৪ সেপ্টেম্বর শুক্রবার নারায়ণগঞ্জে বাইতুস সালাত মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হয়নি। এখনো পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ২৮। হাসপাতালে ভর্তি আছেন আরও আটজন, তাঁরাও শঙ্কামুক্ত নন। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, এমন পোড়া রোগী তিনি আগে কখনো দেখেননি। এদিকে বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানে জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ও ডিপিডিসি পাঁচটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে কাজ করছে। জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি গণশুনানিরও আয়োজন করেছে।
কেন এ বিস্ফোরণ?
বিস্ফোরণে মসজিদের ছয়টি এসি পুড়ে যায়। উড়ে যায় জানালার কাচ। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো অনলাইন সংবাদমাধ্যম আর তার পরদিনের ছাপা মাধ্যমে খবর রটে, এয়ারকন্ডিশন যন্ত্রে বিস্ফোরণ হয়েছে। এটা ঠিক যে প্রথমে সবকিছু ঠিকঠাক জানা যায় না, কিন্তু খবর ধরতে হয়। কিন্তু চিলের পেছনে ছোটার আগে কানে একবার হাত দিয়ে দেখতে বেশি সময় লাগে কি? এয়ারকন্ডিশনার কি সহজে বিস্ফোরিত হয়? কম্প্রেসরের ফ্রেয়ন গ্যাস দাহ্য নয়। কম্প্রেসর বিস্ফোরিত হলে একসঙ্গে ছয়টি কেন হবে? এসব প্রশ্নের যাচাই-বাছাইয়ের সময় না থাকলে খবরের শিরোনাম শুধু এটাই হতে পারত, ‘মসজিদ বিস্ফোরণ’।
ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ জানিয়েছে, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট ও পাইপলাইনের লিকেজ থেকে গ্যাস জমে এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। বিস্ফোরণের তিন–চার দিন পর মসজিদের পাশে তিতাস গ্যাসের কর্মীরা মাটি খুঁড়ে গ্যাসের লাইন পরীক্ষার কাজ শুরু করে। এখন পর্যন্ত মসজিদের পাশে গ্যাসের লাইনে সব মিলিয়ে ছয়টি ছিদ্র পাওয়া গেছে বলে তিতাস গ্যাসের উন্নয়ন ও পরিকল্পনাবিষয়ক দপ্তর জানিয়েছে। সেগুলো বন্ধ করা হয়েছে।
মসজিদটির মেঝের নিচে গ্যাসলাইন ফুটো হয়ে অনেক দিন ধরে গ্যাস বের হচ্ছিল এবং তা ঠিক করতে তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা ঘুষ চেয়েছিলেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
গ্যাসের সঙ্গে অডোর্যান্ট মেশানো হয়েছিল?
গ্যাসের পাইপ পানির নিচে থাকলে বুদ্বুদ ওঠে। সেটা দেখে জানা যায়, গ্যাস বেরিয়ে আসছে। কিন্তু যেখানে পানি নেই তবে পাইপের জাল বিছিয়ে বাড়ি বাড়ি, রেস্তোরাঁয়, কলকারখানায় গ্যাস সরবরাহ করা হয়; সেখানে বোঝার উপায় কী? গ্যাস বিতরণের আদিকাল থেকেই গ্যাস সরবরাহ নিরাপদ করার জন্য গ্যাসের সঙ্গে অডোর্যান্ট (odorant) গন্ধ মেশানো হয়। বড় পাইপ থেকে ছোট সরবরাহ পাইপে গ্যাস (১৫০ পিসিআইজি থেকে ৫০ পিসিআইজি) চালান করার আগেই গ্যাসের সঙ্গে অডোর্যান্ট মিশিয়ে দেওয়া হয়।
আমরা যেটা গ্যাসের গন্ধ বলি, সেটা আসলে অডোর্যান্টের গন্ধ। এই গন্ধ এতটাই কটু যে একদম ‘গন্ধ অন্ধ’ ব্যক্তিও সেটা টের পান। এখন পর্যন্ত যে আলামত মিলেছে, তাতে এটা প্রায় নিশ্চিত যে গ্যাসের ফুটো থেকে বেরোনো গ্যাস মসজিদে জমা হয়ে বিস্ফোরণের একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার পথে লাইন বদলানোর সময় (দুটি বিদ্যুৎ–সংযোগ ছিল) কোথাও কোনো শর্টসার্কিটের ঝমেলা থেকে তৈরি বিদ্যুতের ছটা এ বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। তবে অডোর্যান্টের গন্ধ এতটাই কটু আর ঝাঁজালো যে সেটাকে অগ্রাহ্য করে ১৫–২০ মিনিট দরজা–জানালা আটকানো মসজিদে অবস্থান করা বেশ কষ্টের। তবে কি গ্যাসের সঙ্গে অডোর্যান্ট মেশানো বন্ধ রেখেছিল কর্তৃপক্ষ? নারায়ণগঞ্জের তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের এই বদনাম কিন্তু আগেও ছিল বলে অনেকে জানিয়েছেন। অবৈধ সংযোগ আর সংযোগে ব্যবহৃত মালামালের গুণগত মান ঠিক না রাখলে সরবরাহ লাইনে ফুটো হবে, অডোর্যান্ট থাকলে সেটা সহজে জানাজানি হয়ে যাবে। কাজেই ওটা মেশানো হয়েছিল কি না, তা জানা দরকার।
গ্যাসের লাইনে এত ছিদ্র?
গত বছর চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় গ্যাস বিস্ফোরণে সাতজনের মৃত্যু হয়। শুধু চট্টগ্রামেই ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৯-এর ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত মোট পাঁচটি বিস্ফোরণে মারা যান কমপক্ষে ১২ জন। আহত বেশুমার। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সারা দেশের বছরওয়ারি গ্যাস দুর্ঘটনায় নিহতের হিসাবে ছিল ২০১৬ সালে ৪ জন, ২০১৭ সালে ৫ জন, ২০১৮ সালে ১৯ জন ও চলতি বছরে ৩২ জন। চট্টগ্রামের পাথরঘাটা বিস্ফোরণের পরও কারণ অনুসন্ধানে জেলা প্রশাসন, কেজিডিসিএল ও সিডিএর উদ্যোগে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তা ছাড়া ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ কদমতলীতে গ্যাসলাইনে বিস্ফোরণে দগ্ধ হন দুজন। ৩০ জুন ২০১৯ রাজধানীর গ্রিন রোড এলাকায় গ্যাসলাইন বিস্ফোরণের ঘটনায় চারজন দগ্ধ হয়েছিলেন।
গত বছর একুশে ফেব্রুয়ারির আগের দিন রাজধানীর আসাদগেটের আড়ং মোড়ে গ্যাসলাইনে বিস্ফোরণে দুটি গাড়িতে আগুন লেগে যায়। সেদিন ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণকক্ষের কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, সড়কের একটি ম্যানহোলের ওপর একটি বাস থামলে, গ্যাসলাইনে বিস্ফোরণ ঘটে এবং আগুন লেগে যায়। এ সময় পেছনে থাকা একটি পিকআপ ভ্যানেও আগুন ধরে যায়। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভান। যদি এটা যানজটের সময় ঘটত আর ফায়ার সার্ভিস অফিসের লাগোয়া না হতো, তাহলে কী অবস্থা হতো ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।
প্রায় একই রকম বিস্ফোরণ ঘটে এ বছরের ২৮ ফেরুয়ারি। ঢাকা–ময়মনসিংহ সড়কের উত্তরা পয়েন্টে ঘটে যাওয়া সে বিস্ফোরণে কেউ প্রাণ হারাননি। ফায়ার সার্ভিসের কন্ট্রোল রুমের কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী, গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকে এ বিস্ফোরণ ঘটে। দ্রুত আগুন নেভানো গেলেও তখন পর্যন্ত লিকেজ থেকে গ্যাস বের হচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছিলেন।
এ তালিকা সম্পূর্ণ তালিকা নয়। এর ডানে-বাঁয়ে আরও দুর্ঘটনা, মৃত্যু আর অবহেলার লম্বা তালিকা আছে। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় মৃতদেহ বেশি বলে হয়তো আমরা চঞ্চল হয়েছি বেশি। যদি এটা গভীর রাতে ঘটত এবং মসজিদের পাহারাদার একা মারা যেতেন, তাহলে কি পাঁচটা তদন্ত কমিটি, আটটা বরখাস্ত, ক্ষতিপূরণ এবং বক্তৃতা-বিবৃতির এ বহর চলত? যেকোনো দুর্যোগের ভয়াবহতা মাপার মাপকাঠি লাশ হওয়া উচিত নয়।
ঢাকা মহানগরের তলায় জালের মতো বিছিয়ে আছে গ্যাসের লাইন। সরকারি কর্তৃপক্ষের নজরদারি ও সুরক্ষার যে হাল আমরা নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় গ্যাসলাইনের লিকেজের মধ্যে দেখেছি, তা বলে দিচ্ছে—আমরা কোন আগুনের ওপর চটের ছালায় ঘর বেঁধেছি। শক্ত সিদ্ধান্তের সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।
গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
nayeem5508@gmail.com