খালেদা জিয়া আবার বের হলেন দেশের পথে। বিলাতের পথ থেকে তিন মাস পর ফিরে সোজা নামলেন বাংলার রাজপথে। লন্ডনের ওই তিন মাস তো বটেই, তার আগের কয়েক বছরও তিনি একপ্রকার ‘নির্বাসিতই’ ছিলেন গুলশানের নতুন বাড়িতে। স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তিনি থাকতে পারেননি। তাঁর রাজনীতি হয়ে পড়েছিল প্রায় ‘ঘরোয়া’। নেতার জন্য জনগণ হলো মাছের জন্য পানির মতো। বিএনপি নেত্রী অনেক দিন জনসংস্পর্শের বাইরে ছিলেন; ডাঙায় পড়া মাছের মতোই ছিলেন। এবারের সফরে তিনি মাঠে ফিরলেন, বিএনপির মাঠপর্যায়ের সমর্থেকরাও তাঁর সেই ফেরা চাক্ষুষ করতে মাঠেই অর্থাৎ রাজপথের দুপাশে ছিল। বিপুলভাবেই ছিল। কিন্তু এই বের হওয়া কতটা টেকসই হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তিনি কতটা পারবেন এই সফর বরং তারই ‘টেস্ট ড্রাইভ’—পরীক্ষামূলক যাত্রা।
কী অদ্ভুত কাকতাল। আজ থেকে ঠিক ছয় বছর আগে এ রকমই এক লম্বা সফর শুরু করেছিলেন। সেটাও ছিল অক্টোবর মাস, সেটাও ছিল ক্ষমতা হারানোর পর নতুন পরিস্থিতিতে তাঁর সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক ‘টেস্ট ড্রাইভ’। অর্থাৎ সেই সফরে তিনি তাঁর দলের রাজনৈতিক ‘ঘর’ গোছাতে নেমেছিলেন। দীর্ঘ তিন বছর নিচু মাত্রার রাজনৈতিক তৎপরতার পর ২০১১ সালের অক্টোবর মাসের গোড়ায় তিনি রোড মার্চে নামলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটাকে ‘রোড মার্চ নয় রোড শো’ বলে কটাক্ষও করেছিলেন। ২০০৬ সালে ক্ষমতা হারানো, জেলবাস, ২০০৮-এর ৩১ জানুয়ারি নির্বাচনে পরাজয় এবং তার ফলস্বরূপ দলের মুষড়ে পড়া অবস্থা থেকে সেটাও ছিল উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা। হামলা-বিস্ফোরণ সেবারের সফরেও হয়েছিল। ঢাকা থেকে সিলেট অভিমুখে চারদলীয় জোটের সেই রোডমার্চে অংশ নিয়েছিল তিন হাজারেরও বেশি গাড়ির বহর। পথে তিনি ছয়টি জেলায় ছয়টি পথসভায় বক্তব্য দেন, বিভাগীয় শহরে জনসভা করেন। উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমে তিনি ছুটে বেড়িয়েছিলেন। ক্ষমতাহীন ও দুস্থ বিএনপি সেই সফরে কিছুটা চাঙা হয়েছিল।
দলটি তার ফল পেয়েছিল পরের বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে। বড় বড় সিটির মেয়র পদে সেবার বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরাই বেশির ভাগ বিজয় পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর আসল লক্ষ্য ছিল ২০১৩ সালের জাতীয় নির্বাচন, যে নির্বাচনে তাঁর দল অংশ নেয়নি বা নিতে পারেনি। এবারও খুব নিকটে ছয়টি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। এবারও তাঁর আসল লক্ষ্য খুব নিকটের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এবারও তিনি পথে নেমেছেন। কিন্তু এবারও কি ২০১৩-এর মতো ব্যর্থ হবেন? এবারও কি নির্বাচন তাঁর আওতার বাইরে অধরাই থেকে যাবে?
ঢাকা থেকে কক্সবাজারের এই পথ আদালতে যাওয়া-আসার সেই একঘেয়ে যানজটবহুল পথ নয়, এই পথ রাজনীতির মহাসড়কের জনতাবহুল পথ। এই পথে কাঁটা যেমন ছিল, তেমনি সমর্থকদের অভ্যর্থনাও ছিল। এবং বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান যে অলংকার, সেই ‘আগুন’ও ছিল। দেশের প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী সফরের কাজে দেশের দূর-দূরান্তে যাবেন, এটাই স্বাভাবিক। পাশাপাশি বিরোধী দলের নেত্রীর গাড়িবহরে হামলা হওয়াও বাংলাদেশের রাজনৈতিক চল, মোটেই অস্বাভাবিক কিছু না। এই গন্ডগোলময় রাজনৈতিক যাত্রাই বাংলাদেশের স্বাভাবিকতা। খালেদার গাড়িবহরে হামলা ও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা তাই বাংলাদেশি মাপে ‘স্বাভাবিক’ই বটে!
কিন্তু যদি মনে রাখি ‘বালুর ট্রাক’, যদি মনে রাখি পেট্রলবোমার মৌসুম, যদি মনে রাখি নির্বাচন ঘিরে ২০১৩-১৪ সালের অজস্র মৃত্যুর চালচিত্র, তাহলে বলতে হবে, খালেদা জিয়ার এই সফর তুলনায় শান্তিপূর্ণই ছিল। যাকে বলে জনসভা, তা তিনি করেননি বা করতে পারেননি। ফলে নতুন পরিস্থিতিতে কী তাঁর রাজনৈতিক রোডম্যাপ, তা বলার উপযুক্ত সুযোগ এবার হয়তো ছিল না। তারপরও ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে সমর্থকদের অভ্যর্থনা বিএনপির জন্য খরার দিনে একঝলক বৃষ্টিপাতের মতো। তৃষ্ণার্ত বিএনপির শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া গলা কিছুটা হয়তো ভিজল। বিএনপির রাজনৈতিক গাড়িটি চলে কি না, চলতে পারে কি না, চলতে দেওয়া হয় কি না—এ সবকিছুর পরীক্ষা এই দফায় হয়েও গেল। ফল আপাতত বিএনপির জন্য খুবই ইতিবাচক। বর্তমান অবস্থায় বিএনপির জন্য খালেদার এই সফর ছিল নতুন টেস্ট ড্রাইভ। কিন্তু কী আছে সামনের পথে? কলির সন্ধ্যা এখনো আসেনি। কী আছে সরকারের মনে, তা দেখার জন্য আরও অপেক্ষা বাকি।
অন্যদিকে, সরকার যে সফরটি করতে দিল, তাদের জন্যও এটা একটা ‘পরীক্ষা’। ক্ষমতাসীন দলও রোহিঙ্গা ইস্যু কাজে লাগিয়ে বিএনপির হালে পানি পাওয়ার এই চেষ্টা ও তার ফল দেখল। বিএনপির টেস্ট ড্রাইভ তাই আওয়ামী লীগেরও টেস্ট ড্রাইভ। আওয়ামী লীগ না চাইলে খালেদা জিয়া এই সফর করতে পারতেন না। হতে পারে এটা সরকারের কৌশল। হয়তো লাগামটা একটু আলগা করে তারা বোঝাতে চাইল, আগামী নির্বাচন তারা ‘নিরপেক্ষভাবেই’ করতে চায়। প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কিছুটা সুযোগ দিয়ে তারাও বাস্তবতাটা মাপতে চাইল। খালেদা জিয়াকে এভাবে জনসংযোগ করতে দিলে কী হতে পারে, সেটাও তাদের না বোঝার কথা নয়। বিএনপি নেতাদের কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসার বিষয়টিও নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের চোখে পড়ার কথা। কিন্তু এ ধরনের কৌশলগত ছাড় পরে বিএনপির জন্য ফাঁদে পরিণত হয়েছিল। কিংবা বলা যায়, সেসব ছাড়ের ফায়দা তুলতে দলটি ব্যর্থও হয়েছিল। তাই আগাম বলার উপায় নেই যে রাজনীতি শান্তির ধারায় ফিরছে।
তবে খেয়াল করার বিষয়, ফেনীতে দুই দফা হামলা হলেও সফরটি হতে পেরেছ। আওয়ামী লীগের মুখরা নেতারা রীতি অনুযায়ী খালেদা জিয়াকে নিয়ে ফোঁড়ন কাটলেও কঠিন শত্রুতামূলক আচরণ সরকার করেনি। পাশাপাশি গতকাল বুধবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের বক্তব্য খেয়াল করুন, ‘এই মুহূর্তে বিএনপি কোনো কঠোর (অ্যাগ্রেসিভ) কর্মসূচি দিতে চায় না...সমঝোতার রাস্তা বিএনপি খোলা রাখতে চায়।’ বিএনপির বক্তব্য এবং সরকারের সংযম বরফ গলার ইঙ্গিত দেয়।
এসব থেকে কি মনে করা যায়, দুই দল আগামী দিনের রাজনীতি নিয়ে অলিখিত সমঝোতায় আসছে? সমঝোতার প্রধান শর্ত আপস। সেই আপসটা তাহলে কে করছে? সরকারপক্ষ? বিরোধীপক্ষ? নাকি উভয় পক্ষ?
খালেদা জিয়ার কক্সবাজার সফর রাজনীতিতে সমঝোতার টেস্ট ড্রাইভ হয়ে উঠুক। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে জাতীয় ঐক্য দরকার, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে জীবন্ত করার জন্য আগামী নির্বাচন বিষয়ে সমঝোতা দরকার, জনগণের উন্নয়ন ও শান্তির জন্যও বাঁচো ও বাঁচতে দাও ধরনের আস্থা ফিরে আসা দরকার। কতিপয় দলকানা ছাড়া বেশির ভাগ জনগণ সেটাই আশা করে।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothom-alo.info