সাভার ট্র্যাজেডি

ক্ষতিপূরণের কী হলো?

মানুষের জীবনের কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না। কিন্তু যখন কারও অপরাধে অন্য কারও জীবন যায়, কিংবা অচল হয়ে পড়ে কেউ, তখন ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন আসে দুটো কারণে। প্রথমত, নিহত হওয়ার কারণে তাঁর পরিবারের যে অসহায় অবস্থা, তা আর্থিকভাবে কিছুটা সামাল দেওয়া এবং দ্বিতীয়ত, অপরাধী ব্যক্তির জন্য একটা আর্থিক চাপ তৈরি করা, যাতে ভবিষ্যতে অন্যরা একই ধরনের অপরাধ না করে। 

তাজরীন ফ্যাশনসের শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়েছিল সাত লাখ টাকা করে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর তহবিল ও মন্ত্রণালয়ের টাকা অর্থাৎ জনগণের টাকাও আছে। বিজিএমইএ ও ক্রেতারা আছে, কিন্তু মালিকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে কোনো টাকার কথা শোনা যায়নি। এখনো নিখোঁজ কয়েকজনের ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদান বাকি আছে। আহত ব্যক্তিদের অনেকের চিকিৎসার খবর নেই। রানা প্লাজার ভয়ংকর ঘটনার পর বিজিএমইএর নেতারা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, ক্ষতিপূরণের অর্থ অন্তত তাজরীনের চেয়ে কম হবে না। বেশিই হবে। বলেছেন, আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার সব দায়িত্ব তাঁদের। সংবাদমাধ্যমে যত দিন বেশ লেখালেখি চলছিল, তত দিন এসব কথা শোনা গেছে, সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি কমে যাওয়া বা প্রায় বন্ধ হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে তাঁদের কথা আর কাজে যথারীতি ব্যাপক ফারাক। তাঁরা কী আশা করছেন? সময়ে সবাই ভুলে যাবে? দেশের আরও অঘটনে চাপা পড়ে যাবে তাঁদের সব কলঙ্ক?

ক্ষতিপূরণ কত হওয়া উচিত, সেটা নিয়ে নানা হিসাব আছে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষারত কয়েকজন প্রবাসী শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন পদ্ধতি ও দেশের বিদ্যমান মজুরিকাঠামো বিশ্লেষণ করে ক্ষতিপূরণের একটি ছক দিয়েছেন। তাতে ক্ষতিপূরণ দাঁড়ায় সর্বনিম্ন প্রায় নয় লাখ থেকে সর্বোচ্চ প্রায় ৫৪ লাখ টাকা। (প্রথম আলো, ২৭ মে, ২০১৩)। তাজরীন ফ্যাশনসের সময়েই আমরা দেখেছিলাম, ১৮৫৫ সালের চরম দুর্ঘটনা আইন অনুযায়ী গড়ে কম করে ধরলেও ক্ষতিপূরণ দাঁড়ায় ৪৮ লাখ টাকা। অন্যদিকে আইএলওসহ আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মজুরিকাঠামো বিবেচনা করে পরিবারপ্রতি ক্ষতিপূরণ দাঁড়ায় প্রায় ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে সংশ্লিষ্ট সবার অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। অনুপাত অনুযায়ী, সরকার শতকরা ৯ ভাগ, বিজিএমইএ শতকরা ১৮ ভাগ, মালিক ২৮ ভাগ এবং ব্র্যান্ড বিক্রেতা-প্রতিষ্ঠান শতকরা ৪৫ ভাগ বহন করবে।

রানা প্লাজার ভয়ংকর জীবননাশের পর দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে বহু সভা-সম্মেলন হচ্ছে, অনেক রকম প্রতিশ্রুতিও শোনা যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে টাকাও উঠেছে। কিন্তু শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ নিয়ে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ঘোষণা করেনি বিজিএমইএ বা সরকার। কদিন আগে বাজেট পাস হলো। খুবই স্বাভাবিক ছিল, এই বাজেটে পোশাকশিল্প খাতের জন্য সরকারের যথাযথ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের রূপরেখা থাকবে। কিন্তু বাজেটে এ ধরনের কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। অথচ পোশাকশিল্প খাতের ভঙ্গুর দশার জন্য সরকারের দায় অনেকখানি। ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টরদের এখনো যা সংখ্যা ও ক্ষমতা, তাতে পোশাকশিল্প খাতের তত্ত্বাবধানে সরকারের যে কোনো আগ্রহ নেই, সেটাই বোঝা যায়। ছেড়ে দেওয়া আছে মালিকদের যথেচ্ছাচারের ওপর। কিন্তু কারখানা যদি ভুল স্থান ও ভুল ভবনে স্থাপিত হয়, যদি সেখানে মুনাফার সীমাহীন লোভে ব্যক্তি মালিক শ্রমিক-নিরাপত্তার ন্যূনতম ব্যবস্থা না রাখেন, তাহলে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব সরকারেরই। এই কাজ না করলে শিল্প মন্ত্রণালয় ও শ্রম মন্ত্রণালয় আছে কেন? দুর্যোগ মোকাবিলায় ফায়ার সার্ভিসকে শক্তিশালী করার বড় পরিকল্পনা খুবই স্বাভাবিক ছিল, বাজেটে তারও প্রতিফলন নেই।

এর মধ্যে পোশাকশিল্প খাতকে শায়েস্তা করার ঘোষণা দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছেন। এটা এক অদ্ভুত ঘোষণা। কারণ, বাংলাদেশের পোশাকশিল্প খাত যুক্তরাষ্ট্রের কোনো জিএসপি বা শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা পায় না, কখনোই পায়নি। বরং অন্য অনেক দেশের তুলনায় ৫ থেকে ১৫ গুণ বেশি শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করে। এ রকম বৈষম্যমূলক ও সংরক্ষণবাদী শুল্কনীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার বা বিজিএমইএকে কখনো কথা বলতে শুনিনি। বরং তারা সব সময় হাতে-পায়ে ধরার পথেই আছে। যা বাংলাদেশ পায় না, সেটাই স্থগিত করার অর্থ কী? সংগত কারণেই পোশাকশিল্পকে শায়েস্তা করার কথা বলে জিএসপি স্থগিত করায় পোশাকশিল্পের রপ্তানি কমারও সম্ভাবনা নেই। পোশাকশিল্পের মুনাফার বড় ভাগীদার ব্র্যান্ড ও বায়িং হাউস। তারাও নিজেদের স্বার্থেই রপ্তানি নিশ্চিত করবে। কিন্তু ক্ষতির মুখে পড়ছে বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত পণ্যের মধ্যে অন্যগুলো, যেমন প্লাস্টিক, সিরামিক, খাদ্য, মানুষের চুল, পাখির পালক, খেলনা ইত্যাদি। এগুলো মোট রপ্তানির শতকরা ১ ভাগেরও কম। এগুলো উদীয়মান শিল্প, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো অভিযোগ এদের বিরুদ্ধে শোনা যায়নি। অথচ তারাই শাস্তিপ্রাপ্ত।

রপ্তানি কমার সম্ভাবনা না থাকলেও, মার্কিন ঘোষণার কারণে, পোশাকশিল্প খাতে এখন ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদের বিভিন্ন স্তর থেকে দর-কষাকষির ক্ষমতা বাড়বে। তারা মার্কিন এই শাস্তির সূত্র ধরে আরও দাম কমানোর চাপ দিতে পারে। দাম কমানোর পর নিজের মুনাফা ধরে রাখতে মালিকেরা প্রয়োজনীয় কাজে খরচ আরও কমানোর পথে যেতে পারেন। জিএসপি ভয় দেখিয়ে মালিকদেরও শ্রমিকদের সঙ্গে দর-কষাকষির ক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হলো। প্রকৃত মজুরি কমাতেও নানা কায়দা-কানুন দেখা যাবে। সবার মুনাফা রক্ষা করতে গিয়ে শ্রমিকের ওপর সব চাপ ফেলার এই ধারা বরাবর চলছে, সেটাই আরও জোরদার করার অবস্থা তৈরি করল ওবামা সরকার। অর্থাৎ শ্রমিক স্বার্থের কথা বলে জিএসপি স্থগিত করলেও শ্রমিকদের জন্য নতুন হুমকি তৈরি করল তারা।

এটা নিশ্চিত যে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প বর্তমানের অবস্থায় চলতে পারবে না। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের সঙ্গে যুক্ত একজন ভারতীয় ব্যবসায়ী সেখানকার এক পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, বর্তমানে এই শিল্পে ভারত ও শ্রীলঙ্কার বায়িং হাউস ও কর্মকর্তাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। যৌথ বিনিয়োগ আছে। প্রায় ৪০০টি ভারতীয় বায়িং হাউস কাজ করছে এখানে। সাব-কন্ট্রাক্টও দিচ্ছে তারা বাংলাদেশে। (দ্য হিন্দু বিজনেসলাইন, জুন ৩, ২০১৩) পাশাপাশি ভারত তার দেশে পোশাকশিল্পগুকে একটি শক্তপোক্ত জায়গায় দাঁড় করাতে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পাটশিল্পের মতোই এই পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন ভারতকে পোশাকশিল্পের ক্ষেত্রেও শক্তিশালী জায়গায় প্রতিষ্ঠা করবে।

একটি শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ অবকাঠামো আর শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম শ্রমিকের জীবন ও নিরাপত্তা ছাড়া কিছু লোক কিছুদিন মুনাফার পাহাড় গড়তে পারে, কিন্তু শিল্পের বিকাশ নিশ্চিত হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি স্থগিত নিয়ে মাতামাতি, দোষারোপ, কাকুতি-মিনতি আর হাতে-পায়ে ধরে কোনো ফল হবে না। এমনিতেও পোশাকশিল্প কোনো জিএসপি সুবিধা পায়নি, মার্কিন বাণিজ্যনীতি অনুযায়ী ভবিষ্যতেও পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় নতুন নতুন বাজার সন্ধান করতে হবে। সর্বোপরি, পোশাকশিল্প সাবালক কাঠামোয় স্থাপন করার জন্য একটি সামগ্রিক পুনর্গঠনের লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। তার জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ দরকার। নিহত ও আহত শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিপূরণ, গ্রহণযোগ্য ন্যূনতম মজুরি, গণতান্ত্রিক শ্রম আইন এবং সে সঙ্গে কারখানা ও শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা তার প্রাথমিক ধাপ।

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।