ক্রিকেটের জন্য বিসিবি, নাকি বিসিবির জন্য ক্রিকেট

দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে বিসিবির বর্তমান নেতৃত্বের ওপর খেলোয়াড়েরা আস্থা রাখতে পারছেন না। ছবি: প্রথম আলো
দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে বিসিবির বর্তমান নেতৃত্বের ওপর খেলোয়াড়েরা আস্থা রাখতে পারছেন না। ছবি: প্রথম আলো

ক্রিকেট প্রশাসনের বিরুদ্ধ স্রোতে দাঁড়িয়ে সাকিব ও তাঁর সতীর্থরা। রীতিমতো বোমা ফাটালেন বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। বিভিন্ন দাবি ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে সাকিব সোমবার বলেন, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলার আগেই ফল নির্ধারণ হয়ে যায়। তিনি কিন্তু সরাসরিই পাতানো খেলার অভিযোগ করলেন। কী বিস্ময়কর! একটি দেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ আসরের একটি টুর্নামেন্টে বছরের পর বছর ধরে পাতানো খেলা হচ্ছে। ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থার লোকেরাই এর সঙ্গে জড়িত। 

এই বিসিবির হাতে ক্রিকেট কি নিরাপদ?
ঘরোয়া ক্রিকেটে এখন আর প্রতিযোগিতার কোনো বালাই নেই। আম্পায়াররা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো সিদ্ধান্ত দেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘুরেফিরে কয়েকটি বড় দল এই বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে। বড় দলগুলোর খেলা দেওয়া হয় ঢাকার বাইরে। সেখানে সাংবাদিকেরা কম যান। তাই আম্পায়ারদের একপেশে সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমে খুব বেশি আসে না। এসব বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তর্কবিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু খোদ সাকিব আল হাসান যখন অভিযোগ করেন তখন বুঝতে হবে বিষয়টি অনেক দূর গড়িয়েছে। তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মতো কোনো অভিযোগ সাকিব জনসমক্ষে বলবেন না বলেই মনে হয়। তাও আবার এই বিরুদ্ধ স্রোতে দাঁড়িয়ে।

সাকিবের এই অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত হওয়ার দরকার। এটা প্রমাণিত হলে খোদ বিসিবিই খেলা পাতানোর দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবে। এর আগে আম্পায়ারের পক্ষপাতিত্বের প্রতিবাদে এক বোলার এক ওভারে ৮৭ বা ৯০ রান দিয়েছিলেন। পরে ওই খেলোয়াড় ও ক্লাবকেই সাজা দেয় বিসিবি। বিসিবি কার্যত দুর্নীতিবাজ আম্পায়ারের পক্ষাবলম্বন করেছে। এখনই সতর্ক না হলে বিসিবিকে কঠোর সাজার মুখোমুখি করা হতে পারে আইসিসির তরফ থেকে।

ক্রিকেটাররা বিসিবির চেয়ে যৌক্তিক
নানা অনিয়ম, দুর্নীতিতে দেশের ক্রিকেটের অবস্থা খুবই কাহিল। দেশের ক্রিকেটের নিয়মিত খোঁজখবর যাঁরা রাখেন, তাঁদের কাছে খেলোয়াড়দের ধর্মঘটের কর্মসূচি একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাত না। এটা অনেক দিনের বঞ্চনা ও শোষণের প্রতিক্রিয়া। খেলোয়াড়দের দাবি নিয়েও নানা ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে সাকিব-মুশফিকরা তো লাখ লাখ টাকা বেতন পান। তাঁদের বেতন আর কত বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, খেলোয়াড়েরা কিন্তু জাতীয় দলের চুক্তিভুক্তদের বেতন বাড়াতে বলেননি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের সবার বেতন বাড়াতে বলেছেন। দেশের ছয়টি বিভাগের খেলোয়াড়দের বিসিবি থেকে মাসিক বেতন দেওয়া হয়। সেই বেতন ও ম্যাচ ফি বাড়াতে বলেছেন তাঁরা। এর পেছনে যৌক্তিক কারণও আছে।

বিসিবি এবার খেলোয়াড়দের ন্যূনতম ফিটনেস লেভেল বাড়িয়ে বিপ টেস্টে ১১ পয়েন্ট করেছে। এই পর্যায়ের ফিটনেস বজায় রাখার জন্য যে মাত্রায় জিম প্রশিক্ষণ ও আহারের দরকার হয় তার জন্য পর্যাপ্ত অর্থের প্রয়োজন। এ জন্যই বেতন ও প্রতিটি বিভাগে শরীরচর্চার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবি ক্রিকেটারেরা করেছেন। তাঁরা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে খুবই পরিণত ও পেশাদারির পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেদেরই সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবি করেননি তাঁরা। একই সঙ্গে দেশীয় কোচ, গ্রাউন্ডসম্যান, ফিজিও, ট্রেনারদের সুবিধা বৃদ্ধিরও দাবি করেছেন। এতেই বোঝা যাচ্ছে, আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে ক্রিকেটাররা নিজেদের মধ্যে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা ও আলোচনা করেই দাবিগুলো তুলে ধরেছেন। এ ক্ষেত্রে খেলোয়াড়েরা বিসিবির কর্মকর্তাদের চাইতে বিচক্ষণ ও বিবেচক।

খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত বিষয় তুলে আনা কেন?
দাবি জানানোর পরেও বিসিবির আচরণ ছিল খুবই অপেশাদার। বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসান ব্যক্তিগত বিষয়াদি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন। তিনি বিভিন্ন খেলোয়াড়কে বিভিন্ন সময় সহায়তা করেছেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে খেলোয়াড়েরা ব্যক্তিগতভাবে তাঁর বশংবদ হবেন। তিনি বলেছেন, এমন কোনো সুবিধা নেই যা ক্রিকেটারদের দেওয়া হয় না। কখন কীভাবে বেতন বাড়ানো হয়েছে, বোনাস দেওয়া হয়েছে এসবের ফিরিস্তি দিয়েছেন সংবাদ সম্মেলনে। কিন্তু সভাপতি বুঝতে পারেননি, গুটিকয় খেলোয়াড়কে আর্থিক সুবিধা দিলেই সব ক্রিকেটারের সমস্যা মেটে না। ক্রিকেট কর্তাদের সবার কথাই ভাবা উচিত। খেলোয়াড়েরা কেবল জাতীয় দলের সুবিধা বাড়ানোর কথা বলেননি। তাঁরা সবার সুবিধা বাড়ানোর দাবি তুলেছেন। বিসিবির সভাপতি বোধ হয় বিষয়টি বুঝতে পারেননি। তাই তিনি কেবল জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের কথাই গতকালের সংবাদ সম্মেলনের বেশিটা জুড়ে বলে গেলেন। একপর্যায়ে বলে ফেললেন, ‘খেলোয়াড়েরা না খেললে না খেলবে।’ এটা কোনো কথা হতে পারে?

বিভিন্ন খেলোয়াড়ের বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার উদাহরণগুলো দেওয়ার মাধ্যমে বিসিবি সভাপতি কিন্তু আমাদের দেশের সার্বিক চালচিত্রও তুলে ধরলেন। জাতীয় দলের অল্প কিছু খেলোয়াড়দের এত এত বিপদ-আপদের কথা যা বললেন তা থেকে ধারণা করাই যায় যে সারা দেশে কী হচ্ছে। কোথাও ক্রিকেটারের মামার জমি দখল হয়ে যাচ্ছে, পুলিশ ক্রিকেটারকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে—এসবের সমাধানও তাঁকে নাকি করতে হয়েছে। কিন্তু কেন একজন ক্রিকেটারকে পুলিশ ধরে নিয়ে মেরে ফেলতে চাইবে? এটা কি পুলিশের স্বাভাবিক আচরণ?

বিসিবি নির্বাচনের বলি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ
বিসিবির সভাপতি নিজেই বলেছেন ক্রিকেটারদের উন্নতি হচ্ছে না। কিন্তু উন্নতির পথ তো নিজেরাই ধ্বংস করে দিয়েছেন। দেশের অন্যতম প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ একেবারে শেষ করে দিয়েছে বিসিবির নেতৃত্ব নির্বাচনের রাজনীতি। ঢাকা প্রিমিয়ারের সুপার লিগে ওঠা ৬টি দলের দুটি করে ভোট থাকে বিসিবির নির্বাচনে। এই ছয়টি দলই নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিজেদের ছয়টি দলকে সুপার লিগে ওঠাতে বিসিবির কর্তাব্যক্তিরা হস্তক্ষেপ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এভাবে প্রতিযোগিতা না থাকায় খেলোয়াড়দের মান পড়ে যাচ্ছে। কাউন্সিলরশিপ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বিসিবি তৃতীয় বিভাগের বাছাই কৌশলে বন্ধ করে দিয়েছে। আগে এন্ট্রি ফি ছিল ৫ হাজার টাকা। এখন করা হয়েছে ৫ লাখ টাকা। এই টুর্নামেন্টে মূলত ৫০–৬০টি একাডেমি অংশ নিত। হাজারো কিশোর এসব একাডেমিতে খেলত। এখন বাছাই না থাকায় এসব একাডেমির আয়ও কমে গেছে। এসব একাডেমি এখন বন্ধের মুখে। আবার ৫ লাখ টাকা ফি দিয়ে খেলাও সম্ভব না অনেকের পক্ষে।

ক্লাবের স্বার্থকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে খেলোয়াড়দের আয়ের পথও বন্ধ করে দিয়েছে বিসিবি। ঢাকা প্রিমিয়ারে ড্রাফট পদ্ধতি চালু করে বেতন সীমিত করে দিয়েছে ক্লাবের স্বার্থে। অভিযোগ রয়েছে, ড্রাফটের বাইরের খেলোয়াড়দের বেতন–ভাতাই দেয় না ক্লাবগুলো। খেলোয়াড়দের বড় একটি অংশ সারা বছর এই ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এটা তাঁদের অন্যতম উৎস। এখন দর-কষাকষি করে বেতন নির্ধারণ করতে না পারায় খেলোয়াড়েরা আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে আবার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এবার ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক পদ্ধতি বাতিল করে বিসিবি নিজেরাই বিপিএল আয়োজন করার উদ্যোগ নিয়েছে। এখানে খেলোয়াড়দের আর্থিক ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে। এমনিতেই দেশীয় খেলোয়াড়েরা বিদেশিদের থেকে কম টাকা পান। এর ওপর যদি বিপিএলের সবগুলো দলকে বিসিবি পরিচালনা করে, তবে আয় একেবারেই কমে যাবে। অনেকটা যা দিচ্ছি তাই নিতে হবে; এ রকম এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

কদিন আগেও যাঁকে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান ও প্রভাবশালী পরিচালকদের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল মুখে দেখা গেছে, ক্যাসিনো-কাণ্ডে গ্রেপ্তার হয়ে সেই লোকমান যেন হাসি কেড়ে নিয়েছেন পুরো বোর্ডের!

ক্যাসিনো লোকমানও বিসিবির পরিচালক!
বিসিবির বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে ফিসফাস হতো এত দিন। এবার প্রকাশ্যেই চলে আসছে অনেক কিছু। বিসিবি এখন অনেকেরই আখের গুছিয়ে নেওয়ার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো পরিচালক বেনামে কোম্পানি খুলে বিসিবির কাজ বাগিয়ে নিচ্ছেন। বিপিএলের গ্রাউন্ডস অ্যান্ড অফিশিয়াল স্পনসরশিপ যৌথভাবে পেয়েছিল কে স্পোর্টস ও ঢাকা কমিউনিকেশনস। ঢাকা কমিউনিকেশনসের সঙ্গে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়া পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া জড়িত বলে খবর বেরিয়েছে। এই লোকমান হোসেন এখনো বিসিবির পরিচালক। কদিন আগেও যাঁকে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান ও প্রভাবশালী পরিচালকদের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল মুখে দেখা গেছে, ক্যাসিনো-কাণ্ডে গ্রেপ্তার হয়ে সেই লোকমান যেন হাসি কেড়ে নিয়েছেন পুরো বোর্ডের!

অনুসন্ধান করলে বালিশ–কাণ্ডের মতো বিসিবির নানা আর্থিক অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে। নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে বিসিবির বর্তমান নেতৃত্বের ওপর খেলোয়াড়েরা আস্থা রাখতে পারছেন না। ক্রিকেট আমাদের গর্ব আর উদ্দীপনার সর্বজনীন এক উৎস। ঘুণপোকারা কি এই আশার খুঁটিটাকেও খেয়ে ফেলবে? বল এখন সরকারের কোর্টে।

ড. মারুফ মল্লিক: লেখক এবং ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন