যেকোনো কাজই দুইভাবে করা যায়। দায়সারা গোছে অথবা সুষ্ঠুভাবে। সুচারুরূপে কাজ সম্পন্ন করাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘গৃহিণীপনা’। আমাদের দেশে গুরুদায়িত্বপূর্ণ উঁচু পদ পেতে অনেকেই আগ্রহী, কিন্তু ওই পদের যে দায়িত্ব তা সুষ্ঠুভাবে পালনের প্রয়োজন বোধ করেন না তাঁরা।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাঁরা রেলমন্ত্রী, তাঁদের স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটের সেই কেটলি ও তার ঢাকনির গল্প জানার দরকার নেই। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কর্তাও আধুনিক ট্রেনের ইঞ্জিন দেখলে তাজ্জব হয়ে যেতেন। আঠারো শতকে ইউরোপের শিল্পবিপ্লবে রেলযোগাযোগের ভূমিকার কথা সবাই জানেন। একটি রেলগাড়ির নাট-বল্টু ঠিকঠাক আছে কি না তা দেখাশোনা করার কাজটি রেলের কর্মচারীরা করে থাকেন। তাঁদের সেই কর্তব্যে তাঁরা অবহেলা করলে শাস্তি তাঁদের প্রাপ্য। সে শাস্তি হতে পারে লঘু, যেমন তিরস্কার; হতে পারে মাঝারি, যেমন ইনক্রিমেন্ট বন্ধ; কিংবা কঠিন, যেমন পদমর্যাদা হ্রাস বা চাকরিচ্যুতি। কিন্তু সামগ্রিক রেল যোগাযোগব্যবস্থার অবনতির দায় বিশেষ কোনো কর্মকর্তার নয়—রেলমন্ত্রীর।
রেলে পরপর দুটি দুর্ঘটনা ঘটল। একটিতে ১৭ জনের মৃত্যু এবং আহত অনেক। আরেকটিতে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। তাতে ইঞ্জিন ছিন্ন হয়ে রেললাইনের পাশে পড়ে উল্টে যায় এবং তাতে আগুন ধরে যায়। একটির অকুস্থল কসবা, আরেকটির উল্লাপাড়া। প্রথমটির ঘটনায় পাঁচটি তদন্ত কমিটি, পরেরটির তিনটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। বস্তুত দুর্ঘটনার বারো আনা তদন্ত মিডিয়াই সঙ্গে সঙ্গে করেছে। অবশিষ্ট চার আনা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যেতে পারে। দোষী ব্যক্তিরা যদি শাস্তি পান, তাহলেই বা রেলের কী হবে? হতাহতদের তাতে কী লাভ?
বাংলাদেশে সব ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে, ট্রেন দুর্ঘটনা দুটির ক্ষেত্রেও তা হলো। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার আগেই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে ‘দুরভিসন্ধি’, ‘চক্রান্ত’, ‘ষড়যন্ত্র’ বলে সন্দেহের কথা উচ্চারিত হয়েছে। যদি তা হয়েও থাকে, তা নিয়ে বলাবলির চেয়ে চক্রান্তকারীদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়াই কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। চক্রান্ত সরকারি দলের লোকেরা করে না। সরকারবিরোধীরা করে।
দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। সারা পৃথিবীতেই তা ঘটে। এবং নানা কারণে ঘটতে পারে। যান্ত্রিক বা অবকাঠামোগত কারণে ঘটতে পারে। ব্যক্তির ভুলে হতে পারে। প্রাকৃতিক কারণে হতে পারে। যেমন ঝড়-বৃষ্টিতে লাইনের ওপর হঠাৎ গাছপালা উপড়ে পড়ল। আর একটি হতে পারে ষড়যন্ত্রে। সেটা গুরুতর অপরাধ। আমাদের দায়িত্বশীলতা প্রশ্নাতীত।
দুই দুর্ঘটনায় আট তদন্ত কমিটি গঠন করায় দেশবাসীর ধারণা হতে পারে আমরা সকল কাজের কাজি। কিন্তু যাঁরা সব ব্যাপারেই সংশয়বাদী, তাঁরা বলবেন তদন্ত কমিটি আটটিই হোক বা ষোলোটিই হোক, তাতে রেল বিভাগের বা রেলযোগাযোগব্যবস্থার এক ছটাক উন্নতি হবে কি না? এই বিভাগের উন্নতি করতে হলে ‘কমিটি’ করতে হবে মাত্র একটি, যার কাজ হবে রেলের সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা করে সমস্যাগুলো শনাক্ত করা, সেসব সমাধানে বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তা দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন।
রেল আমাদের রাষ্ট্রের সতিনের ছেলে। অযত্নে-অবহেলায় হাড়জিরজিরে শরীরে সে কোনো রকমে ঝিকঝিক করে চলছে বটে, কিন্তু তার না আছে শক্তি, না আছে শ্রী। রেলের জিনিসপত্র রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা অতি শোচনীয়। রেলের জমিগুলো লাখেরাজ সম্পত্তি, যার মনে জোর আছে, পেশিতে বল আছে এবং উপযুক্ত মামু আছে, রেলের জমি দখল তাঁর জন্য কোনো ব্যাপারই নয়। মন্ত্রীদের পত্নীরা চাইলে রেলের জমি ওয়াক্ফ সম্পত্তির মতো ব্যবহার করতে পারেন।
রেলের রিপু বহু। একসময় তার বড় শত্রু ছিল বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী। দেশটা বাংলাদেশিদের। ট্রেনে হোক, নৌযানে হোক, মোটরগাড়িতে হোক, যাতায়াত করে বাংলাদেশের মানুষ। কিন্তু ফতোয়া দিল বিশ্বব্যাংক। রেলগাড়ি ভালো না; বাস, মোটরগাড়ি ইত্যাদি খুব ভালো। তাদের কুপরামর্শে অনেকগুলো রেললাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়। রেললাইনগুলো ধ্বংস হতে থাকে, সড়কের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংক ঢালতে থাকে টাকা। না চাইতেই ঋণ পাওয়া যায়। আনন্দে বগল বাজাতে থাকেন জাপানসহ বিভিন্ন দেশের মোটরযান উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। সত্তর ও আশির দশকের দুই সামরিক সরকার খুশিতে আটখানা। সমস্ত মনোযোগ সড়কে। পরিবহন ব্যবসায়ীরা আনন্দে আত্মহারা। যার পরিণতিতে আজ সড়কে এমন বিশৃঙ্খলা। সড়কের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা আদৌ সম্ভব হবে, সে আশা দুরাশা মাত্র।
পূর্ববর্তী সব সরকারের তুলনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার রেল বিভাগে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দিয়ে আসছে। এ পর্যন্ত ৫০ হাজার কোটি টাকা রেলের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২৩৬ কিলোমিটার রেলপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সেগুলোর বেশ কয়েকটি বর্তমান সরকার সংস্কার করে চালু করেছে। তবে বেশি টাকা বরাদ্দই রেলের উন্নতির নিশ্চয়তা নয়। সঠিক জায়গায় সততার সঙ্গে টাকাটা ব্যয় হলো কি না, তা থেকে জনগণ উপকৃত হলো কি না, সেটাই বড়।
বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে, যেখানে অধিকাংশ মানুষের আর্থিক সংগতি সীমিত, সেখানে রেলই হওয়ার কথা প্রধান যোগাযোগমাধ্যম। এটি অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো নয়। রেল সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এখানে মুনাফার প্রশ্ন বড় নয়, মানুষকে সুবিধা দেওয়াটাই বড়। যাত্রী ট্রেনে রেল বিভাগ লাভ করতে পারে না। রেল মুনাফা যতটা করে তা মালবাহী ট্রেন থেকে। অন্যদিকে ট্রেনে মাল পরিবহন সড়কে পরিবহনের চেয়ে সস্তা। সেদিক থেকে ব্যবসায়ী ও জনগণ উভয়েই উপকৃত হয়। একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। নরসিংদী কলা উৎপাদনকারী এলাকা। স্বাধীনতার আগে এবং পরেও অনেক দিন ভোররাতে নরসিংদী থেকে ঢাকায় একটি মালবাহী ট্রেনে কলা পরিবহন করা হতো—বিনা ভাড়ায় অথবা নামমাত্র ভাড়ায়। তাতে কলা উৎপাদনকারী কৃষক ও জনগণ উপকৃত হয়েছে।
বাংলাদেশ আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রতি জোর দিয়েছে। কৃষি ও শিল্পে উন্নয়ন হচ্ছেও। কিন্তু সেই উন্নয়নের সুবিধা সাধারণ মানুষ ভোগ করতে পারছে না। উত্তরবঙ্গের চাল ও কৃষিজাত পণ্য যদি সড়কপথের চেয়ে রেলপথে ঢাকায় আসত, পণ্যের মূল্য হতো অনেক কম। ব্যবসায়ীদের পথে পথে চাঁদা দিতে হতো না। পরিবহন ব্যয় কম পড়ায় ক্রেতা কম দামে কিনতে পারত। পরিবহনে সময়ও লাগত কম।
রেল বিভাগের দুর্নীতি নিয়ে কথা কম বলাই ভালো। সরকার বলতে পারে: প্রমাণ দাও। খবরের কাগজের লিখিয়েদের পক্ষে সব সময় হাতে-কলমে প্রমাণ দেওয়া সম্ভব নয়। তবে পথে যেতে কোথাও কোনো কালো বিড়াল চোখে পড়লে বাংলাদেশের রেল বিভাগ চোখে ভাসে।
কর্তৃপক্ষ থেকে যদি দাবি করা হয় রেলে ‘কালো বিড়াল’ বলতে কিছু নেই, সেখানে সব সাদা; বলার কিছু নেই। কিন্তু রেললাইনের কী দশা, কয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে, রেললাইন দিয়ে চলা ট্রেনের ভেতরের কী অবস্থা, তা যারা তাতে যাতায়াত করতে বাধ্য, তারা ছাড়া আর কাউকে বোঝানো যাবে না। কোনো ঘটনা ঘটামাত্র অনেকগুলো তদন্ত কমিটি গঠন করে কোনো লাভ নেই। তাতে কর্মকর্তাদের কর্মঘণ্টাই শুধু নষ্ট হয়, কাজের কাজ কিছু হয় না। যেকোনো তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনই একটি রচনা। তা সুখপাঠ্য হলে কেউ পাঠ করতে পারেন, রচনার বিষয়বস্তুর নিজের কোনো ক্ষমতা নেই। যা করা দরকার তা হলো, কথা কম বলে, রচনা লেখায় সময় নষ্ট না করে, রেলকে সময়ের উপযোগী করতে সঠিক কাজটি করা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক