকে আরও জোরদার করতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে সরকার এই ঐক্য ভাঙার আবারও চেষ্টা করবে। কৃষকদের এই সংগ্রামকে শক্তিশালী করতে জরুরি শ্রমজীবী জনগণের অন্যান্য অংশের সক্রিয় সমর্থন-সংহতি।
শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের রয়েছে বিশেষ দায়িত্ব। শুধু সমর্থন নয়। কৃষি আইন, শ্রম আইন—এই জোড়া আক্রমণের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে যৌথ সংগ্রাম।
এই লড়াই শুধু কৃষকের নয়। এই লড়াই সবার। এই লড়াই নাগরিক অধিকার রক্ষার। কারণ, এই আইনেই আছে এর বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়া যাবে না।
সরকার এমন আইন তৈরি করে এখন বলছে বোঝাপড়ার কথা। যার অর্থ, মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হয়েছে, এখন বোঝাপড়ার মাধ্যমে ঠিক হবে সেটা ফাঁসিতে, নাকি গুলিতে? রাস্তা তাই একটাই—আগে কৃষকবিরোধী, দেশবিরোধী সর্বনাশা কৃষি আইন বাতিল করতে হবে।
শান্তনু দে পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক