শিক্ষা-বিপর্যয়

দিনে সাড়ে ১২ কোটি শ্রেণী-ঘণ্টা!

হরতাল-অবরোধ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা এলেই শুধু অর্থনীতির বাহ্যিক দিক নিয়ে এর ক্ষতি পরিমাপ করার চেষ্টা হয়। দৈনিক কত টাকার আলু-পটোল নষ্ট হলো, কত টাকার মাল রপ্তানি হতে পারত, শেয়ারবাজারের কী হলো—এ দিয়েই কি হরতাল-অবরোধের ক্ষতি বোঝায়? লেখাপড়ার ক্ষতি বলতে শুধু পরীক্ষা না হওয়ার ক্ষতিও বোঝায় না। এক দিন দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা মানে সাড়ে ১২ কোটি শ্রেণী-ঘণ্টা পাঠ থেকে জাতিকে বঞ্চিত করা!!
প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী প্রায় ৩০ লাখ পরীক্ষার্থীর ধর্ম পরীক্ষা ৩০ নভেম্বর শনিবার অবরোধের আওতায় পড়েছে। এর আগেও একবার পিছিয়েছে। এবার পরীক্ষাটি আরও সাত দিন পিছিয়ে পরের শুক্রবার অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। যারা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা দিচ্ছে, তাদের গড় বয়স ১১ বছর। পরীক্ষার্থীদের অনেকে বলেছে: পরীক্ষা দেওয়ার ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে তারা। এই অভিযোগের উত্তর কি দেওয়া যাবে? সব ঠিক থাকলে ২০ নভেম্বর শুরু হয়ে ২৮ নভেম্বর তাদের পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি।

কিছুদিন আগে হরতাল, অবরোধের মধ্যে পড়ে কোনোমতে শেষ হলো জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা। আগামী বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও দাখিল পরীক্ষা। সময়সূচিও ঘোষিত হয়েছে। তাদের হাতে আছে আর মাত্র দুই মাস সময়। এসএসসির পরপরই শুরু হবে এইচএসসি পরীক্ষা। তা ছাড়া বিদ্যালয়গুলোতে এখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে শ্রেণী পরিবর্তনের জন্য বার্ষিক পরীক্ষা। অর্থাৎ পরীক্ষার মৌসুম এখন। এটি ছাত্রজীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়। যারা পাবলিক পরীক্ষা (পঞ্চম, অষ্টম, দশম, দ্বাদশ শ্রেণীতে) দেয়, তাদের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সময় পাবলিক পরীক্ষাগুলোর নম্বর বিশেষ গুরুত্ব পায়।

আমাদের দেশে কতজন বিদ্যার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গমন করে—এর নির্দিষ্ট সংখ্যা কারও হাতেই নেই। অনেকে বলেন, চার কোটি। পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বিশ্লেষণ করে বলা যায়: এ সংখ্যা সোয়া তিন কোটির মতো। যেমন: প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষার্থী প্রায় ৩০ লাখ।
প্রাক্-প্রাথমিক, এনজিও পরিচালিত বিশেষ বিদ্যালয় ইত্যাদি ধরলে প্রাথমিক পর্যায়ে দেশে বিদ্যার্থীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি ৮০ হাজার। জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট পরীক্ষার্থী ২০ লাখ। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম—এ তিন শ্রেণীতে সারা দেশে নিশ্চয়ই এর সংখ্যা ৬০ লাখ। দেশের আটটি সাধারণ বোর্ড, একটি কারিগরি বোর্ড, একটি মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে মাধ্যমিক অর্থাৎ সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট, দাখিল ও এসএসসি ভোকেশনাল পরীক্ষার্থী প্রায় ১৪ লাখ। নবম শ্রেণীকে ধরে এর সংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ। উচ্চমাধ্যমিক অর্থাৎ হায়ার সেকেন্ডারি সার্টিফিকেট (এইচএসসি), আলিম ইত্যাদি পরীক্ষায় প্রায় ১০ লাখ পরীক্ষার্থী। একাদশ-দ্বাদশ মিলে এর সংখ্যা ২০ লাখ।
এই গেল প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত দেশের মোট বিদ্যার্থীর সংখ্যা: আনুমানিক দুই কোটি ৮৮ লাখ। এরপর উচ্চশিক্ষায় সাধারণত পাঁচটি বর্ষ এবং এখানে প্রতি বর্ষে গড়ে দেশে পাঠরত থাকে কমপক্ষে পাঁচ লাখ ছাত্রছাত্রী।
তাহলে দেশে উচ্চশিক্ষায় রত আছে অন্তত ২৫ লাখ বিদ্যার্থী। আগের দুই কোটি ৮৮ লাখের সঙ্গে এই ২৫ লাখ যোগ করলে দাঁড়ায় তিন কোটি ১৩ লাখ। সারা দেশে এ বিপুলসংখ্যক বিদ্যার্থী শ্রেণীকক্ষভিত্তিক অধ্যয়ন করে থাকে। এ সংখ্যার বাইরে আরও আছে দূরশিক্ষণ, নৈশশিক্ষণ, বিভিন্ন ডিপ্লোমা, প্রশিক্ষণ কোর্স ইত্যাদির অগণিত ছাত্রছাত্রী।

আমরা আপাতত তিন কোটি ১৩ লাখ নিয়মিত বিদ্যার্থীর কথাই চিন্তা করি এবং ধরে নিই, তারা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দৈনিক গড়ে চারটি শ্রেণী-ঘণ্টা শিক্ষকদের কাছে পাঠ গ্রহণ করে। তাহলে কিন্তু এ বিপুলসংখ্যক বিদ্যার্থী দৈনিক সাড়ে ১২ কোটি শ্রেণী-ঘণ্টা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ গ্রহণ করে থাকে। দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব সময়সূচি ও পরিকল্পনা থাকে বিদ্যার্থীদের পাঠদান ও সিলেবাস সমাপ্ত করে বিদ্যার্থীকে পরীক্ষার্থীতে পরিণত করার। শীতকালীন ছুটি, গ্রীষ্মাবকাশ বা উৎসবের ছুটিগুলো এ পাঠপরিকল্পনার মধ্যেই থাকে। এর বাইরে অনির্ধারিতভাবে এক দিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা মানেই পুরো পরিকল্পনার ওপর নেতিবাচক প্রভাব!
এ নেতিবাচক প্রভাবটি জাতীয় মহাক্ষতি হিসেবে দেখা দেয়, যখন দিনের পর দিন দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্ধারিতভাবে বন্ধ

থাকে এবং বিদ্যার্থীরা শ্রেণীপাঠ থেকে বঞ্চিত হয়। সবাইকে ভাবতে হবে, হরতাল, অবরোধসহ অন্য যেকোনো কারণেই হোক, এক দিন অপরিকল্পিতভাবে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ মানেই শিক্ষা খাতে ক্ষতি দৈনিক সাড়ে ১২ কোটি শ্রেণী-ঘণ্টা! শিক্ষার্থী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই শ্রেণী-ঘণ্টাও বাড়বে।
হরতাল, অবরোধের ক্ষতি শুধু আলু-পটোলের ক্ষতি দিয়ে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। আমাদের ভাবতে হবে এটাও, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্ধারিতভাবে বন্ধ থাকায় প্রতিদিন সাড়ে ১২ কোটি শিক্ষা-ঘণ্টা বঞ্চিত হয়ে বাঙালি জাতির তরুণ প্রজন্ম মনোগতভাবে যে শুকিয়ে যাচ্ছে, এ শুষ্কতার বিরূপ প্রভাব পড়বে ভবিষ্যৎ জাতিগঠনে। এর ফলে বাঙালি চিন্তাপ্রবণ এবং সরস জাতির বদলে হয়ে উঠবে শুষ্ক ও বিকলাঙ্গ।

এ সন্তানেরা আপাতত আপনার, আমার হলেও বৃহত্তর অর্থে জাতিরই সম্পদ। তাদের জ্ঞানহীনতার তমসায় ধাবিত করে রাজনীতিবিদেরা নিশ্চয়ই অন্ধকারময় বাংলাদেশ কামনা করবেন না!

ড. সৌমিত্র শেখর: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
scpcdu@gmail.com