মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান রচনার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত ১৭৮৭ সালের ‘কনস্টিটিউশনাল কনভেনশন’ শেষে ডেলিগেটরা যখন ইনডিপেনডেন্ট হল থেকে বেরিয়ে আসছিলেন, তখন জনৈক মিসেস পাওয়েল বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিনকে জিজ্ঞেস করেন, ‘মিস্টার ফ্রাংকলিন, আমরা কী পেয়েছি? একটি জনতন্ত্র (republic), না রাজতন্ত্র?’ বিনা দ্বিধায় ফ্রাংকলিন উত্তর দেন, ‘একটি জনতন্ত্র ম্যাম, যদি আমরা রাখতে পারি।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এবং ড. কামাল হোসেনের তত্ত্বাবধানে রচিত আমাদের সংবিধানের মাধ্যমে বাংলাদেশের নাগরিকদেরও একটি জনতন্ত্র (যদিও সংবিধানে ‘রিপাবলিক’ শব্দের অনুবাদ হিসেবে ‘গণপ্রজাতন্ত্র’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে) উপহার দেওয়া হয়। বস্তুত, এটি ছিল আমাদের কাছে সংবিধানপ্রণেতাদের পক্ষ থেকে রেখে যাওয়া একটি পবিত্র আমানত। কিন্তু গত ৪২ বছরে এই আমানত শুধু খেয়ানতই করিনি, আমরা যেন গত ৫ জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ‘গুডবাই’ও বলে দিয়েছি।
অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা যে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ‘জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের উইল বা সম্মতির তথা গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেই মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানে আরও সুস্পষ্টভাবে ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র’ (অনুচ্ছেদ ১১) মর্মে অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়।
যেহেতু গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন তথা ভোটের প্রয়োজন হয়, তাই বঙ্গবন্ধুর আমলে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২’ (আরপিও) প্রণীত হয়। আরপিওর ১৯ ধারায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিধান রাখা হয়। এই বিধানের উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর মতো কোনো ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে কেউ যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আগ্রহী না হন, তাহলে তিনি যেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত বলে ঘোষিত হতে পারেন।এই বিধান আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় একটি বিশেষ বা ব্যতিক্রমী অবস্থার সুরাহার লক্ষ্যে, গণহারে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির জন্য নয়। অর্থাৎ, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া একটি ‘এক্সসেপশন’ বা ব্যতিক্রম, ‘রুল’ বা নিয়ম নয়।
এ কথা প্রায় বিনা দ্বিধায় বলা যায়, আমাদের প্রথম সংসদের আইনপ্রণেতারা কল্পনাও করেননি যে ভবিষ্যতে কোনো দিন আমাদের ‘হাউস অব দ্য পিপল’ বা জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ জনগণের ভোট ছাড়াই আইনপ্রণেতা হিসেবে দায়িত্ব
পালন করবেন।তাহলে হয়তো আরপিওতে এই বিধানই তাঁরা রাখতেন না, অথবা এর সঙ্গে এমন শর্ত জুড়ে দিতেন,
যাতে বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব এড়ানো যেত। বস্তুত, আরপিও প্রণীতই হয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার
লক্ষ্য নিয়ে। উদাহরণস্বরূপ, আরপিওর ১৭ ধারায় প্রার্থিতা প্রত্যাহারে সময়সীমা পার হওয়ার পরে কোনো চূড়ান্ত প্রার্থীর মৃত্যু ঘটলে এবং এরপর মাত্র একজন প্রার্থী অবশিষ্ট থাকলেও নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই আমাদের নির্বাচন কমিশন ৫ জানুয়ারি ১৫৩ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হওয়াকে অনুমোদন দিয়ে আরপিওর প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের উদ্দেশ্যকেই ভণ্ডুল করে দিয়েছে। কমিশনের ও রাজনৈতিক দলগুলোর এমন হঠকারিতা ও কারসাজিমূলক কার্যক্রম সচেতন নাগরিকদের শঙ্কিত না করে পারে না।
গণহারে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তথা বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়া আমাদের সংবিধানেরও পরিপন্থী। আমাদের সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিন শত সদস্য লইয়া...সংসদ গঠিত হইবে; সদস্যগণ সংসদ সদস্য বলিয়া অভিহিত হইবেন।’ সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের বক্তব্য অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট এবং ৩০০ জন সংসদ সদস্যের একক নির্বাচনী এলাকা থেকে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটেই নির্বাচিত হতে হবে—এ থেকে ব্যত্যয় ঘটার কোনো সুযোগ নেই। এ কারণেই সংরক্ষিত মহিলা আসন পূরণের জন্য, যাঁদের কোনো একক নির্বাচনী এলাকা নেই এবং যাঁরা পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন, আমাদের সংবিধানে ৬৫(৩) সংযুক্ত করতে হয়েছে। সুতরাং, ৫ জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচনে বিনা ভোটে নির্বাচিত ১৫৩ জনকে সংসদ সদস্য হিসেবে আখ্যায়িত করা সমীচীন নয় বলেই অনেকের ধারণা। প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক কালে উচ্চ আদালত ভোট প্রদানকে নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন [(২০০২)৫এসসিসি] এবং নাগরিকদের সচরাচর তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বসবাসকারী ৫২ শতাংশ ভোটারকে তাঁদের ভোট প্রদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
অন্য একটি বিবেচনায়ও আমরা ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ‘গুডবাই’ বলে দিয়েছি। গণতন্ত্র হলো জনগণের সম্মতির শাসন। আর জনগণের সম্মতি অর্জিত হয় ভোটের মাধ্যমে। নির্বাচন কমিশনের চরম প্রশ্নবিদ্ধ হিসাবমতে, ৫ জানুয়ারি যে ১৪৭টি আসনে নির্বাচন হয়েছে, তাতে ভোট পড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ বা এক কোটি ৭২ লাখ, যা সর্বমোট প্রায় নয় কোটি ২০ লাখ ভোটারের মাত্র ১৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ। তাই কমিশনের হিসাব অনুযায়ীই দশম জাতীয় সংসদে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ১৯ শতাংশের কম। অন্যদিকে, ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের মতে, যা নিয়েও অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে, ১৪৭টি আসনে ভোট পড়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ। এই হিসাব অনুযায়ী ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ১৫ শতাংশের কম। এ ধরনের ভোটার উপস্থিতি—১৫ বা ১৯ শতাংশ (অনেকের মতে তারও অনেক কম)—কোনোভাবেই জনগণের সম্মতির পরিচায়ক নয়। তাই ৫ জানুয়ারি আমাদের গণতন্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করার পরিবর্তে ধ্বংসের দিকেই ঠেলে দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর নেতৃত্বে আমাদের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া একটি রায় বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এ এফ এম শাহ আলম বনাম মুজিবর রহমান [৪১ডিএলআর (এডি)১৯৮৯] মামলার রায়ে বিচারপতি চৌধুরী বলেন: ‘নির্বাচন নেই, গণতন্ত্রও নেই। গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে নির্বাচন প্রয়োজন এবং ভোটারবিহীন ও বিকৃত নির্বাচন গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে।’ আমাদের উচ্চ আদালতের এ রায় নিঃসন্দেহে ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন ও বিকৃত নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মনে রাখা প্রয়োজন যে গণতন্ত্র আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ, তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ব্যাপারে আপস করার কোনো অবকাশ নেই।
এ ছাড়া কুলদীপ নায়ার বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া [(২০০৬) ৭ এসসিসি ১] মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ‘সংসদীয় গণতন্ত্র ও বহুদলীয় গণতন্ত্র ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অন্তর্নিহিত অংশ’ বলে রায় দিয়েছেন। একই যুক্তি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র আমাদের সংবিধানেরও মৌলিক কাঠামোর অংশ। কিন্তু আমাদের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোনোভাবেই ‘ইনক্লুসিভ’ বা অংশগ্রহণমূলক ছিল না এবং এতে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিফলনও ঘটেনি। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে ৪১টি রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিবন্ধিত। এর মধ্যে মাত্র ১২টি বা ২৯ শতাংশ দল, যার অধিকাংশই নামসর্বস্ব, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। এ নির্বাচনে মোট ৫৪৩ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন এবং এর মধ্য থেকে আবার ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এর বিপরীতে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীর সংখ্যা ছিল এক হাজার ৫৬৭ জন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে সাম্প্রতিক নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির সংখ্যাও ছিল অতি নগণ্য। তাই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন কোনোভাবেই অংশগ্রহণমূলক ছিল না, এমনকি এটিকে সত্যিকার অর্থে নির্বাচনও বলা যায় না।
পরিশেষে, ৫ জানুয়ারির কলঙ্কজনক নির্বাচনের তাৎপর্য অত্যন্ত ভয়াবহ। এবারের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ১৫৩ জন যদি ‘প্রিসিডেন্ট’ বা দৃষ্টান্ত হিসেবে থেকে যান, তাহলে আগামী নির্বাচনে এর চেয়ে বেশিসংখ্যক ব্যক্তি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে আর বাধা থাকবে না। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ৩০০ জন সংসদ সদস্যই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়ে আসার আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই এটা প্রায় বিনা দ্বিধায় বলা যায় যে একতরফা ও প্রশ্নবিদ্ধ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই গুডবাই বলে দিয়েছি। আর এর ফলে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার সাংবিধানিক নির্দেশনাই শুধু উপেক্ষিত হয়নি, এর মাধ্যমে ‘জেনুইন’ বা সঠিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা–সংবলিত আন্তর্জাতিক আইন (যেমন, সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ) ও চুক্তিও (যেমন: ইন্টারন্যাশনাল কভেনেন্ট অন সিভিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইট্স) আমরা লঙ্ঘন করেছি।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।