মানবাধিকার

জেনেভায় সব ছাপিয়ে সাভার ট্র্যাজেডি

চার পায়ের একটা বিশাল চেয়ার, কিন্তু একটা পা ভাঙা, সেই চেয়ারের কি আর দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা থাকে? কিন্তু আছে। জেনেভার জাতিসংঘ ভবনের সামনে এক পা খোঁড়া কাঠের বিশাল চেয়ারটি ঠায় দাঁড়িয়ে স্থলমাইনের আঘাতে পঙ্গুত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে। তবে স্থাপত্য বলেই সে দাঁড়িয়ে। নয়তো সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সাভারে রানা প্লাজা ধসের পর অসহায় দরিদ্র শ্রমিকদের মতো তার অবস্থাও হতো আহত কিংবা নিহত। যদি জানতে পারতাম এই চেয়ারের আত্মকথা, তাহলে হয়তো জানা যেত রানা প্লাজা ধসে নিহত-আহতদের জন্য তার প্রতিবাদটুকু। শুধু একটি মানুষের লাশ হয়ে যাওয়া কিংবা পঙ্গু হয়ে যাওয়াই তো নয়, তার সঙ্গে জড়িত পরিবারে আরও কতগুলো মানুষের আধপেটা খেয়ে কোনোরকমে বেঁচে থাকার চেষ্টা। গেল, সেটুকুও গেল। কিছু মানুষের লোভ, অসততা, দুর্নীতি, ক্ষমতার দাপটের কারণে এই জেনেভাতে বসেই মানবাধিকার পর্যালোচনা অধিবেশনে বাংলাদেশকে তাই প্রায় ১০০টি দেশের প্রতিনিধির কাছ থেকে শুনতে হয়েছে সাভার ট্র্যাজেডি নিয়ে কথা। হ্যাঁ, তাঁরা সমবেদনা জানিয়েছেন সত্য, কিন্তু শ্রমিকের অধিকার রক্ষা, কাজের নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টির প্রশ্ন তো এসেছেই সামনে।

২৯ এপ্রিল ছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে সর্বজনীন পুনর্বীক্ষণ পদ্ধতির (ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউ বা ইপিআর) আওতায় দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যালোচনা অধিবেশন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি এই অধিবেশনে যোগ দিয়ে তাঁর সরকারের গত চার বছরের শাসনামলের মানবাধিকার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন এবং গতবারের অধিবেশনে সরকার যে অঙ্গীকারগুলো করেছিল, তা বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করেন, এ ছাড়া দুই দফা তিনি আলোচনায় অংশ নেওয়া বিভিন্ন দেশের প্রশ্নের উত্তর দেন। সরকার জানত, এবারের অধিবেশনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের প্রসঙ্গটি আলোচনায় আসবে, তাই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে জেনেভায় গেছেন ভদন্ত সত্যপ্রিয় মহাথের, জ্ঞানেন্দ্র চাকমা, রানা দাশ গুপ্ত ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম সাইফুল ইসলাম। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের একপর্যায়ে ভদন্ত সত্যপ্রিয় মহাথেরকে কিছু বলার সুযোগও দেন। তবে বক্তব্যের শুরুতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে মন্ত্রী তাঁর সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করার পর এ বিষয়ে তেমন কোনো বিব্রতকর প্রশ্নের সম্মুখীন হননি। কয়েকটি দেশ মৃত্যুদণ্ড বাতিলের কথা বলে, উত্তরে মন্ত্রী জানান এটি বাংলাদেশে ‘ইউনিক’ শাস্তির বিধান নয়, বিশ্বে অনেক দেশেই রয়েছে, বাংলাদেশে এই শাস্তি কেবল সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে দেওয়া হয়। প্রতিটি দেশের জন্য বরাদ্দ সময় সোয়া এক মিনিট, সাভার ট্র্যাজেডির জন্য চলে গেছে নির্দিষ্ট সময়, বাংলাদেশকে প্রশংসাও করেছেন অনেকে মুক্তকণ্ঠে,  তবু উঠে এসেছে অনেক প্রশ্ন। যুক্তরাষ্ট্র যেমন বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন, শ্রমিকের অবস্থার উন্নতি নিয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ে স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছে, জাপান রামুর ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, সুইজারল্যান্ড বিচারবহির্ভূত হত্যা বা সংখ্যালঘুদের রক্ষার পাশাপাশি স্বাধীন তদন্ত কমিশনের কথা বলেছে, সুইডেন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কমানোর পাশাপাশি ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড চালুর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, নরওয়ে সাংবাদিক হামলার বিষয়টি উত্থাপন করেছে, স্লোভাকিয়া যেমন আদিবাসী এবং প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার রক্ষার কথা বলেছে, ডেনমার্ক পাবর্ত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সময় বেঁধে দেওয়ার কথা বলেছে...।

সকাল নয়টায় শুরু হয়ে এ অধিবেশন চলে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। প্রতিটি দেশ সুনির্দিষ্ট সুপারিশ উপস্থাপন করে। ইতিমধ্যেই আমরা জেনে গেছি, বেশ কিছু স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ কিছুটা সময় চেয়েছে। ইপিআর মানবাধিকার রক্ষায় এমন একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যেখানে সরকার, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ছাড়াও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বা বেসরকারি সংস্থা এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। আর এই সুযোগ বেশ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন এ দেশের মানবাধিকারকর্মীরা। তাঁরা মানবাধিকার বিষয়ে নিজস্ব প্রতিবেদন শুধু জমা দেননি, বিভিন্ন বিষয়ে লবিস্ট গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং অধিবেশনের দিন উপস্থিত থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। জেনেভায় ২৯ তারিখের অধিবেশনে লক্ষ করেছি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন, অনেক বিষয়ে তাঁরা সমর্থনসূচক অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেও অনেক বিষয়ে নীরব দ্বিমত পোষণ করছিলেন। বিশেষ করে বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন, সংখ্যালঘুদের রক্ষা, দুর্নীতি দমন কমিশনের ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়ে তাঁরা মোটেই একমত নন।

বাংলাদেশের ১৯টি মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হিউম্যান রাইটস ফোরামের আহ্বায়ক এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বললেন, সরকার এবার যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল, এটা ইতিবাচক দিক যদিও, অনেক বক্তব্যের সঙ্গে আমরা ভিন্নমত পোষণ করি। দেশে আমরা যখন কোনো একটি ঘটনায় প্রতিবাদ করি বা ভিন্নমত পোষণ করি, সব সরকারই মনে করে, আমরা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছি, যেমন গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় আমাদের বক্তব্যগুলোকে যদি মানা হতো, তাহলে আজ সত্যি সত্যি দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতো না। তাজরীন ফ্যাশনসের  আগুন বা রানা প্লাজা ধসে গার্মেন্টস শ্রমিকদের হতাহতের ঘটনায় সারা বিশ্বের কাছে আমরা কী বার্তা পৌঁছে দিলাম? দুর্নীতি, লোভ আর নজরদারির অভাবে আমাদের দেশের দরিদ্র পোশাকশ্রমিকেরা হয় আগুনে পুড়ে মরেন, নয়তো ভবনধসে চাপা পড়েন। এতে কি আমাদের দেশের সুনাম বাড়ল? প্রায় একই ধরনের কথা বললেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। বললেন, সরকার এবার অনেকগুলো বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করেছে, এটা ইতিবাচক দিক। যদিও সব বক্তব্যের সঙ্গে একমত নই। তবে আমরা মনে করি, সমস্যার সমাধানে কী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হলো, সেটাই দেখার বিষয়।

সরকার ও মানবাধিকারকর্মীদের মধ্যে ভিন্নমত থাকলেও জেনেভার এই মানবাধিকার পর্যালোচনা অধিবেশনের শুরুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি যেমন নিজে এসে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গে হাত মেলান, শুভেচ্ছা বিনিময় করেন, তেমনি অধিবেশনের শেষে হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশের সদস্যরা গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান। বিকেলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া রিসেপশন আয়োজনে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে আলাপকালে মন্ত্রীকে বেশ আত্মবিশ্বাসী লাগছিল। এক ফাঁকে আলাপ হলো তাঁর সঙ্গে। বললেন, দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির সব সমস্যার সমাধান করতে পেরেছি তা নয়, কিন্তু আমাদের চেষ্টার ত্রুটি নেই। দেশের মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গে অনেক বিষয়ে আমাদের ভিন্নমত আছে, তবে এই ইপিআর-প্রক্রিয়ায় তাঁদের অংশগ্রহণকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। সেদিনই খবর এল দেশে জাতীয় সংসদের স্পিকার হলেন শিরীন শারমিন চৌধুরী। এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য চাইলে তিনি বলেন, এটা খুবই ইতিবাচক একটি সংবাদ, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশে নারী স্পিকার, আমাদের প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থার বার্তাই পৌঁছে যাবে বিশ্বের কাছে। আর হেফাজতের ১৩ দফার দাবির বিপরীতে এটাও একটা বার্তা।

অপেক্ষাকৃত কম বয়স, কম অভিজ্ঞতায় একজন স্পিকার হলেন, এই নিয়ে দলের ভেতর কথা উঠছে কি না। বললেন, কথা তো হবেই। আমার বেলায়ও কম কথা হয়েছে? তবে আমি বিশ্বাস করি, নতুন স্পিকার তাঁর কাজ দিয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করবেন।

২৯ এপ্রিল মূল অধিবেশন হয়ে যাওয়ার পর ওয়ার্ল্ড বড়ুয়া অর্গানাইজেশন এবং গ্লোবাল হিউম্যান রাইটস ডিফেন্সের উদ্যোগে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থা নিয়ে একটি সাইড ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। গ্লোবাল হিউম্যান রাইটস ডিফেন্সের জেনি লান্ডসট্রম সূচনা বক্তব্য দেন, সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন সুলতানা কামাল। বক্তব্য দেন শাহীন আনাম, জাকির হোসেন, সঞ্জীব দ্রং, বিধায়ক চাকমা, সাখাওয়াত হোসেন। বারবার ঘুরেফিরে আসছিল কথাগুলো—বাংলাদেশটা সবার জন্মভূমি, তবে কেন আমরা কিছু লোকের মনের মধ্যে ‘সংখ্যালঘু’ অনুভূতি প্রবেশ করিয়ে দিই? আর তাদের বারবার ভাবতে হয়, এ দেশ ছেড়ে কেন আমরা যাব? এই অধিবেশনের শেষে বক্তব্য দেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান।

জেনেভা থেকে যেদিন ফিরে আসি, একই বিমানে ফিরলেন ভদন্ত সত্যপ্রিয় মহাথের। একা চলতে কষ্ট, সঙ্গে একজন শিষ্য। ইস্তাম্বুলে সাত ঘণ্টার যাত্রাবিরতি, এই সুযোগে তাঁর সঙ্গে কথা হলো। ৮৬ বছরের চিরকুমার মানুষটি সারা জীবন অহিংসবাদে বিশ্বাসী, পুড়েছে বিহার, পুড়েছে হূদয়, তার পরও এতটা পথ উড়ে সরকারের কথায় এসে শান্তির বাণী শোনালেন! ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, সরকার ছাড়া কে আমাদের রক্ষা করবে? সরকারের উচ্চপর্যায়ে আন্তরিকতা আছে, বিহার আবার তৈরি হবে। সেনাবাহিনী আমাদের পাহারা দিয়ে রাখে। যদিও আমাদের অন্তরের ক্ষত শুকাতে অনেক সময় লাগবে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এই সেদিন আমার জন্মবার্ষিকীতে এলাকার সকল ধর্মের মানুষ হাতে হাত রেখে আনন্দ করেছে, অথচ সেই এলাকাতেই আমি, আমরা আক্রান্ত? আমরা এ দেশ ছেড়ে কেন যাব? কোথায় যাব? এটা আমার মাতৃভূমি, পিতৃভূমি, জন্মভূমি...।

সুমনা শারমীন: সাংবাদিক।