দক্ষিণ এশিয়ায় নির্বাচনের মৌসুম এগিয়ে চলছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। নেপালে গত নভেম্বর-ডিসেম্বরের নির্বাচন অভূতপূর্ব রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এনে দিয়েছে। সব অনিশ্চয়তার মুখে ছাই দিয়ে পাকিস্তানে ‘কেয়ারটেকার সরকার’ নির্বাচন শেষ করেছে। ভারতে কয়েক মাস পরই লোকসভা নির্বাচন হবে। শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হবে আগামী বছরের শেষে। ইতিমধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থিতা নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়ে গেছে। তবে উপমহাদেশজুড়ে এ মুহূর্তে নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের বিশেষ নজর মালদ্বীপের দিকে।
অতীতে মালদ্বীপের রাজনীতি-অর্থনীতি দক্ষিণ এশিয়ায় সামান্যই মনোযোগ পেত। কিন্তু মালদ্বীপকে ঘিরে চীন-ভারত ছায়াযুদ্ধের কারণে দেশটির আগামী মাসের নির্বাচন নিয়ে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতিকেরা অভূতপূর্ব আগ্রহ দেখাচ্ছেন। ২৩ সেপ্টেম্বর দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনকে নিয়ে নয়াদিল্লি বিশেষভাবে অসুখী। বছরের শুরুতে ভারতীয় প্রচারমাধ্যমগুলো মালদ্বীপে সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য সরকারকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছিল। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। কিন্তু কূটনীতিক যুদ্ধাবস্থা বজায় আছে এখনো। সর্বশেষ আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে, নিজ ভূখণ্ড থেকে ভারতীয় সামরিক হেলিকপ্টার ও সামরিক ব্যক্তিদের সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছে মালদ্বীপ। দেশটিতে ভারতের প্রায় ৩০ জন সামরিক ব্যক্তি রয়েছেন, যাঁদের ভিসার মেয়াদ জুনে শেষ হলেও তাঁরা স্বদেশে ফিরছেন না। মালদ্বীপ বলছে, এসব হেলিকপ্টার ও সামরিক কর্মীদের আর দরকার নেই তাদের। কিন্তু এঁদের ফেরতের দাবির জবাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মালদ্বীপে অধিকতর গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য অনুরোধ করেছেন। তিনি মালদ্বীপ পরিস্থিতিকে ‘আন্তর্জাতিক উদ্বেগ’-এর বিষয় বলেও উল্লেখ করেন।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর আকুতি বোধগম্য। মালদ্বীপের ভারত সমর্থক হিসেবে বিবেচিত ডেমোক্রেটিক পার্টির গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদদের চরম কোণঠাসা করে রেখেছেন প্রগ্রেসিভ পার্টির নেতা ইয়ামিন। এরূপ রাজনীতিবিদদের কেউ নির্বাসনে, কেউবা কারাগারে এখন।
নয়াদিল্লির জন্য এর চেয়েও উদ্বেগজনক দিক হলো মালে ক্রমাগত এমন আচরণ করছে, যা ভারতের ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বছরের শুরুতে সন্নিহিত সাগরে ভারতের নৌমহড়ায় অংশ নিতে অস্বীকার করে মালদ্বীপ। সম্প্রতি দ্বীপরাষ্ট্রটিতে বেসামরিক কাজে যাওয়া ভারতীয়দের ভিসার মেয়াদ বাড়ানোও অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজের সুযোগ পেলেও গত ছয় মাসে ওয়ার্ক পারমিটের অভাবে অন্তত দুই হাজার ভারতীয় মালদ্বীপে ঢুকতে পারেননি। মালদ্বীপের বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও উদীয়মান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে কর্মী নিয়োগে ভারতীয়দের বাদ দিচ্ছে।
মালদ্বীপের পাশে শক্তভাবে চীন
ভারতের মালদ্বীপ সংকটের শুরু গত ফেব্রুয়ারি থেকে। তখন প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, দেশটির উচ্চ আদালত তা অবৈধ হিসেবে রায় দেন। নির্বাহী বিভাগ বনাম বিচার বিভাগের ওই শক্তি পরীক্ষায় ইয়ামিন খোদ প্রধান বিচারপতি আবদুল্লাহ শহীদকেই আটক করেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট মাউমুন আবদুল গাইয়ুমও এ মুহূর্তে কারাগারে আছেন। ইয়ামিনের ৮০ বছর বয়সী সৎভাই গাইয়ুম ১৯৭৮ সাল থেকে প্রায় ৩০ বছর দেশটি শাসন করেছিলেন। তাঁকে মালদ্বীপের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ মনে করা হতো।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের ভারতবিরোধী ভূমিকার শক্তি-ভিত হলো চীনের সমর্থন। ভারতের প্রচারমাধ্যম প্রতিনিয়ত এ রকম ধারণা প্রচার করছে।
ভৌগোলিকভাবে ভারতের আয়তন প্রায় ৩৩ লাখ বর্গ কিলোমিটার। চীনের আয়তন তার চেয়েও প্রায় তিন গুণ বেশি। অথচ এই দুই দেশই এখন ৩০০ বর্গ কিলোমিটারের চেয়েও ছোট মালদ্বীপে গোপন এক শক্তি পরীক্ষায় লিপ্ত।
গাইয়ুমসহ অতীতের সব শাসকই ক্ষমতায় থাকাকালে সামরিক ও বেসামরিক সাহায্যের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ১৯৮৮ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থান চেষ্টা থেকেও গাইয়ুমকে রক্ষা করে ভারত। সেই থেকে মালদ্বীপের ভারতবলয়ভুক্তি কূটনীতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইয়ামিন প্রেসিডেন্ট হয়ে সে ধারা বদলে নিয়েছেন। তাঁর পাশে বেশ শক্ত অবস্থানেই দেখা যাচ্ছে চীনকে। অথচ মালদ্বীপে চীনের দূতাবাস প্রতিষ্ঠার ইতিহাস মাত্র সাত বছরের। গত ফেব্রুয়ারিতে ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপের শঙ্কার মুখে চীন খোলামেলাভাবে তার বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়েছিল। ভারতীয় ‘জিএমআর’ কোম্পানির কাছ থেকে রাজধানীসংলগ্ন প্রধান বিমানবন্দর সম্প্রসারণের ঠিকাদারিও চীন কেড়ে নিয়েছে ইয়ামিনের সহায়তায়। এই প্রকল্পের ব্যবসায়িক মূল্য ৫১১ মিলিয়ন ডলার হলেও প্রতীকী মূল্য অনেক বেশি। ছোট ছোট দ্বীপের অবকাঠামো উন্নয়নে অগ্রাধিকারও পেয়েছে চীন। একাধিক দ্বীপের সঙ্গে রাজধানী মালের সেতু তৈরি করছে চীনের বিভিন্ন কোম্পানি। এসব সেতু নির্মাণে প্রায় ২২০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। পাশাপাশি সাত হাজার ফ্ল্যাটের ১৬টি ভবন বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এসব প্রকল্প দেশটির অর্থনীতিতে বাড়তি গতি এনে দেবে বলে অনুমান করছে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ উভয়ে। তবে মালদ্বীপ চীনের ঋণ-জালে বাঁধা পড়ছে বলেও তাদের শঙ্কা আছে।
বসতি গড়ে ওঠেনি—এমন কিছু দ্বীপ মালে সরকার দীর্ঘ মেয়াদে চীনকে লিজ দেওয়ায় ভারত বিশেষভাবে শঙ্কিত। মালদ্বীপের পার্লামেন্ট সংবিধানে এমন পরিবর্তনও এনেছে যে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগকারীরা দেশটিতে জমি ক্রয় করতে পারবেন।
নয়াদিল্লি মনে করে, এসব পদক্ষেপ তার জন্য উদ্বেগজনক। ভূখণ্ডগত মালিকানা পেয়ে পাশের মহাসাগরে ভারতীয় স্বার্থের ওপর নজরদারি বাড়াতে পারবে চীন। এই উদ্বেগের মাঝেই চীন-মালদ্বীপ ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট করে নিয়েছে। অপর কোনো দেশের সঙ্গে মালদ্বীপের এরূপ চুক্তি এই প্রথম। এসব উদ্যোগের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। এখন সম্ভবত চীন চাইছে না যে মালদ্বীপে ভারতীয় সামরিক ব্যক্তিরা উপস্থিত থেকে তাদের কার্যক্রমের ওপর নজরদারি করুক। সেই সূত্রেই ইয়ামিন ভারতীয় নিরাপত্তাকর্মীদের মালদ্বীপ ছাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা একে মনে করছেন অপমানকর এক প্রস্তাব।
সার্কভুক্ত একমাত্র মালদ্বীপেই মোদি কোনো সফরে যাননি আজও। দেশটি এও ঘোষণা দিয়েছে, চীন ছাড়াও ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানের সঙ্গে তারা ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট করতে ইচ্ছুক। তাদের এই ইচ্ছার তালিকায় ভারতের নাম নেই। স্বভাবত, নয়াদিল্লি তাতে ক্ষুব্ধ না হয়ে পারে না। কিন্তু নয়াদিল্লির ক্ষোভ যত বাড়ছে, বেইজিং ততই শক্তভাবে মালের পাশে দাঁড়াচ্ছে। গড়ে প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ চীনা মালদ্বীপে বেড়াতে আসছে। ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য এটা দারুণ প্রোটিনের মতো কাজ করছে। চীনের প্রেসিডেন্টও গত বছর সফর করে গেছেন দেশটি।
ভারতের জন্য দুঃস্বপ্ন
মালদ্বীপ ভারতের কয়েক শত কিলোমিটার দূরের প্রতিবেশী হলেও ভারত মহাসাগরে তার কর্তৃত্বের প্রশ্নে ছোট্ট এই দ্বীপরাষ্ট্রের রয়েছে ব্যাপক গুরুত্ব। বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত নৌপরিবহন রুট মালদ্বীপ উপকূল। ভারতের বৈদেশিক পণ্য পরিবহনের ৯০ শতাংশই এই পথে হচ্ছে। এই জলরাশির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা বাণিজ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে চীন ও ভারত উভয়ের জন্য জরুরি। বিশ্বের নেতৃত্ব নিয়ে চীন বনাম যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব যত বাড়ছে এবং ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মৈত্রী যত তীব্র হচ্ছে, ততই মালদ্বীপ উপকূলকে ঘিরে চীন-ভারত ছদ্মযুদ্ধ প্রকাশ্য রূপ নিচ্ছে।
আপাতত এই ছায়াযুদ্ধের একজন বলি হলেন মালদ্বীপের বিরোধীদলীয় নেতা মোহাম্মদ নাশিদ, গাইয়ুমের তিন দশকের পর যাঁর হাত ধরে দেশটিতে গণতন্ত্র এসেছিল। বর্তমান প্রেসিডেন্টের আমলে আদালতের প্রশ্নবিদ্ধ এক রায়ে অভিযুক্ত হয়ে আসন্ন নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। শ্রীলঙ্কায় স্বেচ্ছানির্বাসিত জীবন যাপন করছেন নাশিদ। ফলে, আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইয়ামিনকে চ্যালেঞ্জ করার মতো সুপরিচিত কোনো ব্যক্তি নেই এ মুহূর্তে। বিরোধী ডেমোক্রেটিক পার্টি ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ নামে যাঁকে প্রার্থী করেছে, ইয়ামিনকে মোকাবিলার মতো তাঁর যথেষ্ট শক্তি-ভিত নেই বলেই মনে হচ্ছে। ইয়ামিনের গত পাঁচ বছর ভারতের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো কেটেছে। একইরূপ আরও পাঁচ বছর তাদের জন্য হতে পারে বিপুল হতাশার। তবে নয়াদিল্লির জন্য সুবিধার দিক হলো, মালদ্বীপ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার পাশে আছে। ফলে মালদ্বীপ এখন বৈশ্বিক ঠান্ডা যুদ্ধেরই এক উত্তেজক ক্ষেত্র। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরও এই উত্তেজনা চলবে মনে হয়।
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক