আমাদের শৈশব-কৈশোরে ছয়টি ঋতুই স্পষ্ট ছিল। তখন আবহাওয়া চক্রের লয়-তাল এমন বেসুরো হয়নি। আমরা যারা মফস্বলে মানুষ হয়েছি, তারা ঋতুবৈচিত্র্য উপভোগ করেছি তারিয়ে তারিয়ে। এক ঋতু কেটে গিয়ে কখন অন্য ঋতু পড়ে—কোন ঋতু গাছপালায়, ফুলে-ফলে, আকাশে-বাতাসে পরিবর্তন ঘটায় তা স্বাভাবিকভাবেই জানা হয়ে যেত। ভাদ্রের ফুটন্ত কাশফুলে ভরা প্রসারিত চর যে শরৎ ঋতুর বার্তা নিয়ে আসে, তা ক্যালেন্ডারে ছবি দেখে শিখতে হয়নি। এক পা বিভূতিভূষণের আম আঁটির ভেঁপুর অপু-দুর্গার হাত ধরে বাংলার ষড়্ঋতু আর প্রকৃতি পাঠের সঙ্গে হলো প্রথম পরিচয়। আধা শহর আধা গ্রাম মফস্বলে বেড়ে ওঠার সুবাদে বনজ প্রকৃতিকে ঘিরে বাল্য-কৈশোরে যে ভালো লাগার ঘোর লেগেছিল, তা আজও কাটেনি।
শরতের কড়া-মিঠে রোদে ঝকঝকে রুপোর থালার মতো ভেসে বেড়ায় বর্ষণক্লান্ত আকাশ। ভোরের তরুণ রোদ, মেঘহীন নীলাকাশ আর মিঠে বাতাসে খুশির আমেজ। বেলা বাড়ার সঙ্গে ছুটে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে ধূসর মেঘ। আকাশের উজ্জ্বল রং পাল্টে যায়। বাতাস উধাও, সঙ্গে গুমোট গরম। কখনো বা ভারী বৃষ্টি। খানিক পরেই মুঠোয় ভরে ফিরিয়ে নিয়ে আসে রৌদ্দুর শরতের আকাশ। বাঙালি জীবনের বৈপরীত্য এই ঋতুটির স্বভাব। মেজাজে লেপটে আছে এমনিভাবে।
স্মরণ করি সুদূর অতীতের মহাপ্লাবনের শেষে বর্ষণহীন প্রথম রৌদ্রালোকিত অস্ফুট দিনটিকে। যখন ৪০ দিন অবিশ্রান্ত বর্ষণ শেষে নুহ নবীর নৌকো ডাঙায় এসে ঠেকল। সেই মেঘডাকা সকালে সবুজ পত্রমঞ্জরি নিয়ে ফেরা পায়রাটি দেখে উপলব্ধি হলো প্লাবন শেষে নবজীবনের উন্মেষ হয়েছে। এই কাহিনি তো বাল্যকালীন সবটাই পরিচিত। কিন্তু কখনো কি মনে হয়েছে এই স্মরণীয় দিনটি জন্ম হয়েছিল কোন ঋতুতে? সেদিনও কি ছিল এক মনোরম শারদ প্রভাত?
আমাদের মতো সেখানের ঋতুচক্রে বর্ষার শেষে একটি নতুন ঋতুর আবির্ভাব হতো। অবশ্যই অন্য নামে। ভিন্ন ভৌগোলিক আবর্তে হলেও একে শরৎ ঋতু ভাবতে ক্ষতি কী?
প্রাচীন ও মধ্যযুগের রাজা-বাদশাহরা শরতে বানের পানি নেমে গেলে মৃগয়া বা শিকারে বের হতেন। বিনোদনের ছলে প্রজাদের অবস্থা, সেচের ব্যবস্থা, ফসল, গবাদিপশুর হাল-হকিকত স্বচক্ষে দেখাই ছিল রাজা বা সুলতানদের প্রধান লক্ষ্য। তিন মাস ‘বসষাবাস’ শেষে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ময়নামতি, পাহাড়পুরের সংঘারাম ছেড়ে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়তেন গৃহীদের উপদেশ দিতে। রাস্তাঘাট এখন শুকনো—নদীতে ঝড়-ঝাপটার আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে কম। ‘তন্হা’ বা আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নেওয়া দুঃখ থেকে মুক্তির উপায় মনে করিয়ে দিতে এটাই প্রকৃষ্ট সময়। কিছুদিন আগেও এই সময়টাতে পীরসাহেবরা বজরা সাজিয়ে মুরিদ-শাগরেদদের ওয়াজ-নসিহতের উদ্দেশে বিদেশ সফরে রওনা দিতেন। বর্ষার স্থবির কর্মহীন দিনের শেষে শরৎ বয়ে আনে কর্মের আহ্বান—ঘর-গেরস্থালি, চাষাবাদ আর বৃত্তিজীবীদের যার যার কাজ শুরু করার ডাক দিয়ে। বর্ষার পুরো সময়টা শুয়ে-বসে কাটিয়ে এখন বেদেরা তাদের নৌকার বহর নিয়ে এদিকে-সেদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সঙ্গে বেদেনিরা সাপের ঝাঁপি, আলাই-বালাই তাড়ানোর শিকড়-বাকড় আর বশীকরণের ওষুধ। গ্রামের কুমোরপাড়ায় সাজ সাজ রব। আর কদিনের মধ্যে নানা জায়গা থেকে ডাক এসে পড়বে। তখন দম ফেলার ফুরসত হবে না। তাঁতিপাড়ায় রাতেও তাঁত বোনার এখন বিরাম নেই। যে বছর পূজা আর ঈদ অল্প ব্যবধানে আসে, সে বছর তাঁতিপাড়ার তাঁতের মাকুর একঘেয়ে শব্দও দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। সকালের রোদের রং ঠিক কাঁচা সোনার মতো সেই রং বেলি, গন্ধরাজ, জুঁই, শিউলি, শাপলা, চাঁপা, স্থলপদ্ম আর পদ্মের গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। অপুর বোন দুর্গার মতো এই ঋতুটিও যেন কোঁচড়ে, বঁইচি, বেতফল, আমড়া, করমচা আর বনডুমুর বেঁধে আপন মনে ঘুরে বেড়ায়।
প্রবাসীরা এই সময়টিতে ঘরে ফেরে। বিভূতিভূষণ এমনি এক শরতের ছবি এঁকেছেন তাঁর জাদুকরি কলমে। প্রবাসী হরিহর দেশে ফিরছেন দীর্ঘদিন পরে শারদীয় ছুটিতে।
‘আকাশে-বাতাসে গরম রৌদ্রের গন্ধ, নীল নির্মেঘ আকাশের দিকে চাহিলে মনে হঠাৎ উল্লাস আসে। বর্ষা শেষের সবুজ লতাপাতায়, পথিকের চরণ-ভঙ্গীতে কেমন একটা আনন্দ মাখানো। রেলপথের দুপাশে কাশ ফুলের ঝাড় রেলগাড়ির বেগে লুটাইয়া পড়িতেছে। চলিতে চলিতে বাড়ীর কথা মনে হয়।’
দুই.
শহুরে মানুষের ক্লান্তিকর জীবনে শরৎ নিয়ে খানিকটা অস্বস্তি থাকা স্বাভাবিক। বিশেষ করে, ভাদ্রের তালপাকা গরমে অনেকেই হাঁসফাঁস করেন। বিদ্যুৎ না থাকলে প্রশাসনকে কষে গালও দেন। কবি রফিক আজাদের লেখায় ভাদ্র মাস ‘বিধবার শাড়ি’র অনুকল্পে ধরা দেয়। কারণ হিসেবে নিজেই হয়তো সুদূর কৈশোরে ভাদ্রের কোনো এক দিনে কোনো বিধবাকে ধবধবে সাদা শাড়িতে দেখেছিলেন। কিংবা নিজের বোনকে নিহত স্বামীর শোকে কাতর দেখে কষ্ট পেয়েছিলেন—তাঁর অবচেতনে এই দৃশ্যটাই থেকে গিয়ে থাকবে।
আমাদের ঋতুবৈচিত্র্য আমাদের অনুভূতিকে অনেক সময়ই তীব্র এবং সংবেদনশীল করে তোলে। ইংরেজদের ঋতুবৈচিত্র্যের তীব্রতা কম বলে তাদের অনুভূতি অনেক সংযত। ও দেশে ঋতু তো মাত্র চারখানা। গ্রীষ্ম নামে মাত্র, সারা বছরই শীত। শীত একটু কমলে তাকে বলে গ্রীষ্ম, বলে বসন্ত। ইংরেজ শরৎকে মনে করে ফসল কাটার সময় আর আমেরিকা গাছে গাছে পাতা ঝরতে শুরু করলে বলে ফল—আমরা শরৎকে কী চোখেই না দেখি। এ তো ধান পাকানোর ঋতু নয়। এ যে আমাদের আত্মার আত্মীয়। শরতের তরুণ আলোর স্নিগ্ধতাকে হূদয় দিয়ে আহ্বান জানাই। দুই হাত মেলে বলি, ‘আমার নয়ন ভুলানো এলে।’ সাদা কাশবন আর পেঁজাতুলা সাদা মেঘ দেখে দেখে চোখে ক্লান্তি নামে না কখনো। ‘চকিত-চরণ হূদয়-হরণ’—এই ঋতুটিকে বারবার দেখেও যেন আশ মেটে না আমাদের।
মাহবুব আলম: সাবেক রাষ্ট্রদূত, লেখক।