আইনগত সহায়তা দিবস

দারিদ্র্য বিচারপ্রাপ্তিতে বাধা নয়

আজ জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস। সরকারি সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবছর ২৮ এপ্রিল জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হয়। ২৮ এপ্রিলকে দিবসের জন্য বেছে নেওয়ার কারণ হলো ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ এই দিনে কার্যকর হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বহু দেশে আইনগত সহায়তা দিবস উদ্যাপিত হয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ´Law Day´ এবং ´Legal Services Day´ দুটিই উদ্যাপিত হয়।
বাংলাদেশে ‘আইনগত সহায়তা’র ধ্যান-ধারণা কাঠামোগতভাবে নতুন হলেও সাংবিধানিক আইনের ইতিহাসে এটি বেশ পুরোনো। রাষ্ট্র পরিচালনার অপরিহার্য মূলনীতি হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯(১) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবে।’ আবার নাগরিকদের রক্ষাকবচ হিসেবে খ্যাত ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী।’
সাংবিধানিক তত্ত্ব অনুযায়ী ধনী-দরিদ্রকে এক কাতারে আনা হলেও বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। সমাজের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, যারা আর্থিক অসামর্থ্যের কারণে কিংবা সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে যাতে কেউ আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার থেকে কোনোভাবে বঞ্চিত না হয়, তার জন্য লিগ্যাল এইড-ব্যবস্থার সৃষ্টি। শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে একমাত্র আইন-আদালতের মাধ্যমেই মানুষ তার ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
আর্থিক দৈন্য বা অসচ্ছলতা একজন মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনোভাবেই প্রতিবন্ধকতা হতে পারে না। ১৯৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিখ্যাত মামলায় (Jackson v. Bishop, Eight Circuit Court of Appeal, USA) বিচারক Harry Blackmun বলেন, The concept of seeking justice cannot be equated with the value of dollars. Money plays no role in seeking justice. ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি P N Bhagwati-র মতে, ‘তিনটি জিনিসের অভাব দেখা দিলে গরিবরা তাদের ন্যায়সংগত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এগুলো হলো: ১. সচেতনতা, ২. অধিকার দাবি করা এবং ৩. সম্পদের অপ্রতুলতা।’
আইনগত সহায়তাকে এত দিন রাষ্ট্রের দান বা বদান্যতা মনে করা হলেও আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। গরিব, অসহায় ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আইনি সহায়তা দান করা এখন আর রাষ্ট্রের করুণা বা বদান্যতা নয়। বরং এটি নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের এক অপরিহার্য দায়িত্ব। বর্তমানে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে আইনগত শিক্ষার প্রসার, আইনগত তথ্য সহজলভ্যকরণ, আইনগত ক্ষমতায়ন, ন্যায়বিচারে সহজ অভিগম্যতা, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ইত্যাদিকে আইনগত সহায়তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশে দরিদ্রবান্ধব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম। হাতে গোনা যে দু-একটি প্রতিষ্ঠান কার্যকরভাবে

দরিদ্র ও নিঃস্ব মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে, তার মধ্যে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা অন্যতম। ইদানীং সংস্থার জেলা লিগ্যাল এইড অফিসকে ঘিরে দরিদ্র বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা যেন কোনোভাবেই ভেস্তে না যায়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। স্বল্প সময়ের মধ্যে কার্যকর ও মানসম্মত আইনি সেবা নিশ্চিত করা সংস্থার জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।
সম্প্রতি আইন সংশোধনের মাধ্যমে বিকল্প বিরোধ পদ্ধতিতে মামলা বা বিরোধের নিষ্পত্তিকেও সংস্থার কার্যপরিধির মধ্যে আনা হয়েছে। শুধু বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিই নয়, আইনগত শিক্ষা বিস্তারের পদক্ষেপ গ্রহণ করা, আইনগত তথ্য সহজলভ্য করা, আইনগত মৌলিক ধারণালব্ধ জনগোষ্ঠীর হার বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা, ন্যায়বিচারে সহজ অভিগম্যতা নিশ্চিত করা ইত্যাদি এখন সংস্থার কার্যপরিধিভুক্ত।
মামলাজট ও মামলার দীর্ঘসূত্রতা বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে যেন প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খাচ্ছে। এ দুটি এখন দেশের বিচার বিভাগের অন্যতম প্রধান সমস্যা। এমনকি পিতামহের সময়কালে দায়ের করা মামলা অনেক ক্ষেত্রে নাতির জীবদ্দশায়ও নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না।
ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে সৃষ্ট সব বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কেবল আদালতের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কুফল আমরা এখন ভোগ করছি। ছোটখাটো ও আপসযোগ্য বিরোধসমূহ আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কিংবা মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমাধানের জন্য লিগ্যাল এইড অফিস একটি আদর্শ স্থান হতে পারে।
লিগ্যাল এইড অফিস আদালতের ছায়া হিসেবে কাজ করতে পারে। এতে পক্ষগণের অর্থ ও সময়—দুটিরই সাশ্রয় হয়। আপস-মীমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তিকৃত সমাধানে কোনো পক্ষই হারে না, বরং উভয় পক্ষই জেতে। এভাবে আইনি সেবার পাশাপাশি কার্যকর বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির স্বার্থে লিগ্যাল এইড অফিসের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আইনগত সহায়তা নতুন কিছু নয়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে এটি চালু আছে। রাষ্ট্রীয় খরচে আইনগত সহায়তা পাওয়া অসচ্ছল ও দরিদ্র মানুষের অধিকার। রাষ্ট্র নাগরিকের এ অধিকারের সুরক্ষা দিতে সাংবিধানিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেও দেশের মানুষকে এ অধিকার ফিরে পেতে বহু বছর, যুগ অপেক্ষা করতে হয়েছে।
বাংলাদেশে সরকারি আইন সহায়তা কর্মসূচি এখন বিকাশমান পর্যায়ে রয়েছে। বিকাশমান এ ধারাকে আরও শক্তিশালী ও গতিশীল করতে সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এ জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, বিচারক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী, পেশাজীবী সংগঠনসমূহকে নিষ্ঠার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।

মো. জসিম উদ্দিন: সিনিয়র সহকারী জজ, বর্তমানে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার সহকারী পরিচালক পদে প্রেষণে কর্মরত।