চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: আইনটি সংশোধন করা জরুরি

 
একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চিকিৎসা বর্জ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনা কৌশল ও কার্যকরী বাস্তবায়ন এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আভিধানিক অর্থে চিকিৎসা বর্জ্য বলতে যে কোনো কঠিন বা তরল বর্জ্য পদার্থকে বোঝায়, যা মানুষ অথবা পশুর রোগ নির্ণয়, কিংবা টিকা প্রদানের সময়ে হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থান হতে সংগৃহীত হয়।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত কলেবরে বেড়েছে, ডিসপোজিবল বা একবার ব্যবহারযোগ্য চিকিৎসা সামগ্রীর ব্যবহারও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ফলে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ চিকিৎসা বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এই বর্জ্যের বেশির ভাগই কমবেশি সংক্রামক, এগুলোর মাধ্যমে রোগের সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে পারে। চিকিৎসা বর্জ্যকে অবশ্যই জনস্বাস্থ্যসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের একটি বড় কারণ হিসাবে চিহ্নিত করতে হবে। নইলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কার্যকরী হবে না, বর্তমান নাগরিক ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা পূরণ করত পারবে না।

অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের’ মাধ্যমে আমরা সরকারকে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন দুর্বল দিকগুলি তুলে ধরার চেষ্টা করছি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে মেডিকেল বর্জ্যের নিরাপদ নিষ্কাশনের কার্যকরী ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। মেডিকেল বর্জ্যের নিরাপদ নিষ্কাশনের মানদণ্ডে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে।

আমাদের শহরগুলোতে ঘরবাড়ি বা আবাসিক এলাকার বর্জ্য নিষ্কাশন চর্চা দুর্বল। হাসপাতাল-ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক কেন্দ্রগুলোও চিকিৎসা বর্জ্য ঠিকমতো নিষ্কাশন করে না। জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বর্জ্য যেমন, রক্ত-পুঁজ মিশ্রিত তুলা ও গজ ব্যান্ডেজ, ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, সুচ, রক্তের ব্যাগ, স্যালাইনের ব্যাগ, এমনকি মানুষের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন সংক্রমিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পর্যন্ত রাস্তার পাশে রক্ষিত ডাস্টবিনসহ যত্রতত্র রাখা হয়।

গবেষণা থেকে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর চিকিৎসা বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার কারণে প্রায় ৫২ লাখ মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে, তাদের মধ্যে ৪০ লাখই শিশু। এ বিষয়ে বাংলাদেশে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে এই বৈশ্বিক পরিসংখ্যানের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি ও সি, নানা ধরনের চর্মরোগ, ও শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহসহ অনেক রোগ ছড়াতে পারে চিকিৎসা বর্জ্যের অনিরাপদ নিষ্কাশনের জন্য। আর হাসপাতালে ভর্তি অনেক সাধারণ রোগীও এসব রোগে আক্রান্ত হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী, হাসপাতাল ডিজাইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ চিকিৎসা বর্জ্যের নিরাপদ নিষ্কাশন ব্যবস্থা। বাংলাদেশেও হাসপাতালে বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য সুনির্দিষ্ট এবং সুচিন্তিত ব্যবস্থাপনা থাকা অপরিহার্য। কঠিন বর্জ্য ধ্বংসের জন্য পৃথিবীর বেশির ভাগ হাসপাতালেই মেডিকেল ইনসিনেরেটর এবং অটোক্লেভ বা দাহন যন্ত্রসহ বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা আছে। আর তরল বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য রয়েছে বিশেষ ধরনের ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। এভাবে মারাত্মক বর্জ্যকে দূষণমুক্ত করে সাধারণ ড্রেনেজ ব্যবস্থার মাধ্যমে অন্যান্য তরল বর্জ্যের সঙ্গে নিষ্কাশন করা হয়।

বাংলাদেশে বর্তমানে চিকিৎসা বর্জ্যের নিষ্কাশনের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত কিংবা মানসম্মত আধুনিক ব্যবস্থা চালু নেই। চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্বাস্থ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ, অথচ এটি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরেরও মাথা ব্যথা নেই। ২০০৮ সালে চিকিৎসা বর্জ্যের নিরাপদ নিষ্কাশন নিয়ে আইন হলেও তা খুবই দুর্বল কিংবা যুগোপযোগী নয়।

বাংলাদেশে চিকিৎসা বর্জ্যের নিষ্কাশন সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যে ব্যবস্থাটি অত্যন্ত প্রাচীন এবং ২০০৮ সালের আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় তার বাস্তবায়নও নেই। আইনটি ন্যূনতম বাস্তবায়নের চেষ্টা থাকলেও দেশের হাসপাতালগুলোর চারপাশের ডাস্টবিনে পড়ে থাকা ব্যবহৃত বর্জ্যের ব্যাগ (সিরিঞ্জ, সুচ, পুঁজ মাখা গজ, ব্যান্ডেজ) পড়ে থাকার দৃশ্য দেখতে পেতাম না, এক শ্রেণির মানুষকে ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে আনা সিরিঞ্জ পরে বাজারজাত করতে দেখতাম না, কিংবা দেশের এক-তৃতীয়াংশ ইনজেকশন গ্রহণকারীকে ব্যবহৃত সিরিঞ্জ দিয়ে ইনজেকশন নিয়ে দুরারোগ্য রোগে ভুগতে হতো না। এই অব্যবস্থাপনার কারণেই দেশের ৪০ হাজার নারী ও শিশু বর্জ্য সংগ্রহকারীর অধিকাংশই নানা রোগে ভোগেন।

২০১৮ সালে সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘প্রিজম বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের’ সঙ্গে হাসপাতালের বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য চুক্তি করে। সে অনুযায়ী প্রিজম ঢাকাসহ কয়েকটি বড় শহরের চিকিৎসা বর্জ্য নিষ্কাশনের কাজ করছে। কিন্তু তাদের যন্ত্রপাতি, বর্জ্য সংগ্রহকারী ট্রাক এবং লোকবলসহ নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। এ ছাড়া হাসপাতালে নিয়োজিত স্বাস্থ্য কর্মীদের অপর্যাপ্ত জ্ঞান চিকিৎসা বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার একটি বড় অন্তরায়।

কোভিড-১৯ মহামারি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বল দিকগুলোকে দুর্বলতর করেছে, দৃশ্যমান করেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পিছিয়ে পড়া, দুর্বল, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অমানবিক চিত্র। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্য সব প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে শুধু চিকিৎসা বর্জ্যের কথা যদি আলোচনায় আনি তাহলেও চিত্রটা ভয়াবহ।

বিশ্বখ্যাত মেডিকেল জার্নাল দা ল্যানসেট সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে ৬৫৪টি সরকারি হাসপাতাল ও ৫ হাজার ৫৫টি বেসরকারি হাসপাতাল আছে। মোট শয্যার সংখ্যা ১ লাখ ৪১ হাজার ৯০৩টি। প্রতিটি শয্যা থেকে প্রতিদিন গড়ে ১.৬৩ থেকে ১.৯৯ কেজি চিকিৎসা বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এ বছর এপ্রিল মাসে সারা দেশে ১৪,৫০০ টন চিকিৎসা বর্জ্য তৈরি হয়েছে।

কোভিড ছড়িয়ে পড়ার পর এটা আরও বেড়ে থাকতে পারে। ল্যানসেট লিখেছে, শুধু ঢাকা শহরেই কোভিডের কারণে ২০৬ টন চিকিৎসা বর্জ্য তৈরি হয়েছে। চিকিৎসা বর্জ্যের নিরাপদ নিষ্কাশনের অভাবে কতজন মানুষ কোভিড-১৯সহ নানা সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই বটে, তবে সংখ্যাটা যে অনেক, তা অনুমান করা যায়।

উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ২০০৮ সালের চিকিৎসা বর্জ্য নিষ্কাশন সংক্রান্ত আইনটি সংশোধন করা প্রয়োজন। আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে মেডিকেল ইনসিনেরেটর এবং অটোক্লেভসহ আধুনিক ব্যবস্থা। তরল বর্জ্য নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করতে হবে। হাসপাতালের ব্যবস্থাপক চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারী-কর্মকর্তার প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। চিকিৎসা শিক্ষায়, দন্ত্য চিকিৎসা (ডেন্টিস্ট্রি) কিংবা নার্সিংসহ স্বাস্থ্য শিক্ষার সকল শাখায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর সুনির্দিষ্ট কোর্স সংযুক্ত করতে হবে। স্বাস্থ্য বাজেটে সকল হাসপাতালের চিকিৎসা বর্জ্যের নিরাপদ নিষ্কাশনের জন্য অর্থ বরাদ্দ থাকতে হবে।

ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার: বিশ্ব ব্যাংকের সিনিয়র স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ