মতামত

গণতন্ত্র সম্মেলন সহযোগিতা বাড়াবে, নাকি সংঘাত

গণতন্ত্রের দাবিতে বিক্ষোভরত এক তরুণকে বন্দি করে নিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা
ছবি : রয়টার্স

‘মুক্ত’ বিশ্বের স্ব অভিষিক্ত নেতা হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ‘গণতন্ত্র সম্মেলন’ ডেকেছেন।৯–১০ ডিসেম্বর সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বিশ্বের নানা প্রান্তের ১১০ জন সরকারপ্রধান সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। ফ্রিডম হাউস সূচকে গণতন্ত্রচর্চার যে মাপকাঠি, তাতে আমন্ত্রিত অনেক দেশের অবস্থান মোটেই ভালো নয়। ফ্রিডম হাউসের সূচক অনুসারে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষ ২৫ দেশের মধ্যে নেই। সূচকে দক্ষিণ কোরিয়া, পানামা ও রুমানিয়ার সঙ্গে একই অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ঘানা ও পোলান্ড এবং আর্জেন্টিনা ও ক্রোয়েশিয়া থেকে সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে।

গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যথাযথ দৃষ্টান্ত নয়। বেশির ভাগ আমন্ত্রিত নেতা সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, পাছে ‘স্বাধীনতাপ্রিয়’ হোয়াইট হাউসের রোষে তাঁরা না পড়েন। ইতিহাস বলছে, যুক্তরাষ্ট্র কারও ওপর বেশি বিরক্ত হলে তাদের সেনারা আমন্ত্রণ ছাড়াই সেখানে গিয়ে দেশটির নাগরিকদের আমেরিকান মূল্যবোধ ‘শিখিয়ে দেয়’। সাম্প্রতিক কালে আফগানিস্তান এমন একটি দৃষ্টান্ত, যেখানকার মানুষেরা ২০ বছর ধরে আমেরিকান কায়দার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ উপভোগ করেছে। লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়া একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে।

শোকেস গণতন্ত্রের অনন্য শক্তি
সম্মেলনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, ‘এই সম্মেলন গণতন্ত্রের অনন্য শক্তির নজির হয়ে থাকবে। অসম্পূর্ণতাকে অকপটে স্বীকার করবে এবং খোলাখুলি ও স্বচ্ছভাবে বিতর্ক করবে।’ পুরোপুরি কার্যকর একটা গণতান্ত্রিক দেশে নাগরকিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও ভোট দিতে উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে আমরা বিপরীতটা দেখতে পাই। সেখানে বড় দুটি দলের মধ্যেই রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভ। যুক্তরাষ্ট্রে আইনের প্রতি অবজ্ঞা বাড়ছে এবং আইনপ্রণয়নের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের মধ্যেই আইনভঙ্গের ঘটনা বাড়ছে। যার সম্পদ ও ক্ষমতা যত বেশি, তার মধ্যে আইন অবজ্ঞার প্রবণতা তত বেশি।

বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলনে মানবাধিকার বিষয়টি আলোচনার প্রধান একটি ইস্যু থাকবে। জনসাধারণের ধারণার বিপরীত বলে মনে হলেও জাতিসংঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত মানবাধিকার নীতির মধ্যে পার্থক্য আছে। যুক্তরাষ্ট্রে মূলধারার সাদারা যে মাত্রায় মানবাধিকার ভোগ করেন, অন্য বর্ণ এবং গৃহহীন ও গরিব মানুষ সেই অধিকার পান না।

আইনের প্রতি এই অবজ্ঞা শুধু অতিধনী ও ক্ষমতবানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আমরা সাধারণ আমেরিকানরাও আমাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও অধিকারকে সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিই। উচ্চ সংক্রমণশীল কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে মাস্ক না পরা এবং টিকা না নেওয়ার অধিকারের কথা আমরা জোর গলায় বলেছি। অস্ত্র বহনের অধিকার রক্ষার জন্য আমরা শেষনিশ্বাস পর্যন্ত লড়ে যেতে রাজি। এমনকি একজন গর্ভবতী নারীর নিজের স্বাস্থ্য ও ভ্রূণের ভালোমন্দের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কেন থাকবে—এ বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত যেতে পারি।

আমাদের রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচিত নন, কেননা, তাঁরা জাতীয় স্বার্থের ওপরে ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগত স্বার্থকে স্থান দেন। কেননা, রাজনৈতিক প্রচারণার সময়ে ওই গোষ্ঠীগুলো তাদের প্রচুর টাকা দেয়। রাজনৈতিক প্রচারণার সময় নেতারা নিজেদের মধ্যে বিবাদ এবং বিমানে চড়ে প্রচারণায় ব্যস্ত থাকেন কিন্তু দেশের জন্য অতিদরকারি ইস্যুগুলো এড়িয়ে যান। অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থানের মতো বিষয়গুলো তাঁরা পরবর্তী নির্বাচনের জন্য শিকেয় তুলে রাখেন।

বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলনে মানবাধিকার বিষয়টি আলোচনার প্রধান একটি ইস্যু থাকবে। জনসাধারণের ধারণার বিপরীত বলে মনে হলেও জাতিসংঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত মানবাধিকার নীতির মধ্যে পার্থক্য আছে। যুক্তরাষ্ট্রে মূলধারার সাদারা যে মাত্রায় মানবাধিকার ভোগ করেন, অন্য বর্ণ এবং গৃহহীন ও গরিব মানুষ সেই অধিকার পান না।

সবচেয়ে বেশি কারাবন্দী যুক্তরাষ্ট্রে
মানুষকে কারাগারে বন্দী রাখতে আমরা খুবই পটু। সারা বিশ্বে যে পরিমাণ মানুষ কারারুদ্ধ অবস্থায়, তার চার ভাগের এক ভাগ বন্দী মার্কিন কারাগারগুলোতে আছেন। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪ শতাংশ আমেরিকায় বাস করে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত মানুষকে কারাগারে বন্দী রাখা হয় না।

মানুষকে কারাগারে বন্দী রাখতে আমরা খুবই পটু। সারা বিশ্বে যে পরিমাণ মানুষ কারারুদ্ধ অবস্থায়, তার চার ভাগের এক ভাগ বন্দী মার্কিন কারাগারগুলোতে আছেন। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪ শতাংশ আমেরিকায় বাস করে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত মানুষকে কারাগারে বন্দী রাখা হয় না।

উচ্চপ্রযুক্তির উদ্ভাবনে আমরা সবকিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এসব প্রযুক্তি ব্যবহারে আমরাই কারান্তরীণ করার ক্ষেত্রে বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছি। বস্তুত, স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে মানুষকে স্বাধীনতার মূল্যবোধ শেখাচ্ছি। আমাদের কারাব্যবস্থা আমেরিকার অন্যতম বড় শিল্প। যত বেশি মানুষকে আমরা কারাগারে রাখতে পারব, তত বেশিসংখ্যক জেলারকে নিয়োগ দিতে পারব। রাষ্ট্রীয় সুবিধা থেকে বন্দী ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে অর্থ জোগানো হয়। যাঁরা আমাদের দেশে অভিবাসী হয়ে আসেন, তাঁরা জানেন, আমেরিকা মোটেই সমান সুযোগের দেশ নয়।

এ প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র সম্মেলনে আসা নেতাদের কাছ থেকে আমরা কী প্রত্যাশা করতে পারি? নেতাদের মধ্যে কেউ কি তাঁর বক্তব্যে যাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, তাদেরসহ বিশ্বের সব দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহযোগিতার কথা বলবেন? জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড মহামারি ও শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় সব দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার কথা কেউ কি বলতে পারবেন? নাকি উপস্থিত নেতারা চুপচাপ বসে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নিজস্ব ধরনের মানবাধিকার–বিষয়ক বক্তব্য শুনবেন? মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর তাদের বিবৃতিতে খোলাখুলি ও স্বচ্ছ বিতর্কের কথা বলেছে। কিন্তু বাইডেন তো যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা স্বীকারই করেন না। এর বদলে যেসব দেশকে সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, সেসব দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার অভিযোগ করতে তিনি পছন্দ করেন।

বাইডেনের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য চীন। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার, গৃহহীন মানুষের জন্য তাঁবুর শহর চীনে নেই। চীন ৮০ কোটির বেশি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছে। তাদের জন্য গৃহ, স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করেছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দেশগুলোর সঙ্গে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করছে। বিশ্বের মানুষের সামগ্রিক উপকারের কথা চিন্তা করছে।

জর্জ কো আন্তর্জাতিক কৌশলগত জোটের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক মহাব্যবস্থাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত