মতামত

তালেবান পুনরুত্থানের দায় যুক্তরাষ্ট্রেরই

রোববার আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালেবান
ছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে অর্ধশতাধিক দেশের সৈন্যরা বিপুল আধুনিক অস্ত্রসম্ভার নিয়ে পুরো দুই দশক ধরে আফগানিস্তানের তালেবান যোদ্ধাদের পরাস্ত করার চেষ্টায় ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে পাততাড়ি গোটাচ্ছে। শুধু সামরিক ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় হয়েছে তা নয়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও হার মানতে হয়েছে। পাশ্চাত্য জোটের সমর্থনপুষ্ট প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সরকার, প্রদেশগুলোর গভর্নররা এবং উপজাতি ও গোত্রপ্রধানেরা প্রায় সবাই বিনা যুদ্ধে তালেবানের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। এই পরাজয়কে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র তার লক্ষ্য অর্জনের পর নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়া বলে দাবি করছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের সায়গন ছেড়ে যাওয়ার জন্য হেলিকপ্টারে ওঠার প্রতিযোগিতার সেই দৃশ্যের সঙ্গে কাবুলের দূতাবাস থেকে মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার তুলনা নাকচ করে আফগানিস্তানে তাঁদের লক্ষ্য অর্জনের এই দাবি জানান।

প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি যখন কাবুলে তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাঁর নিরাপদে দেশত্যাগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করছিলেন, রোববার প্রায় একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের কাছে এই লক্ষ্য অর্জনের দাবি করেছেন। তিনি বলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল আল-কায়েদা যাতে যুক্তরাষ্ট্রে ভবিষ্যতে আর কোনো হামলা করতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে তাদের অক্ষম করে দেওয়া। আল-কায়েদা এখন আর কোনো হুমকি নয়। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের আর কোনো স্বার্থ নেই, যার জন্য সেখানে সামরিক উপস্থিতি দীর্ঘায়িত করতে হবে দাবি করে ব্লিঙ্কেন বলেন, বাইডেন প্রশাসন যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেছে, তখনই তালেবান অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে না নিলে আবারও বড় আকারে সেনা মোতায়েন করা প্রয়োজন হতো এবং সামরিক সংঘাত দীর্ঘায়িত হতো। কোনো মার্কিন নাগরিকই তা চান না বলে তিনি মন্তব্য করেন।

আফগানিস্তানে গত দুই দশকে যেসব রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ‍সূচনা হয়েছিল, সেগুলো সবই এখন নস্যাৎ হয়ে যাবে এবং তালেবান শাসন আবার দেশটিকে পশ্চাৎমুখী করবে বলে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, ব্লিঙ্কেন তা নাকচ না করলেও দাবি করেন যে দেশটির ভবিষ্যৎ আফগান সরকার, জনগণ ও তালেবানের ওপর নির্ভর করে। তালেবান সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ব্লিঙ্কেন বলেন, যেকোনো ধরনের নৃশংসতা ও বাড়াবাড়ি হলে আন্তর্জাতিক সহায়তা বন্ধ হয়ে যাবে। তালেবান নেতাদের ওপর যে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আছে, তা বহাল থাকবে। সুতরাং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা পেতে হলে তালেবান তার নীতি ও অবস্থান বদলাতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানের যে রাজনৈতিক আলোচনা কয়েক বছর ধরে চলছিল, সেই আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র যে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি, তা মোটামুটি এখন স্পষ্ট। কাতারকে মধ্যস্থতায় ভূমিকা গ্রহণের দায়িত্ব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদাইয়ের মুক্তির ব্যবস্থা করেছিল ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে। সম্ভবত মোল্লা বারাদাইকে মুক্তি দেওয়ার মাধ্যমেই সম্ভবত তালেবানের পুনরুত্থানের পথ উন্মোচিত হয়ে যায়। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে মোল্লা বারাদাই কাতারে তালেবানের রাজনৈতিক দপ্তরপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তালেবানের প্রয়াত প্রধান মোল্লা ওমরের ভগ্নিপতি মোল্লা বারাদাই ২০১০ সালে পাকিস্তানের করাচিতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই তালেবানের সামরিক কৌশলবিদ ও অধিনায়ক হিসেবে পরিচিতি পান। তবে তিনি সেই সময়েও রাজনৈতিক সংলাপের পক্ষে ছিলেন। আফগানিস্তানের উরুগজান প্রদেশে ঢেরাউড জেলায় জন্মগ্রহণকারী মোল্লা বারাদাই ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই উভয়েই দুররানি গোত্রের লোক হওয়ায় তাঁদের মধ্যে যোগসূত্র ছিল। হামিদ কারজাইয়ের ভাই ওয়ালি কারজাইয়ের মাধ্যমে তাঁদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক সংলাপের কথাও শোনা যায়। যে কারণে পাকিস্তান তাঁকে গ্রেপ্তার করায় কারজাই সরকারের সঙ্গে অঘোষিত টানাপোড়েন তৈরি হয়েছিল।

আফগান সামরিক বাহিনীর বিনা লড়াইয়ে আত্মসমর্পণ এবং তালেবানের নাটকীয় ক্ষিপ্রতায় পুরো দেশ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য আপাতদৃশ্যে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সেপ্টেম্বরের আগেই সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন করার ঘোষণাকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন বলছেন যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তালেবানের সঙ্গে যে সমঝোতা করেছিলেন, তাতে মে মাসের মধ্যে সেনা প্রত্যাহার শুরুর অঙ্গীকার করা হয়েছিল।

আফগানিস্তান ছেড়ে যাচ্ছে মার্কিন সেনারা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার সাড়ে তিন মাসের মাথায় দেশটি দখলে নিল তালেবান

তিনি বলেন, বাইডেন প্রশাসন জানুয়ারি মাসে ক্ষমতা গ্রহণের আগেই তালেবান আফগানিস্তানে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে এবং মে মাসে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু না হলে সংঘাত বৃদ্ধি পেত। ব্লিঙ্কেনের বক্তব্যে স্পষ্টতই যে ব্যাখ্যা মেলে, তা হচ্ছে আফগানিস্তানে লড়াই চালানোর মতো মনোবল ও ধৈর্য তাদের তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল।

আফগানিস্তানে পাশ্চাত্য জোটের এই পশ্চাদপসরণ এবং আফগান সরকারের নাটকীয় পতনের প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকা এবং ইউরোপের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের মধ্যে ব্যাপক হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এঁদের অনেকেই সরকারের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন যে লজ্জায় তাঁদের মাথা কাটা যাচ্ছে। কয়েক দিন আগেই ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রকাশ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এর ফলে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়বে। ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন দল কনজারভেটিভ পার্টির এমপি এবং পররাষ্ট্রবিষয়ক পার্লামেন্টারি কমিটির প্রধান টম টুগেনহাট বলেন, সুয়েজ খালের বিপর্যয়ের পর আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার হচ্ছে পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। টম টুগেনহাট রাজনীতিতে আসার আগে নিজে আফগানিস্তানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছেন।

পাশ্চাত্যের রাজনীতিক ও বিশেষজ্ঞদের প্রধান উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে আফগানিস্তানে তালেবানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কারণে যাঁরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন, তাঁদের নিরাপত্তা ও সহায়তা দেওয়ার চাপ। এঁদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া ও পুনর্বাসনের জন্য যথেষ্ট ভূমিকা না নেওয়ায় পাশ্চাত্যের সরকারগুলো বেশ কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছে। সর্বোপরি তাঁদের উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, ইসলামি উগ্রবাদ ও জঙ্গি তৎপরতা নতুন করে মাথাচাড়া দেওয়ার আশঙ্কা। এ ক্ষেত্রে অনেকেই ইরাকের উদাহরণ টেনে বলেছেন, সেখান থেকে প্রত্যাহারের পর যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেকেই জন্ম নিয়েছিল ইসলামিক স্টেট বা আইএস। আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারের পরিণতিতে একই ধরনের আশঙ্কা তাঁরা নাকচ করবেন কীভাবে?