যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যাপক ভোটে বিজয়ী ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেনের বিজয়কে নাকচ করে দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টে করা একটি মামলা আদালত নাকচ করে দিয়েছেন। টেক্সাসের অ্যাটর্নি জেনারেল কেন প্যাক্সটন চারটি অঙ্গরাজ্যের (জর্জিয়া, মিশিগান, পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিন) বিরুদ্ধে এই বলে মামলা করেছিলেন যে এ রাজ্যগুলো করোনাভাইরাসের কারণে ভোটের নিয়মকানুনের যেসব পরিবর্তন করেছে, সেগুলো সংবিধান পরিপন্থী। আদালত যে মতামত দিয়েছেন তার সারকথা হচ্ছে, অন্য রাজ্য কীভাবে নির্বাচন করবে, সে বিষয়ে মামলাকারী টেক্সাস আদালতে আমলযোগ্য ভিত্তি দেখাতে পারেননি। এ মতামত কার্যত সর্বসম্মত, যদিও দুজন বিচারপতি কিছু বিষয়ে ভিন্নমতের কথা বলেছেন।
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া এ সিদ্ধান্তের পর আইনি প্রক্রিয়ায় ৩ নভেম্বরের ফল বদলে দেওয়ার জন্য রিপাবলিকান পার্টি এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো। এ মামলায় যেসব অঙ্গরাজ্যের ফল বাতিলের আবেদন করা হয়েছিল, সেগুলোয় জো বাইডেন জিতেছেন, ২০১৬ সালে এগুলো জিতেছিলেন ট্রাম্প। ফল বাতিল হলে বাইডেনের পাওয়া ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের সংখ্যা ২৭০-এর নিচে নেমে যেত।
মামলার যোগ্যতা বিবেচনা করে কমবেশি সব আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ গত মঙ্গলবার থেকেই বলে আসছিলেন যে এ মামলা টিকবে না। কিন্তু এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের বিচার বিভাগ কী ভূমিকা নেয়। সুপ্রিম কোর্টের নয়জন বিচারপতির মধ্যে ছয়জন রক্ষণশীল বলে পরিচিত এবং রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টদের মনোনয়নে নিয়োগকৃত তিনজন নিয়োগ পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে। সর্বশেষ নিয়োগ পান অ্যামি কোনি ব্যারেট—এ বছরের অক্টোবরে, অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সিনেট তাঁর নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণায় বারবার বলেছিলেন, এ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হবে সুপ্রিম কোর্টে।
গত ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেন-কমলা হ্যারিস জুটি ৮১ মিলিয়নের বেশি নাগরিকের এবং ৩০৬টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেয়ে বিজয়ী হলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পরাজয় স্বীকার করেননি। ট্রাম্পের পক্ষ থেকে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে রুজু করা ৫০টির বেশি মামলা রাজ্যপর্যায়ের আদালত বা ফেডারেল সার্কিট কোর্টে খারিজ হয়ে গেছে। পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে একটি মামলা সুপ্রিম কোর্টের কাছে নেওয়া হলে গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা সর্বসম্মতভাবে তা নাকচ করে দিয়ে এক লাইনের রায় দেন। তাতেও বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তৎপরতা বন্ধ থাকেনি।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপ হচ্ছে ইলেকটোরাল কলেজের ভোট, সে জন্য নির্ধারিত তারিখ হচ্ছে ১৪ ডিসেম্বর। এখন সুপ্রিম কোর্টের এ সিদ্ধান্তের পর এই ইলেকটোরাল কলেজের ভোট নিয়ে রিপাবলিকান পার্টির কিছু আশা করার থাকল না। সুপ্রিম কোর্টের এ সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। কিন্তু টেক্সাসের অ্যাটর্নি জেনারেলের করা এ মামলা আবারও দেখিয়ে দিল যে যুক্তরাষ্ট্র কতটা বিভক্ত হয়ে গেছে। টেক্সাসের অ্যাটর্নি জেনারেলের আবেদনে এককভাবে এতটা গুরুত্ব লাভের একটা কারণ হচ্ছে এ মামলায় তাঁকে সমর্থন করেছিল ১৮টি রাজ্য; বিপক্ষে চারটি অঙ্গরাজ্য, যার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ২০টি রাজ্য, ওয়াশিংটন ডিসি এবং ভার্জিন আইল্যান্ডের অ্যাটর্নি জেনারেলরা। এ ছাড়া প্রতিনিধি পরিষদের ১০৭ জন রিপাবলিকান সদস্য আদালতের কাছে ‘অ্যামিকাস ব্রিফ’ পাঠিয়েছিলেন এ আবেদনের সমর্থনে।
এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক, যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য মোটেই ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয় না। কয়েক বছর ধরে, এমনকি ২০১৬ সালে ট্রাম্পের উত্থানের আগে থেকেই, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে এ বিতর্ক ছিল যে সুসংহত গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় গণতন্ত্র বিপদের মধ্যে আছে কি না, বলা হচ্ছিল যে যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেনের মতো দেশেও গণতন্ত্রের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। আইনসভা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আস্থাহীনতার মাত্রা দেখে অনেকেই বিপদের আশঙ্কা করছিলেন।
সুপ্রিম কোর্ট যে এখন রক্ষণশীলদের নিয়ন্ত্রণে; তা সত্ত্বেও ট্রাম্পের পক্ষে তাঁদের অবস্থান না নেওয়াকে ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করতে হবে। এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে, তা হলো প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে। এ নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব আবারও বোঝা গেছে এবং সেগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করার প্রমাণ দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উপর্যুপরি হুমকি সত্ত্বেও প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের সরকার এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় বিবেচনার বাইরে গিয়ে সংবিধানে দেওয়া দায়িত্ব পালন করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেকেই রিপাবলিকান পার্টির সদস্য এবং সেই পরিচয়ে নির্বাচিত, কিন্তু তাঁরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কথাবার্তাকে বিবেচনায় নেননি।
আদালত এ মামলা খারিজ করার পরে ট্রাম্প এবং তাঁর সমর্থকেরা নিরস্ত হবেন, তা মনে করার কারণ নেই। প্রতিনিধি সভার বিশালসংখ্যক রিপাবলিকান সদস্যের আচরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে, আগামী ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসের যৌথ সভায় ইলেকটোরাল কলেজ ভোট গণনার সময়ে তাঁরা আরেক দফা বাধাবিঘ্ন তৈরি করবেন। কিন্তু তার চেয়েও বেশি বিবেচনা করা দরকার যে এ রকম বিভক্ত একটি দেশে শাসন চালানো জো বাইডেনের জন্য কতটা দুরূহ হবে।
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো