ইতিমধ্যে এই কৌশলগত প্রতিযোগিতার নিদর্শন হিসেবে ভারতীয় নৌবাহিনীর ব্যাপক উন্নয়ন এবং ভারত মহাসাগরে তাদের বলিষ্ঠ অবস্থানের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্র দেশগুলো ভারত মহাসাগরে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে অগ্রসর হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী এবং তার আরও চারটি মিত্র দেশ যেমন ভারত, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর ও জাপান ভারত মহাসাগরে মালাবার নামে একটি বৃহৎ নৌ-মহড়া করে, যার মাধ্যমে এই নৌ-অঞ্চলে প্রথমবারের মতো দুটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার গ্রুপ অবস্থান নেয়। লক্ষণীয় বিষয়, এই মহড়ায় চীনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি এবং তার পরপরই চীনের কৌশলগত চিন্তাবিদেরা তাঁদের লেখায় উল্লেখ করেছিলেন যে ভারত মহাসাগরে তাদের অবস্থান আরও জোরদার করতে হবে এবং কোনোক্রমেই ভারত মহাসাগরকে ‘ভারতের মহাসাগর’ হতে দেওয়া যাবে না। এই কৌশলগত উপলব্ধির কারণেও বর্তমান দক্ষিণ এশিয়ামুখী চীনের এই উদ্যোগটি একটি ধারাবাহিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে লক্ষ করা যাচ্ছে। এসব কারণেই চীন দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত যোগাযোগ স্থাপনে আগ্রহী। আরও লক্ষণীয় যে এই অঞ্চলে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন চীনের দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আকর্ষণ হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়, যা কি না শুধু অর্থনৈতিক বন্দর হবে না বরং প্রয়োজনে সামরিকভাবেও ব্যবহূত হতে পারে।
অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যের দিক থেকেও চীনের দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। শুধু ভারতের কথাই ধরা যাক। ২০০৫ সালে চীন-ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ছিল প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার, যা এ বছর ৭৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে গেছে। তারা আশা করছে, ২০১৫ সালের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। তবে এটা মনে করা হয়তো সমীচীন হবে না যে চীনের দক্ষিণ এশিয়ামুখী নীতি মূলত ভারতের কারণে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাগত দিক থেকে প্রতিযোগী চীন। তাই দক্ষিণ এশিয়া যাতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে চলে না যায়, চীন সে কারণেই নানা উদ্যোগ ও কৌশল নিচ্ছে। কারণ, একই অঞ্চলের দেশ হিসেবে চীন কখনোই চাইবে না যে দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব ক্ষুণ্ন হোক। তবে এটা নতুন বিষয় নয়, বরং চীন এ অঞ্চলে তার কৌশলগত অবস্থান সক্রিয় ও পুনর্নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন কৌশল নিচ্ছে। এসব কিছুর পাশাপাশি, এ অঞ্চলের গুরুত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় সম্প্রতি চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং ক্ষমতা গ্রহণের পর তাঁর বিদেশ সফরের প্রথম দেশ হিসেবে যখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে বেছে নেন। এ সফরের মাধ্যমে প্রকাশিত যৌথ ইশতেহারে চীন একটি চতুর্পাক্ষিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উদ্যোগ যেমন, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, উপ-আঞ্চলিক গোষ্ঠী স্থাপন এবং নতুন অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্থাপনের কথা উল্লেখ করে। এ চিন্তাধারা বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার দ্বারা গঠিত বিসিআইএমেরই একটি নতুন প্রতিফলন। এ উদ্যোগের মাধ্যমে চীন এ অঞ্চলে নতুন অর্থনৈতিক করিডর স্থাপনে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে যাচ্ছে এবং এ উদ্যোগে বাংলাদেশের একটি ফলপ্রসূ অবদান রাখার সুযোগ আছে, যা থেকে আমরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারব।
এবার আসা যাক বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব চীনের কাছে কোনো অংশে কম নয়। বাংলাদেশের যে ভূ-রাজনৈতিক সম্পদ বা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের অবস্থান। তা ছাড়া বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, বিশেষ করে এর চারদিকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র ভারতের অবস্থানের কারণেও চীনের কাছে এর গুরুত্ব অধিক। এমনকি বাংলাদেশকে চীন তার গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করতে চায়, তার অপর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বিরুদ্ধে এই অঞ্চলে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরির জন্য। অর্থনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। এ বছরও দুই দেশের মধ্যে ৩৭ শতাংশ বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েক দশক ধরে চীন বাংলাদেশকে তার আমদানিপ্রধান রাষ্ট্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। এমনকি চীন ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্যের ওপর কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার প্রদান করেছে। সামরিক দিক থেকেও এ দেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক কোনো অংশে পিছিয়ে নেই।
বাংলাদেশ হলো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান দেশ, যা চীনের কাছে থেকে সব সময় সামরিক সুবিধাদি পেয়ে থাকে। ২০১২ সালে চীন ও বাংলাদেশ ‘প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি’ স্বাক্ষর করেছিল সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যেসব ডুবোজাহাজ খুব শিগগির সংযোজিত হবে, তা খুব সম্ভবত চীন থেকে ক্রয় করা হবে। যদিও ধারণা করা হয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি ভারত দ্বারা প্রভাবিত (সদ্য প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের কান্ট্রি রিপোর্ট অনুযায়ী) এবং রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তির বিষয়ে চীনের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে হালকা চিড় ধরেছে বলে বিশেষজ্ঞ মহলে ধারণা করা হচ্ছে, প্রকৃত পক্ষে সে রকমের বড় কোনো ধরনের ধস এখনো নামেনি। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ সম্প্রতি পরিলক্ষিত না হলেও, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বিদ্যমান আদান-প্রদানের যে সম্পর্ক রয়েছে, তাতে আমূল পরিবর্তন আসেনি।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমাগত আগ্রহ শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে না, বরং তা আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতেও সহায়ক হবে। বিশেষ করে, দক্ষিণ এশিয়ার সামষ্টিক বিষয় ভারতকেন্দ্রিক হওয়ার কারণে এতদঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রায়ই বজায় রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। যার কারণে এই অঞ্চলের নীতিগুলো ভারতের স্বার্থে নির্ধারিত হয়। এ ধরনের একমুখী পরিবেশ থেকে বের হয়ে আসার জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের এই নতুন নীতির বলিষ্ঠ উদ্যোগ ফলপ্রসূ অবদান রাখতে পারবে। চীন ইতিমধ্যে সার্কের পর্যবেক্ষক দেশ হিসেবে স্থান নেওয়ার পরও কার্যত তাকে কোনো সক্রিয় ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হয়নি। আশা করা যাচ্ছে, চীনের এই নতুন উদ্যোগের মাধ্যমে চীন সরাসরি সে অবস্থান সৃষ্টি করে নিতে পারবে এবং চীন-দক্ষিণ এশিয়া বহুমাত্রিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে।
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ।