জামিলকে কীভাবে ভুলতে পারি?

অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী
অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী

অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী নবাবপুর হাইস্কুল ও ঢাকা কলেজে আমার সহপাঠী। কিন্তু সহপাঠী বললে সবটা বলা হয় না। বিগত ৬৫ বছর ধরে আমরা ছিলাম পরস্পরের বন্ধু। স্থানের দূরত্বের কারণে সে বন্ধুত্বে কখনো ছেদ পড়লেও মনের দিক থেকে আমাদের কোনো দূরত্ব ছিল না। সম্প্রতি করোনাভাইরাসের কারণে আমরা গৃহবন্দী থাকলেও কিছুদিন ধরে মোবাইলে আমাদের যোগাযোগ আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গিয়েছিল। দিন পনেরো আগে আমি জামিলকে বলেছিলাম, ‘আমি যেসব ওষুধ সেবন করি কিংবা যেসব ইনজেকশন নিই, তা বিদেশ থেকে আনাতে হয়। বর্তমান দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় তা দেশে পাওয়া যাচ্ছে না।’ কথা শুনে জামিল উদ্বেগ প্রকাশ করছিলেন। মাত্র চার দিন আগে তিনি নিজেই আমাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘ওষুধ কি পেয়েছ?’ বললাম, ‘পেয়েছি। প্রায় অসাধ্যসাধন করে তা জোগাড় করতে হয়েছে।’ জামিল স্বস্তি প্রকাশ করেছিলেন।

আমার সহপাঠী ও বন্ধুদের মধ্যে জামিল ছিলেন সবচেয়ে সফল মানুষ। এই সাফল্য তাঁর শিক্ষাগত ও পেশাগত এলাকা ছাড়িয়ে আরও অনেক দূরবর্তী। ১৯৬৩ সালে তিনি আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমানে বুয়েট) থেকে প্রথম বিভাগে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন।

১৯৬৮ সালে যুক্তরাজ্য থেকে পিএইচডি করেন। ১৯৭৪-১৯৭৫ সালে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে তিনি যুক্তরাজ্যে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তী সময়ে দীর্ঘকাল তিনি বুয়েটে অধ্যাপনা করেন। আরও পরে তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে উপাচার্য ছিলেন। তিনি একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশল বিষয়ে সম্মানসূচক ডক্টরেট পেয়েছেন। অন্যদিকে বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারে তিনি উপদেষ্টা ছিলেন। জামিল ২০১৭ সালে একুশে পদক লাভ করেন এবং ২০১৮ সালে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান।

আমার কাছে জামিলের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো শিক্ষক হিসেবে তাঁর সাফল্য। তাঁর যাঁরা ছাত্র ছিলেন, তাঁরা জামিলের ছাত্র হিসেবে সর্বদা গৌরব অনুভব করতেন। এই গৌরব প্রকাশ করতে তাঁরা দ্বিধা করতেন না। একজন শিক্ষকের বড় পাওনা হলো ছাত্রদের শ্রদ্ধা ও সম্মান।

জামিলের জন্যও ছিল তা অত্যন্ত গৌরবের। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। আমাদের দেশের বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন জামিল। এর মধ্যে রয়েছে পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল। এ ছাড়া আরও অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন তিনি।

জামিলুর রেজা চৌধুরী বিয়ে করেছিলেন ড. এ আর মল্লিকের মেয়ে সেলিনা নওরোজ মল্লিককে। মুক্তিযুদ্ধের আগে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালে ড. মল্লিক ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। ফলে তাঁদের পুরো পরিবারের সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

জামিল-সেলিনা দম্পতির দুই সন্তান কারিশমা ও কাশিফ উভয়েই পিতার পথ ধরে প্রকৌশলী হয়েছেন। আর একসময়ের কৃতী ছাত্রী সেলিনা তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। তাঁদের পুরো পরিবারের সাফল্য জামিলের সাফল্যেরই পরিচায়ক।

জামিল আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। ২৮ এপ্রিল তিনি লোকান্তরিত হয়েছেন। দীর্ঘ সময়ের অনেক স্মৃতি আজ জেগে উঠছে মনে। মানুষ চলে গেলে সময়ের ঢেউ এসে তাকে ধীরে ধীরে বিস্মৃতির দিকে টেনে নিয়ে যায়। সেটাই জগতের নিয়ম। কিন্তু তার পরও কোনো কোনো স্মৃতি লালন করতে চাই মনে। জামিলকে কী করে ভুলতে পারি?

মাহবুব তালুকদার, নির্বাচন কমিশনার