বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে যতটা ‘স্পেস’ নিয়েছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে সেটি বিরল এক ঘটনা। নির্বাচনের পরে ১২ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমস-এ যে প্রতিবেদন ছাপা হয়, সেই প্রতিবেদনের একটি জায়গায় বলা হয়েছে, ‘বিজয়ীই সব ক্ষমতার অধিকারী হবে—এটাই হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এ জন্য বিজয়ী হতে নির্বাচনের আগে সম্ভাব্য সব ধরনের বাজি ধরেন দুই নেত্রী। এবার নির্বাচন বয়কট এবং রাজপথে সহিংস বিক্ষোভের মাধ্যমে লক্ষ্যপূরণের বাজি ধরেছিলেন খালেদা জিয়া। আর শেখ হাসিনা বাজি ধরেছিলেন প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখে নির্বাচন করার। ধরে নিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দা এতটা কঠোর হবে না, যাতে তাকে পিছু হটে নতুন করে নির্বাচন করতে হয়। এখন মনে হচ্ছে, বাজিতে জিতে শেখ হাসিনা সব পাওনা কুড়িয়ে নিয়েছেন। অদূর ভবিষ্যতে নতুন নির্বাচনের বিষয়ে কেউ আর তেমন জোর দিয়ে কিছু বলছে না...’ (প্রথম আলো, ১৩ জানুয়ারি ২০১৪।)
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস-এর ওই প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘একদলীয় শাসনের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ’। নির্বাচনের পর যে সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা হয়েছে এবং সেই মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির কয়েকজন নেতৃবৃন্দকে অন্তর্ভুক্ত করায় যে অভূতপূর্ব অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে এ রকম মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেননা পশ্চিমা ধরনের গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার কোনো ভুলত্রুটি করলে আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে চাপ তৈরি করে সরকারকে সঠিক পথে পরিচালনার দায়িত্ব যেমন বিরোধী দলের, তেমনি রাষ্ট্র ও সমাজের ভারসাম্য রক্ষায়ও বিরোধী দলের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ওই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে নবগঠিত মন্ত্রিসভা ও সংসদের সামনে রয়েছে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। তাদের সামনে যেমন সুশাসন নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তেমনি রয়েছে গণতন্ত্রকে কার্যকর করার চ্যালেঞ্জ। তবে পশ্চিমা ধরনের গণতন্ত্রই সর্বরোগহর এবং সকল সমস্যার সমাধান করে দেবে এমন কথা নেই। ২০২৫ সালের মধ্যে যদি বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশ হতে হয়, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, কর্মসংস্থানসহ দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে ২০৫০ সালের মধ্যে যদি বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলোর নিকটবর্তী হতে চায়, তাহলে বাংলাদেশের দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।
যে ধরনের সরকার আমাদের সেই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারবে, তাদের সমর্থন জানাতে আমাদের আপত্তি কোথায়? বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও পশ্চিমা দেশগুলো উন্নয়নের যে মডেল দিয়েছে, তা অনেক দিন আগে মুখ থুবড়ে পড়েছে। এশিয়ান টাইগারদের উন্নয়নেও ওই মডেলগুলো কোনো কাজে আসেনি। মালয়েশিয়ার উন্নয়নের সময়ে সেখানে ছিল সেমি ডেমোক্রেসি, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়াতেও নির্ভেজাল গণতন্ত্র ছিল না। তাদের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছে উপকারী কর্তৃত্ববাদ। আর এশিয়াসহ সারা বিশ্বের বিস্ময় হচ্ছে চীন। চীন শাসন করছে একদলীয় সমাজতান্ত্রিক সরকার, আর ‘কমান্ড ইকোনমি’ (কিছু পুঁজিবাদী সংস্কারসহ) চালাচ্ছে চীনের অর্থনীতি। সেই চীনের অর্থনীতি, শিক্ষা ও প্রযুক্তির কাছে নাকাল হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো পশ্চিমা বিশ্ব।
কোন সরকারব্যবস্থা বা রাষ্ট্রব্যবস্থা ভালো, এককথায় বোধ হয় তার উত্তর দেওয়া যাবে না। দেশ-কালভেদে এ ব্যাপারে নানা রকম তারতম্য দেখা গেছে। গণতন্ত্র অনেক দেশে সফল হয়েছে, অনেক দেশে তা হয়নি। সমাজতন্ত্র অধিকাংশ দেশে ব্যর্থ হয়েছে, কোনো কোনো দেশে সফল হয়েছে। উপকারী কর্তৃত্ববাদ এশিয়ান টাইগারদের উন্নতির শিখরে নিয়ে গেছে। ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’-এর নানা উদ্যোগ আয়োজনের ফলে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কান্ট্রিগুলো শিক্ষা-দীক্ষায় যেমন উন্নত, সামাজিক উন্নয়নের সূচকে যেমন তারা শীর্ষে, তেমনি ওই সকল দেশে অপরাধের হারও খুব কম।
বাংলাদেশে যে ধরনের সরকারই হোক তাদেরকে যে বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে তা হচ্ছে—সুশাসন, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, সকল নাগরিকের কর্মসংস্থানসহ দেশের সার্বিক উন্নয়ন। সম্ভাবনাময় অর্থনীতি, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং ১৬ কোটি মানুষের ‘মার্কেট’ হওয়ার কারণে বিভিন্ন দেশের কাছে বাংলাদেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল দুটি ভিন্ন মেরুতে অবস্থান নিয়েছে। তাদের সমর্থন দিতে গিয়ে আন্তর্জাতিক মহলও অনেকটা দ্বিধাবিভক্ত মনে হচ্ছে। কয়েক মাস ধরে যে পরিমাণ সহিংসতা ও নাশকতা বাংলাদেশে হয়েছে, তাতে করে আমার বারবার মনে হচ্ছে, আমরা কি কোনো ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির ওপর বসে আছি?
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের প্রাচীন গণতান্ত্রিক দল। সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন। ওই গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেয়েছে। ২০১৩ সালে এসে সেই গণতন্ত্র এক ভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি হলো। বিএনপিসহ ১৮ দলের বর্জন এবং লাগাতার অবরোধের মধ্য দিয়ে ৫ জানুয়ারির নিরুত্তাপ ও একতরফা নির্বাচন হয়ে গেল। তারপর গঠিত হলো মন্ত্রিসভা। আওয়ামী লীগের মতো একটা গণসংশ্লিষ্ট গণতান্ত্রিক দলের জন্য তা কতটা ইতিবাচক হলো, সেটি এক বড় প্রশ্ন? ওদিকে মধ্যপন্থা বাদ দিয়ে বিএনপি ঝুঁকে পড়েছে চরমপন্থী জামায়াত ও হেফাজতের দিকে। বিএনপি পরিচালিত হচ্ছে দুটি কেন্দ্র থেকে—লন্ডন থেকে তারেক রহমান দ্বারা আর ঢাকা থেকে বেগম খালেদা জিয়া দ্বারা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার ভারত, চীন, রাশিয়াসহ অনেকগুলো দেশের সমর্থন পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য নির্বাচন নিয়ে তাদের ‘ক্ষোভ ও অসন্তোষ’ থাকা সত্ত্বেও নতুন সরকারকে ১৪ জানুয়ারি সমর্থন জানিয়েছে।
ওদিকে পশ্চিমা দেশগুলো বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রতি তাদের শক্তিশালী সমর্থন জানিয়েছে এবং তারা মনে করে, এদের মধ্য দিয়েই তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে। ১৮ দলের অবরোধ তুলে নেওয়ায় আপাতত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও প্রধান দুটি দলের পাল্টাপাল্টি অবস্থান ও আন্তর্জাতিক মহলের দ্বিধাবিভক্তির কারণে যেকোনো সময় পরিস্থিতি আবারও সহিংস হয়ে উঠতে পারে। তবু আমরা শান্তিই কামনা করি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশের উন্নয়নের ভিত্তিতে বড় দুই দলসহ সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সংলাপই পারে ওই শান্তি নিশ্চিত করতে। আর ওই সংলাপের মাধ্যমেই আমরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সব শক্তিকে ‘না’ বলে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য ৫০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা করতে চাই।
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
hrkarzon@yahoo.com