প্রযুক্তি ও মানুষ

গুগল গুরু

কথা প্রসঙ্গে আমি আর আমার স্ত্রী আলাপ করছিলাম ১৯৭০-এর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় নিয়ে। পাশের চেয়ারে বসা আমাদের ছোট ছেলে, যার জন্ম ২০০১-এ, যার শৈশবের অধিকাংশই কেটেছে বিলাতে, বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ, ওটা তো হয়েছিল ১২ নভেম্বরে। ওই সাইক্লোনটাকে ভোলা সাইক্লোনও বলে, প্রায় পাঁচ লাখ লোক মারা গিয়েছিল।’ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করি, ‘তুমি এত সব জানলে কী করে? সে হাসতে হাসতে বলে, ‘গুগল আছে না?’ আমরা যখন আলাপ করছি, সে তখন তার পকেট থেকে মোবাইল বের করে চটজলদি গুগল সার্চ করে জোগাড় করে ফেলেছে সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ের সব তথ্য।

সন্দেহ নেই, এক নতুন গুরুর আবির্ভাব ঘটেছে গুগল নামে। এই গুরুর কাছে যাবতীয় তথ্য জমা আছে। শুধু একটা ক্লিকের ভেতরই সে আলাদিনের দৈত্যের মতো হাজির হবে যেকোনো তথ্য নিয়ে। অনলাইনের এই আশ্চর্য গুরু জগৎকে পাল্টে দিয়েছে, দিচ্ছে, দেবে। বিস্মিত হতে হতে ভাবি, এই গুরু পৃথিবীকে ঠিক কীভাবে পাল্টাচ্ছে, পাল্টে কোথায় নিচ্ছে? আমাদের এক বন্ধু ছিল, যার দখলে জগৎ-সংসারের অগণিত তথ্য। বিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাসের যেকোনো বিষয়ে তথ্য তার নখদর্পণে। তাকে ডাকা হতো ‘লিভিং এনসাইক্লোপিডিয়া’ বলে। সবারই সমীহের পাত্র ছিল সে। কিন্তু অনলাইনের ‘উইকিপিডিয়া’ আসার পর তার যাবতীয় জানাশোনা পরিণত হলো নেহাতই ধুলো-কাদায়। অনলাইনের মাধ্যমে তথ্যের এই সর্বজনীন হয়ে ওঠা নতুন কালের বড় অর্জন নিঃসন্দেহে।

তবে ভাবার বিষয় যে তথ্য থাকলেই ‘জ্ঞান’ হয় না আর জ্ঞান থাকলেই আসে না ‘অন্তর্দৃষ্টি’। শাস্ত্রে আছে, অধ্যাপক দেন তথ্য, পণ্ডিত দেন ব্যাখ্যা আর গুরু দেন অন্তর্দৃষ্টি। অন্তর্দৃষ্টির জন্য চাই সান্নিধ্য। প্রশ্ন জাগতে পারে, গুগল থেকে তথ্য পাওয়া যেতে পারে, হয়তো পাওয়া যেতে পারে জ্ঞানও; কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া যায় কি? সেই অর্থে গুগল কি সত্যিই গুরু হয়ে উঠতে পারছে? বলা বাহুল্য যে তথ্যসম্ভার নিয়ে গুগলের এই কেরামতি তো মানুষেরই জোগান দেওয়া। এটি কোনো স্বয়ম্ভু, অদৃশ্য শক্তির গায়েবি বার্তা নয়। বহু ভাষায় গুগল সার্চ সম্ভব হলেও বিশেষ কিছু ভাষারই কর্তৃত্ব রয়েছে সেখানে। বাংলা ভাষায় বহু তথ্য, জ্ঞান গুগলের গভীরে ডুব দিয়েও পাওয়া যাবে না। তথ্যের, জ্ঞানের, ক্ষমতার রাজনীতি আছে সেখানে। ফলে গুগলকে সবজান্তা না ভেবে তার সীমাবদ্ধতার কথাও মনে রাখা প্রয়োজন।

অনলাইন ও মানব কর্তৃত্ব বিষয়ে বিশেষভাবে লেখালেখি করেছেন চিন্তাবিদ ইউভাল নোয়া হারারি। তিনি বলছেন, প্রাচীনকালে মানুষ কোনো অদৃশ্য সৃষ্টিকর্তার একক কর্তৃত্বে বিশ্বাস করত। তারপর একটা যুগ এল, যখন মানুষের বিশ্বাস জন্মাল ব্যক্তির ওপর। গণতন্ত্রের ধারণা, বাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, মানবিক অধিকার ইত্যাদি সব ভাবনার মূলে আছে ব্যক্তির কর্তৃত্বের ধারণা। অদৃশ্য সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্ব এবং ব্যক্তির কর্তৃত্ব—এই দুই ধারণা কমবেশি সভ্যতার নানা কালে বহাল রয়েছে। হারারি বলছেন, মানুষের সমাজ ক্রমেই এমন একটা নতুন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে, যেখানে কর্তৃত্বের জায়গাটি দখল করছে অনলাইন জগৎ। এই অনলাইন জগৎ যেন এক অদৃশ্য স্বয়ম্ভু শক্তি হয়ে মানুষকে চালাচ্ছে। তথ্যের জন্য, ধারণার জন্য, ব্যবসার জন্য মানুষ দ্বারস্থ হচ্ছে অনলাইন শক্তির কাছে। গুগল গুরুর কাছে। রাস্তাঘাটে, মার্কেটে, শপিং মলে ব্যবসা গুটিয়ে অগণিত প্রতিষ্ঠান এখন ঢুকে পড়েছে অনলাইনের ভার্চ্যুয়াল জগতে। গান বা ফিল্মের সিডির দোকান এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন, সেসব এখন চলে গেছে অনলাইনে। ইউরোপে বহু ব্যাংক তাদের অধিকাংশ শাখা অফিস বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ, অনলাইন ব্যাংকিং করার লোক বেড়ে গেছে বহুগুণে। বইয়ের দোকান কমে আসছে ই-বুক আসার পর। একে একে সবকিছু ক্রমেই এক আশ্চর্য ভার্চ্যুয়াল ছায়াপথে ঢুকে পড়ছে। এর একটা ব্যাপক অভিঘাত আছে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে। হারারি আশঙ্কা করছেন, একটা সময় অচিরেই আসবে, যখন একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর আর কোনো কাজ থাকবে না। কারণ, করার মতো কোনো কাজই পৃথিবীতে থাকবে না। সব কাজ ঘটবে ভার্চ্যুয়াল জগতে। শুধু ভার্চ্যুয়াল জগতের জ্ঞানসম্পন্ন সীমিতসংখ্যক মানুষ থাকবে কর্মরত।

গুগল গুরু এখন মানুষের চেয়েও বিশ্বস্ত। কোনো মনস্তত্ত্ববিদ নন, অনলাইনে আপনার আচরণ, পছন্দ ইত্যাদি দেখে অনলাইনের কোনো সার্চ ইঞ্জিন আপনাকে বলে দিতে পারবে আপনি কেমন ধরনের মানুষ, কী কী ঘটবে আপনার জীবনে। অনলাইন জগতের বিস্ময়কর সংযোজন ফেসবুক পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে দিয়েছে একটা পাবলিক পরিসর। প্রাইভেট আর পাবলিক পরিসরের সীমা যেন ভেঙে গেছে। ছোট্ট এক শহরের কোনো গৃহিণী আজ যে সবজি-খিচুড়ি রেঁধেছেন, ছবির মাধ্যমে সে সংবাদ তিনি জানিয়ে দিতে পারেন বিশ্বময়, পাড়ার সবচেয়ে লাজুক ছেলেটিও ফেসবুকে হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ। ফেসবুক মানুষের ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তির অভিজ্ঞতার ধরনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। নিজের একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অনুভবের গুরুত্বের চেয়ে বড় হয়ে উঠছে অন্যে তার অভিজ্ঞতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করছে, তার। নিজের আটপৌরে কোনো ঘটনার ছবি তুলে পোস্ট করে, কিংবা টুকরো কোনো ভাবনাকে নিজের টাইমলাইনে শোকেসের মতো সাজিয়ে রেখে অপেক্ষা চলতে থাকে কে কী মন্তব্য করছে, কতগুলো লাইক পাওয়া যাচ্ছে, তা দেখার। ব্যক্তি কী অনুভব করছে, তার চেয়ে বড় হয়ে উঠছে তার অভিজ্ঞতায় অন্যেরা কী অনুভব করছে, সেটাতে। ছবির মাধ্যমে ভার্চ্যুয়াল পৃথিবীতে যার যার একটা সফল, সুখী, সার্থক জীবনের চিত্রনাট্য নির্মাণের সুযোগ করে দিয়েছে ফেসবুক। নিজের সত্যিকার জীবনের সঙ্গে তার মিল থাকুক বা না থাকুক, ফেসবুকে সে একটা সমান্তরাল জীবনযাপন করতে পারে। ফেসবুক গাণিতিক সূত্রে জানিয়ে দিতে পারে কোন বন্ধু কাকে নির্দিষ্ট ঠিক কতবার ‘লাইক’ করেছে। বহু মানুষ অজান্তেই হয়ে উঠছে অনলাইন পৃথিবীর পুতুলনাচের ইতিকথার কুশীলব।

অনলাইন এক অনন্যসাধারণ সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে মানুষের সামনে। কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষ এই অমিত সম্ভাবনাকে সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করবেন, সেটাই কাম্য। হারারি বলছেন, মানুষ জাতির জন্য একটা বড় ঝুঁকি হচ্ছে নানা অনলাইন ‘জায়ান্ট’ মানুষকে নেহাত একটা ‘অডিও ভিজ্যুয়াল প্রাণী’তে রূপান্তরিত করতে চাইছে। কিন্তু অনলাইনের বাইরে অফলাইনে চোখ, কান আর দশটা আঙুল ছাড়াও যে সার্বিক শারীরিক মানুষ আছে, সেই সার্বিক মানুষের পারস্পরিক সান্নিধ্যের ওপর নির্ভর করছে এই প্রজাতির ভবিষ্যৎ। দেখা যাচ্ছে, অনলাইনে মানুষ যত তুখোড় হয়ে উঠছে, অফলাইনে হয়ে উঠছে ততই অদক্ষ। অনলাইনে এক হাজার বন্ধু থাকলেও হয়তো অফলাইনে একটাও প্রকৃত বন্ধু নেই তার, অগণিত ভিডিও গেমে অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারী সন্তান পারে না মা–বাবার সঙ্গে গুছিয়ে দুটো কথা বলতে। অনলাইনে যে বিপ্লব জোয়ার আনে, অফলাইনে এসে সে বিপ্লব মুখ থুবড়ে পড়ে। কারণ, অফলাইনের জগতে আছে সীমাহীন অনিশ্চয়তা, দ্বিধা, বিশৃঙ্খলা। স্ক্রিনের বাইরের এই এলোমেলো পৃথিবীতে টিকে থাকাই এখন হয়ে উঠছে মানুষের বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চাই অনলাইন আর অফলাইন জীবনের ভারসাম্য। গুগল গুরু আর মানুষ গুরু দুটিতেই চাই নিষ্ঠা।

শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com