কোভিড-১৯ মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার উদ্দেশ্যে সরকার কাল সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য সারা দেশে যে লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে, তা আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত। সংক্রমণের বিস্তার রোধের লক্ষ্যে গত ২৯ মার্চ ১৮ দফা নির্দেশনাসংবলিত প্রজ্ঞাপন জারির মুহূর্তে এমন কোনো আভাস-ইঙ্গিত ছিল না যে এক সপ্তাহ না পেরোতেই দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। ইতিমধ্যে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়ে চলেছে বটে, কিন্তু এই নতুন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য লকডাউনের মতো চূড়ান্ত পদক্ষেপই অনিবার্য হয়ে উঠবে—এমন পূর্বাভাস বিশেষজ্ঞ মহল থেকেও পাওয়া যায়নি। আসলে লকডাউন অনিবার্য হয়ে উঠেছে কি না এবং তা ফলপ্রসূ হওয়া বাস্তবে সম্ভব কি না, এই প্রশ্ন উঠেছে।
শনিবার সরকার লকডাউনের ঘোষণা দেওয়ার ঠিক আগের দিন শুক্রবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তর ঢাকাসহ দেশের ৫৫টি স্থানে এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠান করল। ১ লাখ ১৬ হাজারের বেশি পরীক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকদের যে মাত্রায় গাদাগাদি ভিড়ের চিত্র সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হতে দেখা গেল, তাতে মনে হয় দেশজুড়ে চলমান করোনাভাইরাসের উচ্চ মাত্রার সংক্রমণ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। অথচ বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে মত দিয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞদের সেই পরামর্শ অগ্রাহ্য করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দায়িত্বহীনতা ও অবিমৃশ্যকারিতার পরিচয় দিল, আর তার ঠিক পরদিনই সরকারের লকডাউন ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হলো যে কোভিড-১৯ মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, সমন্বয় ও সময়োপযোগিতার বিরাট ঘাটতি রয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বস্তুত কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি, কোন সময়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে এবং হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এভাবে চললে মহামারির নতুন আঘাত সামলানো অত্যন্ত দুরূহ হয়ে উঠবে।
তবে আপাতত এক সপ্তাহের জন্য লকডাউনের ঘোষণা যখন দেওয়া হয়েই গেছে, তখন সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করতে হবে, তা যেন যথাসম্ভব ফলপ্রসূ হয়। লকডাউনের ন্যূনতম অর্জনও যদি এমন হয় যে এর মাধ্যমে জনসমাগম হ্রাস পাবে এবং সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি ও বজায় রাখার ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটবে, তাহলে এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে বৃথা যাবে না। তবে বাংলাদেশের মতো অতিমাত্রায় জনঘনত্বের দেশে লকডাউন কার্যকর করা যে বাস্তবে সম্ভব নয়, তা আমরা গত বছর লক্ষ করেছি। তা ছাড়া বিপুলসংখ্যক দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের এই দেশে লকডাউনের অর্থনৈতিক অভিঘাত গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেওয়ার বিষয়। যে বিপুল জনগোষ্ঠী দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল, লকডাউনের সময় তাঁদের জীবনধারণের উপায় সম্পর্কে সরকার কী ভেবেছে বা আদৌ কিছু ভেবেছে কি না, সে সম্পর্কে এখনো কিছু জানা যায়নি। কিন্তু বিষয়টি কোনোভাবেই উপেক্ষণীয় নয়।
কিন্তু সংক্রমণের হার ও রোগীর সংখ্যা যখন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, তখন মনোযোগ বাড়াতে হবে কোভিড রোগীদের জীবন রক্ষার প্রতি। কোভিড রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ বাড়াতে হবে; পর্যাপ্ত অক্সিজেন, আইসিইউ সেবাসহ চিকিৎসার মান উন্নত করার জন্য বাড়তি উদ্যোগ নিতে হবে, প্রয়োজনে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং সেই অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষ, দায়িত্বশীল ও সুশৃঙ্খল করার উদ্যোগ নিতে হবে; দায়িত্বশীলদের জবাবদিহির ব্যবস্থাও অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।
সংক্রমণের আরও বৃদ্ধি ঠেকানোর জন্য মাস্ক পরা, নিয়মিত হাত ধোয়া, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার প্রতি সবাইকে আরও মনোযোগী ও দায়িত্বশীল করে তোলার জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ বাড়াতে হবে।