ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত
ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত

মধ্যপ্রাচ্য

তাঁরা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন

ব্যবসা-বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকার পরও এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের গভীর মতবিরোধ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ ছাড়া আরও অনেক পারিপার্শ্বিক অবস্থা থাকতে পারে, যার ফলে দুটি দেশের সম্পর্ক নিষ্ফলা হয়ে ওঠে। যেমন উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার কার্যত কোনো সম্পর্ক নেই। ভেনেজুয়েলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমানে কোনো সম্পর্ক নেই। কিউবার সঙ্গে কিছুদিন আগেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিল না। অন্যদিকে ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক নেই। কাতারের সঙ্গে সৌদি আরবের প্রায় সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। এ ছাড়া ইসরায়েলের সঙ্গে আরব বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের সম্পর্ক নেই।

বিবদমান দুই দেশের মধ্যে আলোচনা শুরু হলে বরাবরই যে প্রশ্নটি সামনে আসে, সেটি হলো ‘মন্দ তৎপরতা’ চালানো দেশটির সঙ্গে কখন স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে বা কখন তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।

যেসব দেশের সরকার বারবার আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে, গণহত্যা বা অন্য কোনো ধরনের নিপীড়ন চালায় কিংবা এমন কোনো আচরণ করে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গুরুতর শাস্তিযোগ্য অপরাধ, ঐতিহাসিকভাবে সেসব দেশের সঙ্গে অন্য দেশগুলো সম্পর্ক ছিন্ন করে থাকে। এ ক্ষেত্রে নাৎসি জার্মানির কথা অপরিহার্যভাবে এসে পড়ে। কিউবায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পরমাণু অস্ত্র স্থাপনের চেষ্টা করার পর পশ্চিমা দেশগুলো তার সঙ্গে সম্পর্ক সীমিত করে ফেলেছিল। ইরানের নেতারা নিয়মিতভাবে ইসরায়েলকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার হুমকি দেওয়ায় ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলসহ বহু দেশ সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।

ইসরায়েল বারবার আন্তর্জাতিক বিধি লঙ্ঘন করেছে, বারবার বর্ণবাদী বাগাড়ম্বর চালিয়ে আসছে এবং তার নিয়ন্ত্রণে থাকা একটি জনগোষ্ঠীর ওপর যুগ যুগ ধরে উৎপীড়ন চালাচ্ছে। এ কারণে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আরব দেশগুলো ইসরায়েলের বিষয়ে যে ঐতিহাসিক অবস্থান নিয়েছে, তা কি ন্যায্য নয়? ইসরায়েল তার ইহুদি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে গণতান্ত্রিক আচরণ করলেও ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ভূখণ্ড দখল করাকে নীতি হিসেবে নিয়েছে। জাতিসংঘ ফিলিস্তিনের যেসব এলাকায় পতাকা টাঙিয়ে এলাকাগুলোকে আন্তর্জাতিক নজরদারিভুক্ত জায়গা হিসেবে ঘোষণা করেছে, সেসব জায়গাও দখল করে নিচ্ছে ইসরায়েল।

ইসরায়েলকে তার এই আগ্রাসী মনোভাব থেকে সরিয়ে আনার জন্য মুসলিম দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে একটি নীতি মেনে আসছে। ২০০২ সালে সৌদি আরবের উদ্যোগে ওআইসি আরব শান্তি উদ্যোগ নামে একটি পদক্ষেপ নিয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের যে ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছিল, তা যদি তারা ফেরত দেয়, তাহলে মুসলিম বিশ্ব ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করবে।

১৯৬৭ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ২৪২ নম্বর রেজল্যুশনের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বলেছে, ‘যুদ্ধের মাধ্যমে ভূমি দখল করে নেওয়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ আছে। ইসরায়েলকে তার দখল করা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে।’

তারপর থেকে ইসরায়েলকে শুধু আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে বলা হচ্ছে। ১৯৬৭ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ২৪২ নম্বর রেজল্যুশনের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বলেছে, ‘যুদ্ধের মাধ্যমে ভূমি দখল করে নেওয়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ আছে। ইসরায়েলকে তার দখল করা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে।’

আরব লিগ জাতিসংঘের সেই ভাষ্যকে স্বাগত জানিয়ে বলে এসেছে, ফিলিস্তিনের জায়গা ফিরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলের সঙ্গে আরব লিগভুক্ত দেশগুলোর স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন অসম্ভব। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আরব লিগের পক্ষ থেকে এরপর অনেক উদার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনের কাঠামো অনুসরণ করে দেওয়া কোনো আন্তর্জাতিক প্রস্তাবই ইসরায়েল গ্রহণ করেনি। শুধু তা–ই নয়, তারা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটিয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নজরদারিতে ফিলিস্তিনে অবৈধ ইহুদি বসতির বিস্তার ঘটানো হয়েছে, আরও অধিকসংখ্যক ইহুদির বসতি নিশ্চিত করতে ধারাবাহিকভাবে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের এই পদক্ষেপকে আরব বিশ্ব যদি বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখে, তা একেবারে অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না

ইসরায়েল যখন এই আগ্রাসী কর্মকাণ্ড বাড়িয়ে দিয়েছে, ঠিক তখনই বিশ্বের সমস্ত মুসলিমকে হতবাক করে দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দিয়েছে। মাত্র ১৪ লাখ নাগরিকের এই দেশ ৪২ কোটি ৩০ লাখ আরব এবং ১৮০ কোটি মুসলমানের হৃদয় ভেঙে দিয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই ঘোষণার মাত্র এক মাস পর ১৬ লাখ নাগরিকের দেশ বাহরাইন ঠিক একই ঘোষণা দিয়েছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের এই ঘোষণাকে মুসলিম বিশ্ব চরম বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছে, ইসরায়েলের সঙ্গে মুসলিম দেশগুলো সম্পর্ক স্বাভাবিক করলে শান্তি প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের একটা সুযোগ তৈরি হবে এবং ইসরায়েল একতরফাভাবে আর ফিলিস্তিনে বসতি গড়ার সুযোগ পাবে না। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের এযাবৎকালের অভিজ্ঞতা বলে, এতে ইসরায়েল তার ভূমি দখলের মনোভাব থেকে সরে আসবে না। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইতিমধ্যেই তা পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনে আমাদের সম্প্রসারণ থামবে না।’

ইসরায়েল বারবার আন্তর্জাতিক বিধি লঙ্ঘন করেছে, বারবার বর্ণবাদী বাগাড়ম্বর চালিয়ে আসছে এবং তার নিয়ন্ত্রণে থাকা একটি জনগোষ্ঠীর ওপর যুগ যুগ ধরে উৎপীড়ন চালাচ্ছে। এ কারণে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আরব দেশগুলো ইসরায়েলের বিষয়ে যে ঐতিহাসিক অবস্থান নিয়েছে, তা কি ন্যায্য নয়?

তার মানে, সংযুক্ত আরব আমিরাত শান্তির জন্য যে স্বাভাবিকীকরণের কথা বলছে, তা আর ধোপে টিকছে না। এমনকি বাহরাইন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দেওয়ার পর নেতানিয়াহু আবার দম্ভের সঙ্গে সেই একই কথা বলেছেন।

ফলে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের এই পদক্ষেপকে আরব বিশ্ব যদি বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখে, তা একেবারে অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

দাউদ কাত্তাব: ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ও প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির সাবেক অধ্যাপক