>আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে বিশিষ্ট ব্যক্তি ও একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে লেখা নিবন্ধটি এখানে তুলে ধরা হলো
জাতিসংঘ ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস’ (৩০ আগস্ট) পালনের মুহূর্তে আমরা দিনটির তাৎপর্যের আলোকে দেশে বিরাজমান পরিস্থিতির দিকে ফিরে তাকাতে চাই। আইনের শাসন ও মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন সবাই একমত হবেন যে অপহরণ, গুম, গুপ্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত খুন ও হেফাজতে নির্যাতন ও ন্যায়বিচারের সুযোগহীনতার মতো বিষয়গুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের নৃশংসতম ও চরম অপরাধগুলোর অন্যতম। মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রধানত রাষ্ট্রীয় নীতি ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ঘটার সুযোগ নেই। মানবাধিকারের এসব লঙ্ঘনের কোনোটি বিচ্ছিন্নভাবেও সংঘটিত হয় না, এগুলো পরস্পর সম্পৃক্ত; একটি অপরটিকে আরও গুরুতর দিকে পরিচালিত করে এবং চূড়ান্তভাবে আইনের শাসনকে বিপন্ন করে তোলে।
অন্যভাবে বললে, আইনের শাসনের প্রতি তোয়াক্কা না করার ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রসার ঘটায়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত এ ধরনের অপরাধের দায়িত্বে থাকা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সুযোগসন্ধানী সদস্যরা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে এই পরিস্থিতির সুবিধা নিয়ে থাকেন। কারণ, অনেকেই নিজেদের জবাবদিহির ঊর্ধ্বে হিসেবে বিবেচনা করেন অথবা বেআইনি কাজের সহযোগী হিসেবে তাঁরা ছাড় উপভোগ করেন। এভাবে তাঁরা আইনের শৃঙ্খলা ভাঙায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। সাম্প্রতিক সময়ে এমন উভয়বিধ রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে আইন ভঙ্গ করা এবং ব্যক্তিগত স্বার্থে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ঘটানোর বহু অভিযোগের কথা সংবাদমাধ্যমে এসেছে। উদাহরণ হিসেবে, নারায়ণগঞ্জে সাত ব্যক্তিকে হত্যা করতে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের ব্যবহার করা, ব্যক্তিগত বিরোধ মেটাতে শহীদ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নাতি সৌরভকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে অপহরণ বিষয়ে তাঁর মা-বাবার করা অভিযোগ কিংবা খুলনায় জিআরপি থানার ওসিসহ পাঁচ সদস্য কর্তৃক নারী যাত্রীকে নিপীড়ন ও গণধর্ষণের অভিযোগ কয়েকটি নমুনা মাত্র। আজ আমরা আইনপ্রয়োগে নিয়োজিত কিছু সদস্যের মধ্যে গুরুতর অপরাধে জড়িত হওয়ার এই প্রবণতা লক্ষ করছি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদ্বেগজনক পরিস্থিতির শিকার হচ্ছি।
আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে নিজেদের দিকে ফিরে তাকানোর বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। গত ৩০ ও ৩১ জুলাই জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটির (ক্যাট) ৬৭তম অধিবেশনে নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তিবিরোধী সনদের আওতায় বাংলাদেশের অগ্রগতি পর্যালোচনার সূত্রে পাওয়া তথ্য এবং সেই সভায় আলোচিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুনির্দিষ্ট ঘটনা নিয়ে ব্যক্ত উদ্বেগ আমাদের আলোড়িত না করে পারছে না। এই অধিবেশন শেষ হওয়ার পর দেশের দুটি মানবাধিকারবিষয়ক মঞ্চ, মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি এবং হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ পৃথকভাবে ক্যাট অধিবেশনে বাংলাদেশ-সংক্রান্ত আলোচনা ও সেখানে সরকারের পেশ করা প্রতিবেদন নিয়ে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, তাও আমাদের পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে।
মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির মতামতে বলা হয়েছে (প্রথম আলো, ৪ আগস্ট) ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড় অংশ এবং স্বার্থান্বেষী মহল আইন ও বিচারের ঊর্ধ্বে।’ প্রায় অনুরূপ মন্তব্যই উঠে এসেছে হিউম্যান রাইটস ফোরামের আলোচনায় (প্রথম আলো, ২৩ আগস্ট); ‘এমন কোনো অপরাধ নেই, যার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যুক্ত হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে না।’ শুরুতেই উল্লেখ করা নমুনামূলক তিনটি ঘটনা উভয় মঞ্চের বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণ করে।
অধিবেশন সম্পর্কিত গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী সনদে স্বাক্ষরদাতা হওয়ার পরও আমাদের কোনো সরকার বিগত ২০ বছর এই আন্তর্জাতিক সনদের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রদর্শন করেনি। দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে এবারই প্রথম সেখানে সরকারি প্রতিবেদন পেশ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সনদের প্রতি দায়বদ্ধ না থাকার মাশুল দিতে হচ্ছে আমাদের দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি দিয়ে। ক্যাট অধিবেশনে উত্থাপিত ও আলোচিত তথ্য থেকে আমরা জানতে পারছি, গত ১০ বছরে (২০০৯-১৯) বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ২০৮৮ জন, শুধু ২০১৮ সালেই নিহত হয়েছেন ৪৬৫ জন। সংবাদপত্রের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারছি, গত বছরের মে মাসে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত ৪৫৩ দিনে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৪২৮ জন নিহত হয়েছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এ মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুরূপ হত্যাকাণ্ডে নিহত ৩ জন রাজনৈতিক কর্মী।
গত ১০ বছরে গুম হয়েছেন ৫০৭ জন। গত ২৬ মে ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদন, ‘ব্রিং দেম ব্যাক বিফোর ঈদ’ থেকে গুমসংক্রান্ত আরও কিছু তথ্য জানা যায়। প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের (এফআইএইচআর) হিসাবে ২০০৯-১৮ পর্যন্ত গুমের শিকার হওয়া ৫০৭ জনের মধ্যে ৬২ জনের লাশ পাওয়া গেছে। ওই সময় পর্যন্ত ১৫৯ জনের এখনো কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। এ বছরের প্রথম তিন মাসে গুম হয়েছেন ১২ জন। অন্য সংবাদ থেকে জানা যায়, গত ৯ এপ্রিল থেকে নিখোঁজ রয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সংগঠন ইউপিডিএফের নেতা মাইকেল চাকমা; তাঁর ‘নিখোঁজ’ হওয়া ক্যাট অধিবেশনের আলোচনায় বিশেষভাবে উঠে এসেছে। তাঁর বোন ভাইকে খুঁজে বের করতে উচ্চ আদালতের আশ্রয় নেওয়ার পরও এখন পর্যন্ত তাঁর সন্ধান পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশে আজ কয়েক শ পরিবারের সদস্যরা বছরের পর বছর তাঁদের সন্তান-স্বামী-বাবা-ভাই-বোনকে গুমের মিছিলে হারিয়ে অসহায় জীবন যাপন করছেন। তাঁদেরই অসহায় আর্তি ফুটে উঠেছে ডেইলি স্টারের ওই প্রতিবেদনে। ২৩ বছর ধরে নিখোঁজ কল্পনা চাকমার সন্ধান পাওয়া যায়নি আজও। গুমের শিকার এসব পরিবারের প্রধানতম ভুক্তভোগীরা হচ্ছেন নারী, শিশু এবং প্রবীণ মা-বাবা। বহুবার এসব পরিবারের নানা বয়সের মানুষের মর্মন্তুদ কাহিনি, ফরিয়াদ ও আকুল আবেদন আমরা শুনেছি। আমরা মনে করি, অনতিবিলম্বে অপহরণ ও গুমের অবসান ঘটানোর দায়িত্ব সরকারের। আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে আমরা প্রত্যাশা করব, গুম হওয়া সব মানুষকে অনতিবিলম্বে নিরাপদে ঘরে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। স্বজনহারা ঘরগুলো পরম প্রিয়জনের উপস্থিতির উষ্ণতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে অচিরেই।
পরিশেষে আমরা দাবি করি, ক্যাট তার চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি করতে বাংলাদেশ সরকারকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ড বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করা, গুম এবং যোগাযোগহীনভাবে আটকের সব অভিযোগের তদন্ত করা, মানবাধিকারকর্মীসহ সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ যে ৭৭টি সুপারিশ প্রদান করেছে, সেগুলোর আশু ও কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পথে সব বাধা দূর করা হবে।
বিবৃতি দাতারা হলেন: ‘মায়ের ডাক’ (গুমের শিকার পরিবারগুলোর মঞ্চ), সুভদ্রা চাকমা (‘নিখোঁজ’ মাইকেল চাকমার দিদি), সুলতানা কামাল (মানবাধিকার আন্দোলনের নেত্রী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা), আকমল হোসেন (সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), শাহদীন মালিক (আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট), রেহনুমা আহমেদ (লেখক), আনু মুহাম্মদ (শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়), শহিদুল আলম (আলোকচিত্রী), স্বপন আদনান (সাবেক শিক্ষক, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সিঙ্গাপুর), জ্যোতির্ময় বড়ুয়া (আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট), হাসিবুর রহমান (শিক্ষক, বুয়েট), সারা হোসেন (আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট), শিরিন হক (নারী অধিকার আন্দোলনের সংগঠক), ওমর তারেক চৌধুরী (লেখক-অনুবাদক)