গ্যাস বা জ্বালানির দাম সরকার বাড়ায়, আবার এর সঙ্গে মিলিয়ে বাস ও যানবাহনের ভাড়াও সরকারই বাড়ায় বা ঠিক করে দেয়। কিন্তু একটি ঠিক থাকে, অন্যটি থাকে না। সরকার-নির্ধারিত দামেই গ্যাস বা জ্বালানি বিক্রি হয়, কিন্তু যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায়ের সময় কিছুই নির্ধারিত থাকে না। বাসমালিক ও পরিবহন শ্রমিকেরা সংগঠিত। ফলে ভাড়া আদায়টা তাঁদের জোর জুলুমের বিষয়। যেকোনো রুটে নির্দিষ্ট দূরত্বগুলোতে একটি ভাড়া একবার কায়েম করে ফেললেই হলো। এরপর থেকে সেটাই নিয়ম, সেটাই নির্ধারিত ভাড়া। এর সঙ্গে সরকার-নির্ধারিত ভাড়ার কোনো সম্পর্ক থাকে না।
গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর সরকার যখন বাসের ভাড়াও বাড়িয়ে নির্ধারণ করে দিয়েছে, তখন সেই সুযোগে নিজেদের মতো একটি ভাড়া নির্ধারণ করার পর্ব চলছে এখন। পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা জোর জুলুম করেই তা কায়েম করার পথে রয়েছেন। সরকার প্রতি কিলোমিটারে একজন যাত্রীর ভাড়া বাড়িয়েছে ১০ পয়সা। ফলে যে যাত্রী ফার্মগেট থেকে গুলিস্তান যাবেন, তাঁর ভাড়াটি বাড়বে এটুকু দূরত্বের সঙ্গে মিলিয়ে। এখন বাসভাড়া বাড়ার যুক্তিতে এই দূরত্বে দুই টাকা বাড়তি নেওয়া ও তা কার্যকর করার চেষ্টা হচ্ছে। অথচ দুই টাকা ভাড়া বাড়বে ২০ কিলোমিটার দূরত্বে। ফার্মগেট থেকে গুলিস্তানের দূরত্ব কত? বাসে বসে এ নিয়ে কন্ডাক্টরের সঙ্গে কে ঝগড়াঝাঁটি করবে! আর এটার তো দরকারও হওয়ার কথা না। নিয়ম অনুযায়ী দূরত্বের হিসাবে ফার্মগেট থেকে গুলিস্তানের সরকার-নির্ধারিত ভাড়া এখন কত, তার একটি তালিকা বাসে থাকার কথা। এটি থাকলেই কোনো তর্ক-বিতর্ক হয় না। কিন্তু বাসওয়ালারা তা রাখবেন না। এটা থাকলে যে বাড়তি ভাড়া আদায় ও তা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলা যাবে না!
সরকার বাসভাড়া বাড়িয়ে নির্ধারণ করে দিলে প্রতিবারই দেখা যায় এর চেয়েও বেশি ভাড়া আদায়ের জন্য বাসওয়ালারা কিছু কৌশল নেন। কিছু সময়ের জন্য তাঁরা বাসটিকে ‘সিটিং সার্ভিস’ করে ফেলেন। যাত্রীদের ধারণা দেওয়া হয় যে বাড়তি ভাড়ার বিনিময়ে তাঁরা ‘বাড়তি’ কিছু পাচ্ছেন। এভাবে বাড়তি ভাড়ার বিষয়টিকে জায়েজ ও এটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তখন আবার সেই আগের অবস্থাতেই ফিরে যায়। হতভাগা বাসযাত্রীদের সবকিছুই মেনে নিতে হয়। তাঁদের পক্ষে আসলেই কেউ নেই।
বাসওয়ালারা সরকারের ঠিক করে দেওয়া ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করবেন, নিয়ম মানবেন না, কিন্তু তাঁদের কিছু বলা যাবে না। রোববার সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালত বাসে ভাড়ার তালিকা না থাকায় এক বাসের চালকের সহকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। ফলাফল সাত ঘণ্টা বাস চলাচল বন্ধ। বাসমালিক আর শ্রমিকদের কাছে সবাই জিম্মি। যাত্রী কল্যাণ সমিতি নগরীর বিভিন্ন জায়গায় পর্যবেক্ষণ করে জানিয়েছে যে ৮৭ শতাংশ বাস অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে। সড়ক পরিবহন ও যোগাযোগমন্ত্রী অবশ্য ৪০ ভাগ বাসে বাড়তি ভাড়া নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। আসল কথা হচ্ছে, ৮৭ বা ৪০ শতাংশ যাই হোক, বাসগুলো বেশি ভাড়া আদায় করছে। প্রশ্ন হচ্ছে এর বিহিত কী?
প্রতিটি রুটে এক স্টপেজ থেকে পরবর্তী গন্তব্যগুলোতে যেতে সরকার-নির্ধারিত ভাড়া কত, সেই তালিকা তৈরি ও সবগুলো বাসে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলেই যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় কঠিন হবে। বাসওয়ালারা যদি এটা মানাতে না চান, তবে আইনের প্রয়োগ ছাড়া পথ নেই। গত রোববারের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান ও এর প্রতিক্রিয়ায় সাত ঘণ্টার ধর্মঘটে ভয় পেয়ে যদি সরকার বিষয়টিতে ছাড় দেয় ও নিজের নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়, তবে বুঝতে হবে যে পরিবহন খাতটি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সরকারের মন্ত্রী ও সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাহজাহান খান অবশ্য বিবিসিকে বলেছেন, পরিবহন খাতে ‘জবাবদিহি ও নিয়ন্ত্রণ’ বজায় রয়েছে।
পরিবহন খাতের এই ‘জবাবদিহি ও নিয়ন্ত্রণ’ জোর জুলুমের বাসভাড়া থেকে যাত্রীদের মুক্তি দিতে পারে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।