পৃথিবীর প্রাণিকুলের মধ্যে মানুষ এমন একটা জীব, যারা নিজেদের সুবিধার জন্য প্রকৃতিপ্রদত্ত যেকোনো উপাদানকে বিনষ্ট করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হয় না। যেমন ধরুন ঢাকা শহরের জলাধারের কথা। বন্যা রোধে এবং বিভিন্ন ইকোসিস্টেমের সেবা পাওয়ায় জলাধারগুলো ছিল খুবই কার্যকর। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণের নামে আমরা সব ধ্বংস করে এখন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করছি নগরীয় বন্যা বা জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচার জন্য। আর্সেনিক দূষণও এমন একটা গুপ্তঘাতক, যার কারণ মূলত মানুষ কর্তৃক ভূগর্ভস্থ পানির বিজ্ঞানবিরুদ্ধ ব্যবহার। এই দূষণ এমনই বিষাক্ত যে দীর্ঘদিন আর্সেনিকযুক্ত পানি ব্যবহারে মানবদেহে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে, প্রাণঘাতী ক্যানসার পর্যন্তও হতে পারে। এই আর্সেনিক প্রয়োগেই কিন্তু ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্টকে হত্যা করা হয়েছিল। সুতরাং আর্সেনিকযুক্ত পানির নিয়মিত ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের বেলায় কেমন হুমকি, তা সহজেই অনুমেয়।
পরিবেশের সর্বত্র (যেমন: মাটি, পানি, বাতাসে) আর্সেনিক বিদ্যমান। সাধারণত, ভূগর্ভস্থ জলাধারে আর্সেনিক মাটি ও বালুর সঙ্গে অদ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। পৃথিবীর বদ্বীপ অঞ্চলগুলোয় ভূগর্ভস্থ জলাধারে অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে আর্সেনিক দ্রবীভূত হয়ে দূষণ ঘটায়, যা আমাদের ক্ষেত্রেও হচ্ছে। প্রায় ২৫ বছর আগে বাংলাদেশে প্রথম আর্সেনিক শনাক্ত হয় এবং এখন পর্যন্ত দেশের অগভীর নলকূপে আর্সেনিকের উপস্থিতি লক্ষণীয়। বিভিন্ন উৎস থেকে জানা যায়, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৪টিতে আর্সেনিকের বিস্তৃতি রয়েছে। তবে অবস্থানভেদে দূষণের মাত্রা একেক অঞ্চলে একেক রকম। দেশের দক্ষিণাংশে জেলাগুলোয় নলকূপে আর্সেনিকের উপস্থিতি বেশি। পৃথিবীর অনেক দেশে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি থাকলেও জনসংখ্যার আক্রান্তের অনুপাতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ দূষণ সত্যিই ভয়াবহ।
আর্সেনিক দূষণ রোধে যদিও ভুপৃষ্ঠস্ত পানির (নদী, খাল, বিল, পুকুর) ব্যবহারকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তবে মনে রাখা দরকার, আমাদের দেশের সবুজ বিপ্লবে ভূগর্ভস্থ জলাধার সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে বা রেখেছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, ভূপৃষ্ঠের পানি আজ বিভিন্ন কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। তা ছাড়া ভূপৃষ্ঠের পানির পরিশোধন দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে খুবই ব্যয়বহুল এবং সর্বত্র এই পদ্ধতি অনুসরণ করা একপ্রকার অসম্ভব। অন্যদিকে, আমাদের ভূগর্ভস্থ জলাধার খনিজসমৃদ্ধ এবং সহজলভ্য। তাই ভূগর্ভস্থ জলাধারের ব্যবস্থাপনা সঠিক উপায়ে করা গেলে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
যে কোনো বিষয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অন্যতম শর্ত হচ্ছে সঠিক তথ্য ও উপাত্ত। কিন্তু এ বিষয়টি আমাদের দেশে বরাবরই উপেক্ষিত। আর্সেনিকের মতো ধীরলয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রাযুক্তিক ব্যবহার ও গুণগত উপাত্তের সমন্বয় সুদূরপ্রসারী সমাধান দিতে পারে, যা অনেক দেশ করেছে। যত দূর জানা যায়, আর্সেনিক মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোয় দক্ষ পানি-ভূতত্ত্ববিদের অপর্যাপ্ততাও কার্যকর ব্যবস্থাপনাকে ব্যাহত করছে। এ বিষয়েও নজর দেওয়া উচিত। যেহেতু আর্সেনিকের প্রভাব মানবদেহে ধীরে ধীরে দৃষ্টিগোচর হয়, আক্রান্ত জনগোষ্ঠী এটাকে বেশি আমলে নেয় না, তাই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর অগভীর নলকূপ ব্যবহারকারীদের যেকোনো পরিকল্পনায় সম্পৃক্ত করা অত্যাবশ্যক। যেমন স্থানীয় জনগণকে নলকূপের পানির আর্সেনিক নির্ধারণে প্রশিক্ষণ এবং ফিল্টার ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা গেলে সময় ও অর্থ যেমন বাঁচবে, তেমনি বাড়বে গণসচেতনতা। আরেকটি কার্যকর সমাধান হচ্ছে সরকারি নীতিনির্ধারণে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফলকে বিবেচনায় নেওয়া। দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি, বিষয়টি এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে চরমভাবে অবহেলিত।
২০১৮ সালে বিবিএস ও ইউনিসিএফ প্রকাশিত হিসাবে ১৯ দশমিক ৫ মিলিয়ন মানুষ এখনো আর্সেনিকযুক্ত পানি ব্যবহার করে। এ ক্ষেত্রে কোন মাত্রায় আর্সেনিক মানুষের শরীর নিতে পারে, তার আন্তর্জাতিক মান আর বাংলাদেশের মান এক নয়। বাংলাদেশের জন্য পানি নিরাপদ পরিমাণ আর্সেনিক হলো ৫০ পিপিবি। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুসারে ১০ পিপিবি পর্যন্ত নিরাপদ ভাবা হয়।
ভূগর্ভস্থ পানির আর্সেনিক দূষণ এতটাই ভয়ংকর, যা কিনা মানবদেহে একাধিক রোগের বিস্তারে অবদান রাখে বলে গবেষণায় প্রকাশ। তাই দেশে ক্যানসার, স্ট্রোক, হৃদ্রোগে মৃত্যুর হার সাম্প্রতিক বৃদ্ধির সঙ্গে আর্সেনিক দূষণের যোগসূত্র আছে কি না, তার কোনো পরিসংখ্যান কোথাও নেই। এ বিষয়ে এখনই নজর না দিলে একসময় হয়তো দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দুর্গতি আবারও সামনে আসবে, যা প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় দেখা যাচ্ছে।
ড. আশরাফ দেওয়ান: স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস, কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া।