ভূরাজনীতি

চীনের কোনো বন্ধু নেই

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

ভূখণ্ডগত দাবিদাওয়ার কারণে এই অঞ্চলের অনেক দেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক যখন টানাপোড়েনের মুখোমুখি পড়েছে, যখন মিয়ানমারের ওপর তার একসময়ের প্রবল প্রভাব দুর্বল হয়েছে এবং তার একসময়ের অনুগত রাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে, তখন দেখা যাচ্ছে, চীন নামক শক্তিধর রাষ্ট্রটির আশপাশে সত্যিকারের কোনো মিত্র নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো এই পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু করতে এবং উত্তর-পূর্ব এশিয়ার আশঙ্কাময় ভূরাজনীতিতে পরিবর্তন সূচিত করতে সক্ষম হবে কি না।
মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের অবনতি শুরু হয় ২০১১ সালের শেষ দিকে, যখন মিয়ানমার চীনের সহায়তায় নির্মিতব্য সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে বিতর্কিত প্রকল্পের কাজ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। ইরাবতী নদীর উজানে ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়সাপেক্ষ মায়িস্টোন বাঁধ নির্মাণের সেই প্রকল্প মিয়ানমার স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিলে চীন বেশ আঘাত পায়, যে মিয়ানমারকে চীন তার মক্কেল রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে। তবে সম্পর্কে এই চিড় ধরা সত্ত্বেও দেশটির প্রতি চীনের আগ্রহ আজও ব্যাপক মাত্রায় রয়ে গেছে।
মিয়ানমারের ওই সিদ্ধান্তের ফলে চীনের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও পৃথিবীর অবশিষ্ট অংশের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি ছিল একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তার পরে একটা বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে; মিয়ানমারের ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর বহু বছর ধরে আরোপিত অবরোধগুলো শিথিল হয়েছে এবং মিয়ানমারের কয়েক দশকের আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা ঘুচেছে।
ওদিকে উত্তর কোরিয়ার তরুণ স্বৈরশাসক কিম জং-উন চীনের সঙ্গে নিজের দূরত্ব বাড়িয়ে মিয়ানমারের পথ অবলম্বনের আগ্রহ জানান দিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য যদি এমন হয় যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার শীতল সম্পর্কের বরফ গলাতে চাইছেন, তাহলে তাঁকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। সাবেক আমেরিকান বাস্কেটবল তারকা ডেনিস রডম্যানকে তিনি স্বাগত জানানোর ফলে আমেরিকায় শুধু বিতর্কই সৃষ্টি হয়েছে। আর দক্ষিণ কোরিয়ার একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, তিনি তাঁর এক সাবেক মেয়েবন্ধুকে মেশিনগানের গুলি করে হত্যা করেছেন—এতেও আমেরিকানদের কাছে তাঁর কদর কোনোভাবেই বাড়বে না।
অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করেন, কিম তাঁর চাচাশ্বশুর জ্যাং সং-থেককে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে হত্যা করার ফলে চীনের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্কের যে অবনতি ঘটে, উত্তর কোরিয়ার খামখেয়ালিপূর্ণ ও অদ্ভুত রাজনীতিতে তার স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে। চীনের জন্য বিষয়টি ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ের। উত্তর কোরিয়ার শাসকমহলের মধ্যে থেক ছিলেন চীনের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান ব্যক্তি। তাঁর বিরুদ্ধে কিম বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তুলেছিলেন। এগুলোর মধ্যে এমন অভিযোগও ছিল যে থেক খুব কম দামে কয়লা, জমি ও বিভিন্ন মূল্যবান ধাতু চীনের কাছে বিক্রির ষড়যন্ত্র করছিলেন।
কিন্তু চীন উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে খুব যত্নের সঙ্গে যে ‘রক্তের সম্পর্ক’ বজায় রেখে আসছিল, ২০১১ সালের শেষে কিম তাঁর পিতা কিম জং-ইলের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই তার অবনতি ঘটতে শুরু করে। চীনের তিনটি মাছ ধরার নৌকা উত্তর কোরিয়া আটক করে, সেসব নৌকায় যে ২৯ জন মানুষ ছিল, তাদের সবাইকে ১৩ দিন ধরে আটকে রাখে (খবরে প্রকাশ, ওই সময় তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়), তারপর উত্তর কোরিয়ার জলসীমার মধ্যে মাছ ধরার দায়ে চীনের কাছে এক লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করে। চীনের প্রতি উত্তর কোরিয়ার অবাধ্যতা প্রকাশের সেটাই ছিল প্রথম লক্ষণ। তারপর উত্তর কোরিয়া তৃতীয়বারের মতো পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর মধ্য দিয়ে চীনের বিরাগ সৃষ্টি করে।
বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে কিমের এসব পদক্ষেপকে চীনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম উত্তর কোরিয়ার ‘অচীনাকরণ’ নীতি হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং এর জন্য কিমের সমালোচনা করার মধ্য দিয়ে একটা স্বতন্ত্র অবস্থান গ্রহণ করে। কিন্তু কিমবিরোধী প্রচারণার বাইরে চীনের আর বেশি কিছু করার নেই। কারণ, উত্তর কোরিয়ায় যে বিপুল পরিমাণ লোহা, ম্যাগনেসাইট, তামা ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের মজুত রয়েছে, সেসবের প্রতি চীনের প্রবল আগ্রহ আছে। মিয়ানমারের মতো উত্তর কোরিয়ায়ও এসব ক্ষেত্রে অভিগম্যতা অটুট রাখতে চায় চীন।
আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উত্তর কোরিয়ায় জ্বালানি ও খাদ্যের সরবরাহ সংকোচন করার মধ্য দিয়ে দেশটির ওপর চাপ সৃষ্টি করার উদ্যোগ যদি চীন নেয়, তাহলে সেই দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী চীনে প্রবেশ করার ঝুঁকি সৃষ্টি হবে। চীনের দিক থেকে তার চেয়েও খারাপ কথা হলো, এর ফলে উত্তর কোরিয়ায় কিম-পরিবারের শাসন ভেঙে পড়তে পারে। সে রকম কিছু ঘটলে উত্তর কোরিয়া রাষ্ট্র হিসেবেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে একীভূত হয়ে যেতে পারে। তাহলে যা দাঁড়াবে তা হলো, চীনের কাছাকাছি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে একক কোরীয় রাষ্ট্রের উত্থান। চীনা সীমান্তের কাছাকাছি মার্কিন সেনাবাহিনীর অবস্থান চীনের জন্য ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়।
দুই কোরিয়া এক হলে যে একক কোরীয় রাষ্ট্রের উত্থান ঘটবে, তার সঙ্গে চীনের বেশ কিছু ভূখণ্ড ও প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে বিরোধ তীব্রতর হবে (যেমন, পিকতু পাহাড়ের গিরিখাত কোনজি হ্রদ এবং ইয়ালু ও তুমেন নদীর কয়েকটি দ্বীপ নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে চীনের ইতিমধ্যেই বিরোধ আছে)। দুই কোরিয়ার একত্রকরণ চীন মেনে নিতে পারে কেবল এই শর্তে যে একক কোরীয় রাষ্ট্রের মর্যাদা হবে ফিনল্যান্ডের মতো, যার স্থায়ী কৌশলগত ছাড় পাবে নিকটতম পরাশক্তি রাষ্ট্র।
আজকের উত্তর কোরিয়ার মতো মিয়ানমারও সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত ছিল একটি বিচ্ছিন্ন, সামরিকীকৃত রাষ্ট্র যে কি না দীর্ঘ আন্তর্জাতিক অবরোধের ফলে বেশ ভুগেছে। বস্তুত কিমের ওপর হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ার ফলে চীন গত বছর উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের আরও এক দফা অবরোধ আরোপের উদ্যোগে সহযোগিতা করেছে।
কিন্তু মিয়ানমার ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। মিয়ানমারের সমাজ বিচিত্র জনগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত, যেখানে বর্মি-অভিজাত শাসকগোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠদের অত্যাচার-নির্যাতনের সমস্যা নিয়ে মুশকিলে আছে। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার সমাজ সমগোত্রীয় বা হোমোজেনাস, কঠোর নিয়মশৃঙ্খলার নিগড়ে বাঁধা; উপরন্তু উত্তর কোরিয়া একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। অন্য কথায়, বিশ্বের জন্য উত্তর কোরিয়া অনেক বেশি বিপজ্জনক একটি রাষ্ট্র।
চীন ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যকার সম্পর্কের ভাঙন উত্তর-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনীতিতে একটি সম্ভাব্য মোড় পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা ঘটানোর সুযোগটি নিতে চায়, তাহলে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা ত্যাগ করতে হবে। কারণ, উত্তর কোরিয়ার জন্য চীন একটা সমস্যা, চীনের ওপর থেকে সে নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে।
মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ফলে ২০১২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইয়াঙ্গুন সফর করেন। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু করতে হলে প্রথমেই উত্তর কোরিয়াকে রাজি করাতে হবে বি-পারমাণবিকীকরণ সম্পর্কে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে। প্রশ্ন হচ্ছে, ওবামা সে রকম ঝুঁকি নিতে যাবেন কি না। কারণ, তিনি ইতিমধ্যেই শুধু অভ্যন্তরীণ অনেক সমস্যার মুখোমুখি নন, সিরিয়ার ব্যাপারে একটা শান্তি-সমঝোতায় পৌঁছানো এবং ইরানের সঙ্গে তাঁর পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি নিয়েও মুশকিলে আছেন। এমন অবস্থায় উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে একটি ঝুঁকিপূর্ণ আলোচনা শুরু করার জন্য তাঁর প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক পরিসর কিংবা ব্যক্তি আগ্রহ আছে কি না সেটাই প্রশ্ন।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

ব্রহ্ম চেলানি: অধ্যাপক, স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ, সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ, নয়াদিল্লি।