তামাক অকালমৃত্যু ঘটায়। কার্যকরভাবে করারোপের মাধ্যমে তামাকপণ্যের দাম বাড়িয়ে এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু রোধ করা সম্ভব। অর্থনীতির নিয়মে দরিদ্র জনগোষ্ঠী পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতি অধিক সংবেদনশীল অর্থাৎ সাধারণভাবে পণ্যের দাম বাড়লে ধনীর তুলনায় গরিব মানুষের মধ্যে পণ্যের ব্যবহার হ্রাস পায় বেশি হারে। তামাকপণ্যের দাম বাড়লেও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাকের ব্যবহার অধিক হারে হ্রাস পায়। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ অনুযায়ী, ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে অর্থাৎ ৮ বছরে বাংলাদেশে একজন বিড়ি ব্যবহারকারীর বিড়ি বাবদ মাসিক খরচ বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। এবং এই একই সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিড়ির ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে ৫৫ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ করারোপের মাধ্যমে তামাকপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করা হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর এর ইতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে। দাম বাড়লে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাক ব্যবহারের প্রবণতা অধিক হারে হ্রাস পায়। ফলে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা কমে যায় এবং অকালমৃত্যু হ্রাসসহ তামাক ব্যবহারজনিত রোগে চিকিৎসা ব্যয় হ্রাস পায় এবং সরকারের স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় কমে যায়।
তামাক ব্যবহারজনিত অসুস্থতা এবং অকালমৃত্যুর কারণে দরিদ্র গৃহস্থালিতে উৎপাদনশীলতা এবং আয়সংক্রান্ত যে ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে, তা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়। কাজেই তামাকপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সাময়িকভাবে ভোক্তার আয়ের ওপর কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব ফেললেও তা মূলত ভোক্তার দারিদ্র্য হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
গ্যাটস ২০১৭ অনুযায়ী একজন সিগারেট ব্যবহারকারীর সিগারেট বাবদ মাসিক গড় ব্যয় ১০৭৭ দশমিক ৭ টাকা। অথচ শিক্ষা ও চিকিৎসা বাবদ একটি পরিবারের মাসিক গড় ব্যয় যথাক্রমে মাত্র ৮৩৫ দশমিক ৭ এবং ৭০০ টাকা (খানা আয়-ব্যয় জরিপ, ২০১৬)। তামাকের জন্য ব্যয়িত এই অর্থ পরিবারগুলোর শিক্ষা ও চিকিৎসা দারিদ্র্য মোকাবিলায় ব্যয় করা গেলে তা নিঃসন্দেহে এসডিজির দারিদ্র্য নির্মূলবিষয়ক লক্ষ্য-১ অর্জনে অবদান রাখবে।
তামাক দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আরও দরিদ্র করে ফেলে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এবং ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের একদল গবেষক বাংলাদেশে গৃহস্থালি ব্যয়ের ক্ষেত্রে তামাকের পেছনে ব্যয়ের ক্রাউডিং আউট প্রভাববিষয়ক গবেষণায় দেখিয়েছেন তামাক ব্যবহারকারী পরিবারগুলোকে তামাকমুক্ত পরিবারের তুলনায় শিক্ষা, বস্ত্র, বাসস্থান, জ্বালানি এবং যাতায়াতের চেয়ে চিকিৎসায় অনেক বেশি ব্যয় করতে হয়। এ ছাড়া তামাকের ব্যবহার স্বাস্থ্য ব্যয় বৃদ্ধি, আয় ও উৎপাদনশীলতা হ্রাস এবং একই সঙ্গে পুষ্টি ও শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যয় সীমিত করার মাধ্যমে পরিবারগুলোকে ক্রমশ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর করে ফেলে (টোব্যাকো অ্যান্ড পভার্টি, টোব্যাকোনোমিকস পলিসি ব্রিফ, ২০১৮)।
বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার খুবই উদ্বেগজনক। সর্বশেষ গ্লোবাল অ্যাডাল্ট সার্ভে, ২০১৭ অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫ বছর তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ, সংখ্যায় যা ৩ কোটি ৭৮ লাখ। বড় উদ্বেগের বিষয় হলো হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৪৮ শতাংশ, যেখানে অতি উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই হার মাত্র ২৪ শতাংশ। শহরের (২৯ দশমিক ৯ শতাংশ) তুলনায় গ্রামে বসবাসকারীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারকারীর হার অনেক বেশি ৩৭ দশমিক ১ শতাংশ।
এই সবকিছুই ইঙ্গিত করে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহারের অধিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তামাকপণ্যের দাম বাড়িয়ে এসব জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে নিয়ে যেতে হবে। এই বিষপণ্য সহজলভ্য করে আমরা দরিদ্র জনগণকে মেরে ফেলতে পারি না। সুস্থভাবে বেঁচে থাকা সবার মৌলিক অধিকার এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ মারা যায় তামাক ব্যবহারজনিত রোগে। এই প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুরোধে রাষ্ট্রকে অধিকতর মনোযোগী হতে হবে।
করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্য খাতের পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি নাজুক অবস্থায় রয়েছে। তবে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে স্বল্প আয়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠী। তামাকাসক্ত ব্যক্তির করোনা সংক্রমণে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এ সময় দরিদ্র তামাক ব্যবহারকারীরা করোনায় আক্রান্ত হলে তা হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। সুতরাং এখনই সময় আমাদের তামাক কর ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কর আরোপ হতে পারে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা, যেখানে তামাকপণ্যের দাম ক্রমেই সব শ্রেণির মানুষের বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। কমবে ব্যবহার, বাঁচবে জীবন, বাড়বে রাজস্ব আয়।
এ বি এম জুবায়ের প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক
basharzubair@hotmail.com