কৌতুকে নারী, অপমানিত ও বিকৃত

কয়েক দিন আগে একটি বিপণিবিতানে গিয়েছিলাম প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা করতে। জীবাণুনাশক বুথে ঢুকেছি। হঠাৎ কানে ভেসে এল ‘আমার বউ জন্মের কিপটে। আজ কীভাবে যে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার টাকাটা দিল, আল্লাহ জানে! শালার মেয়েমানুষ!’ মন্তব্য শুনে ভেতরটা তিতা হয়ে এল। আমার পেছনে দুজন তরুণ; বয়স বড়জোর ২৫ থেকে ২৬ বছর! স্থির চোখে আমি তাকালাম মন্তব্যকারী তরুণটির দিকে। ছেলেটির মুখের হাসি একমুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। চোখ নামিয়ে নিল সে। আমি জীবাণুনাশক বুথ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। কিন্তু কানের কাছে বারবার অনুরণিত হতে থাকল ‘শালার মেয়েমানুষ...!’ মন্তব্যকারী তরুণটির স্ত্রীর কল্পিত মুখটি ভেবে আহত হচ্ছিলাম বারবার। আরও ভাবছিলাম নারীর প্রতি কতটা অশ্রদ্ধা আর ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বড় হচ্ছে একটি প্রজন্ম! এর দায় তো আমাদের সবার।

কেনাকাটা শেষে গাড়িতে বসে ফেসবুকের পাতা খুলতেই খুঁজে পেলাম বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিচিত একজন অধ্যাপকের স্ট্যাটাস। সেখানে তিনি স্ত্রীবিষয়ক তিন থেকে চারখানা আদিরসাত্মক কৌতুকের অবতারণা করেছেন। কৌতুকের বিষয়বস্তু স্ত্রীর অনাকর্ষণীয় মেদবহুল স্থূল শরীর, দীর্ঘদিনের দাম্পত্য সম্পর্কের একঘেয়েমি, স্ত্রীর বুদ্ধিহীনতা, কর্কশ ব্যবহার কিংবা স্বৈরাচারী আচরণ। ফেসবুকের ওয়ালে তো বটেই, বন্ধুদের গ্রুপের পোস্টেও প্রায়ই লক্ষ করি নারীর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য নিয়ে, এমনকি নিজের স্ত্রীকে নিয়ে চটুল পোস্ট আর মন্তব্য, যা বিনোদনের খোরাক হয়ে ওঠে অনেকের কাছেই। এই পোস্টগুলো যেন চুম্বকের মতো টানতে থাকে সবাইকে। অংশগ্রহণের নেশায় মত্ত অনেককেই আবার মাত্রাজ্ঞান হারাতে দেখি। কে লিখছেন, কী লিখছেন, কার সম্পর্কে লিখছেন, সম্পর্কের পবিত্রতা ও মর্যাদা, সম্পর্কের প্রতি দায়বদ্ধতা ইত্যাদি বিষয় যেন তালগোল পাকিয়ে যায়। নগ্নভাবে বেরিয়ে আসে অন্তঃসারশূন্য ব্যক্তিত্ব। এই আলোচনায় যে শুধু পুরুষেরাই অংশগ্রহণ করেন, তা কিন্তু নয়; বিপুলসংখ্যক নারীও অংশ নেন এসব আলাপে। প্রতিবাদ করলে উল্টো প্রতিবাদকারীই একঘরে হয়ে পড়েন। ‘মজা তো মজাই’—এ ধারণার আড়ালে অপমানিত হতে থাকে নারীসত্তা।

নারীকে নিয়ে কৌতুকের ধারাটি খুব জনপ্রিয় আমাদের সমাজে। নারীর প্রতি অমর্যাদাকর শব্দ কিংবা ধারণার প্রয়োগ, কৌতুকে নারীকে অসম্মানজনকভাবে উপস্থাপন কিংবা স্ত্রীকে নিয়ে ঠাট্টা–মশকরা করার এই ধারা কিন্তু নতুন নয়। স্ত্রীকে নিয়ে নানা ঠাট্টা-তামাশার বিষয়টি লক্ষ করেছি সেই শৈশবে। বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক পরিসরে বড়দের আড্ডায় স্বাভাবিকভাবে এসবের চর্চা হতে দেখেছি। স্কুলে শিক্ষকদের রুমেও এসব নিয়ে জমজমাট আলোচনা হতে শুনেছি।

নারীকে নিয়ে কৌতুকের ধারাটি খুব জনপ্রিয় আমাদের সমাজে।

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে বন্ধুদের আড্ডায় নারীবিষয়ক রঙ্গ–তামাশা ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কর্মজীবনেও লক্ষ করেছি একই প্রবণতা। ছাপার কাগজে নারীকে কেন্দ্র করে ঠাট্টা-তামাশার বিষয়টি লক্ষ করেছি শৈশবেই সেই সময়ের নামকরা কিছু পত্রিকার কৌতুক বিভাগে, এমনকি ঈদসংখ্যায়, যেখানে নারীকে চিত্রিত করা হতো অবিবেচক, বুদ্ধিহীন, অবিমৃশ্যকারী, স্বৈরাচারী, বেহিসাবি কিংবা অতি কৃপণ হিসেবে। অন্যদিকে পুরুষকে চিত্রায়ণ করা হতো অতি ভদ্র, গোবেচারা হিসেবে, যিনি অনেকটাই স্ত্রীর অধীনস্থ। সেসব কৌতুকে ব্যবহৃত ছবিতে নারীর শরীরের যেমন চটুল উপস্থাপন থাকত, ঠিক তেমনি থাকত নারীর আচার-আচরণের বিদ্রূপাত্মক উপস্থাপন। সেই ধারা থেকে আমরা আজও বের হয়ে আসতে পারিনি।

শুধু কৌতুকই নয়, বিভিন্ন স্বনামধন্য লেখকের লেখায় সেকালে তো বটেই, একালেও লক্ষ করি নারীর প্রতি অবমাননাকর হাস্যরসাত্মক মন্তব্য কিংবা কৌতুক। এমনকি এই চর্চা থেকে বাদ যায় না শিশু-কিশোর সাহিত্য পর্যন্ত। শিশু-কিশোর সাহিত্যিকেরা প্রায়ই ভুলে যান শিশুদের মানস গঠনের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার কথা। শিশুর মধ্যে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সমতাপূর্ণ সমাজ গঠনের বীজটি বপনের গুরুদায়িত্বের কথা অনেকেই ভুলে যান।

মনে রাখা প্রয়োজন, নারীর স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্যগুলোর অতিরঞ্জিত কিংবা হাস্যরসাত্মক উপস্থাপন ক্ষণিকের জন্য পাঠকের মনে বিনোদনের উদ্রেক করলেও দীর্ঘ মেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে নারীর সামাজিক অবস্থানের ওপর। এসব কৌতুকে প্রায়ই নারীকে পারিবারিক জীবনে চরম পরাক্রমশালী, স্বৈরশাসক হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হলেও বাস্তবতা এই যে এ দেশের ৭০ শতাংশের ওপরে নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন, যৌন নির্যাতনের শিকার হন তিনজনের মধ্যে একজন নারী। নারীর সঞ্চয়ের প্রবণতা নিয়ে প্রতিমুহূর্তে হাস্যরসের অবতারণা করা হলেও সত্য এই যে তাঁর এই সঞ্চয়প্রবণতা জন্ম দিয়েছিল সভ্যতার। আজও পরিবারের সবচেয়ে বিপদেও মুহূর্তে নারী এগিয়ে আসেন তাঁর সঞ্চয়ের শেষ অর্থটুকু নিয়ে। জানি না নাজুক অবস্থানে বসবাসরত নারীর এমন বেমানান চিত্রায়ণের মধ্যে অদ্ভুত কোনো আনন্দ আছে কি না!

অনেক নারীই আবার বুঝে উঠতে পারেন না, এ ধরনের হাস্যরস নারীর নিজের আত্মসম্মানের জন্য কতখানি অবমাননাকর। পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষতান্ত্রিক দর্শন আর চর্চার মধ্যে বেড়ে ওঠা নারীর দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যক্তিত্বও প্রভাবিত হয় পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা। তাই তাঁদের আত্মবিশ্বাস আর আত্মমর্যাদাও অনেক ক্ষেত্রে পূর্ণরূপে বিকশিত হয় না। এ ধরনের বক্রোক্তি আর ঠাট্টা–মশকরার বিষয়টি তাঁরা অনেকেই স্বাভাবিক বলেই মেনে নেন। তাঁদের দিক থেকেও কড়া ভাষায় জুতসই প্রতিবাদ আসে না। আর এই সুযোগে আরও বেশি করে নারীকে নিয়ে চলে নোংরা কথার উৎসব। পুরুষ প্রধান জমায়েতে এই চলে, শুনতে পাই মাইকে মাইকে।নারীর সামাজিক অবস্থান এমনিতেই নড়বড়ে। সব মিলিয়ে এক ভীষণ দুঃসময় পার করছি আমরা। সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হয়ে এবং প্রতিমুহূর্তে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে নানা আশঙ্কায় দিন পার করার সীমাহীন যন্ত্রণা একমাত্র নারীরাই জানেন। কৌতুকে মজা থাকবে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মজার বিষয়বস্তু যখন নারীর সৌন্দর্য কিংবা সহজাত আচার-আচরণকে বিদ্রূপাত্মকভাবে উপস্থাপন করে, তখন তাকে নিছক মজা বলে মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই।

নারীকে হেয় প্রতিপন্নভাবে উপস্থাপন করার পেছনে কাজ করে আমাদের পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক দর্শন ও তার চর্চা। নারীর সম্মানজনক সামাজিক অবস্থান নিশ্চিত করতে তাই অবিলম্বে নারীর প্রতি অবমাননাকর সব বক্তব্য, মন্তব্য, ঠাট্টা-তামাশা, কৌতুক বন্ধ করতে হবে। কারণ, এসব চর্চার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম নারীর প্রতি অসম্মান আর অবজ্ঞা নিয়ে বড় হয়েছি। নারীর প্রতি নির্যাতন আর সহিংসতার করুণ চিত্র চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের সে কথাই জানান দেয়। তাই আসুন, নারীর প্রতি নোংরা কথার উৎসবের মধ্যে বেড়ে ওঠা থেকে অন্তত শিশুদের মুক্তি দিই।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক

purba_du@yahoo.com