বাংলাদেশের বন্যা সমস্যা, তথা পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার বর্তমান অবস্থা অনেকটা শাহ আবদুল করিমের এই গানের মতো, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম!’
পৃথিবীর তিনটি বড় নদীর অববাহিকায় বাংলাদেশের অবস্থান। এ কারণে উজানের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহের সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টিপাত মিলে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে বন্যার ভয়াবহতা দেখা যায়। বাংলাদেশ যেহেতু ভাটির দেশ, হাজার হাজার বছর ধরে ভূখণ্ড বিনির্মাণের পাশাপাশি নদীগুলো আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে একাকার। যদিও স্বাভাবিক বন্যা আমাদের মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিসহ কৃষিকাজে ব্যাপক অবদান রাখে; তবে ফসলের ক্ষতি আর মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছে অস্বাভাবিক বন্যার সময়।
ক্ষয়ক্ষতি রোধে ব্রিটিশ আমল থেকে বাঁধ নির্মাণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের কৌশল নেওয়া হয়। যেমন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী বাকল্যান্ড বাঁধ। এর আগেও হয়তো বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধের ব্যবহার হতো। ১৯৫০-এর দশকে বড় কয়েকটি বন্যার কারণে ১৯৬০-এর দশক থেকে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা সমস্যার মুখে আসে ইঞ্জিনিয়ারিং বা স্ট্রাকচারাল সমাধান। ১৯৮৭ আর ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যা এই ইঞ্জিনিয়ারিং সমাধানকে আরও বেশি বেগবান করে। বিদেশি সংস্থাগুলো আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলস্বরূপ, ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান (এফএপি) করা হয় বিশ্বব্যাংকের অধীনে। যত দূর জানা যায়, আমাদের দেশে ১২ হাজার ৮৫০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং ২৫ হাজার ৫৮০ কিলোমিটার পানি নিষ্কাশন চ্যানেল তৈরি করা হয়েছে, যা দেশের মোট ভূমির বিপুল অংশ দখল করে আছে। আমাদের মতো পলিবাহিত ভূখণ্ডে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্প বিভিন্ন কারণে সমালোচিত। কাঠামোগত বা স্ট্রাকচারাল সমাধানের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক অভিযোজন প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়া। শুধু তা–ই নয়, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কারণে নদ-নদীর স্বাভাবিক নাব্যতা যেমন হ্রাস পেয়েছে, মরে গেছে অনেক ছোট নদী, শাখা নদী ও খাল। সঙ্গে যোগ হয়েছে শহর ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ। বৃদ্ধি পেয়েছে স্থানীয় আর আঞ্চলিক প্রভুদের নদী দখলের প্রতিযোগিতা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও এই প্রভুদের কাছে বড়ই অসহায়।
পৃথিবীতে খুব কম শহরই পাওয়া যাবে, যেখানে প্রাকৃতিক নিষ্কাশনব্যবস্থা ঢাকার মতো। আমরা এই শহরকে এখন একটা চৌবাচ্চা বানিয়ে ফেলেছি। এখানে অল্প বৃষ্টিতেই ভয়ংকর জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। মেয়র আসেন, মেয়র যান, এসেই আশার বাণী শোনান। কিন্তু জলাবদ্ধতা প্রতিবছর বাড়তেই থাকে। সেই সঙ্গে চলে দোষারোপের সংস্কৃতি।
ঢাকা শহরের পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করছি গত ২০ বছরের বেশি সময়। এই গবেষণাগুলোয় দেখি, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ঢাকা শহরের পরিবেশের ক্ষতি করেছে সবচেয়ে বেশি। অথচ এই সংস্থা তৈরি হয়েছিল ঢাকা বা রাজধানীর উন্নয়নের জন্য। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৯০–পূর্ববর্তী ঢাকা শহরের পশ্চিমাংশ ছিল প্রাকৃতিক জলাধার, যা বন্যা নিয়ন্ত্রণে ছিল খুবই কার্যকর। ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যানের আওতায় একটা বেড়িবাঁধ করা হলো। কিছুদিনের মধ্যে হারিয়ে গেল সমস্ত জলাধার, জমি ভরে উঠল কংক্রিট, জায়গাটি হয়ে গেল পানি-অপ্রবেশ্য ভূমি। রাজউক এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে বলেই জলাধারগুলো এখন শুধুই ইতিহাস।
একই অবস্থা দেখা যায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) বাঁধের বেলায়। কৃষির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ডিএনডি করা হলেও অপরিকল্পিত নগরায়ণ এই এলাকার জনগোষ্ঠীকে বছরের অনেকটা সময় থাকতে হয় জলাবদ্ধতায় বন্দী। তবে ডিএনডির ক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবদান রাজউকের চেয়ে বেশি। ১৯৬০–এর দশকে করা উপকূলীয় পোল্ডারগুলোর কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জলাবদ্ধতাও এখন সর্বজনবিদিত।
দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে তোলা এই কাঠামোগত ব্যবস্থা সব সময় সচল রাখার জন্য বিপুল অর্থের জোগান দেওয়া কষ্টসাধ্য। ফলে জরাজীর্ণ নিষ্কাশনব্যবস্থা মানুষ ও সম্পদকে করে তোলে আরও ঝুঁকিপূর্ণ। মানুষের ইচ্ছাকৃত ভুলের কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন ত্বরান্বিত হওয়ায় বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বাড়বে, ফলে বন্যাও বাড়বে। বিশেষ করে বাড়বে আকস্মিক ও অনিয়মিত বন্যা। এরই মধ্যে দেশের কোথাও কোথায় দু–তিনবার করে বন্যা হচ্ছে। ফলে, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী দিশেহারা।
আমরা কি এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারব? মনে হয় সেই আশা সুদূর পরাহত। কারণ প্রথমত, বন্যা নিয়ন্ত্রণের স্ট্রাকচারাল ব্যবস্থাগুলো নিশ্চল (স্টেশনারি) বা অপরিবর্তনীয় জলবায়ুর ভিত্তিতে নির্মিত। ফলে, তাপমাত্রা বাড়ায় তীব্রতর বৃষ্টিপাতের সঙ্গে এসব সহনীয় হবে না। এর একটা জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে মুম্বাই শহরে ১১৭ বছরের একটা ভবন ২০১৭ সালের তীব্র বৃষ্টিতে ধসে পড়ে। দ্বিতীয়ত, হাজার বছর ধরে আমাদের দেশের মানুষের বন্যার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রাকৃতিক যে অভিযোজনব্যবস্থা ছিল, তা এখন আর খুব বেশি অবশিষ্ট নেই। তৃতীয়ত, ৮ জুলাই প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায়, ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের ৪২টি জেলায় ৪২৩টি বহুমুখী বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এর ১৫৩টি তৈরি হচ্ছে বন্যা কম হয়—এমন জেলাগুলোয়। অন্য এক সংবাদে দেখা যায়, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে মানুষ বন্যা শেল্টারে যেতে আগ্রহী হচ্ছে না। মানে দাঁড়াচ্ছে, আমাদের নতুন করে বন্যা মোকাবিলার কৌশল রপ্ত করা জরুরি।
পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বাংলাদেশে বন্যা বিপদাপন্ন ভূমির পরিমাণ ২৩ থেকে ২৯ শতাংশ বাড়বে বলে এক গবেষণায় দেখা যায়। এর ব্যাখ্যা দাঁড়ায়, আমাদের সামনে হয়তো এমন কিছু অপেক্ষা করছে, যার জন্য আমরা কোনোভাবেই প্রস্তুত না।
ছোটবেলা থেকে আমার বেড়ে ওঠা ডিএনডি এলাকায়, আমাদের বাড়িটা ছিল পার্শ্ববর্তী ভূমি থেকে অন্তত ১০ ফুট উঁচুতে। আর আশপাশে ছিল অনেক পুকুর, কৃষিজমি। বর্ষাকালে দেখতাম, পার্শ্ববর্তী এলাকা পানিতে টইটম্বুর। বন্যার প্রকোপ কমাতে পুকুরগুলো ছিল খুবই কার্যকর। বোনাস হিসেবে পেতাম দেশি মাছ, যা এখন নিতান্তই দিবাস্বপ্ন। মাঝে একবার দেশে গিয়ে নিজের বাড়িটাই চিনতে পারিনি! তাহলে আমরা কীভাবে বন্যা মোকাবিলা করব? শুধু কি জনগণের টাকা খরচ করব, নাকি জনগণকে সম্পৃক্ত করে প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানে এগোব? ছোটবেলার কথা মনে করে ভাবি যে কীভাবে দেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণে প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে ভেঙেচুরে শেষ করে এখন মায়াকান্না করি আর শাহ আবদুল করিমের গানের কথা গেয়ে যাই। ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম!’ এটাই হচ্ছে আমাদের বন্যা মোকাবিলার বর্তমান অবস্থা।
আমাদের দেশ গরিব হচ্ছে সম্পদের অব্যবস্থাপনার কারণে, এর সীমাবদ্ধতার কারণে নয়। আশা করি, দেশের নীতিনির্ধারকেরা প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে আমলে নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যা মোকাবিলায় আশু পদক্ষেপ নেবেন। তা না হলে প্রকৃতি এমন শিক্ষা দেবে, যা থেকে উত্তরণের আর কোনো পথ থাকবে না। এমনই এক শিক্ষা কিন্তু সারা বিশ্ব এখন পাচ্ছে বিশ্বায়নের কারণে—প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের নদ–নদী তথা সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে, বিদেশিদের প্রেসক্রিপশনে তা হবে না।
ড. আশরাফ দেওয়ান: স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্লানেটারি সায়েন্সেস, কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া।