কেমন হবে আগামী দিনের পাকিস্তান?

কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে পাকিস্তানে দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে গেল। প্রথমটি পাকিস্তানের ৬৬ বছরের ইতিহাসে একটি নির্বাচিত সরকার তার পাঁচ বছর মেয়াদ পূরণ করল। আর দ্বিতীয় ঘটনাটি পাকিস্তানের জনগণ কট্টর মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদীদের সন্ত্রাসী তৎপরতা উপেক্ষা করে ১১ মে জাতীয় ও চারটি প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ভোট দিল। এই নির্বাচনে মোট প্রায় নয় কোটি ভোটারের ৬০ শতাংশ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। সাধারণত পাকিস্তানের পাঞ্জাব ছাড়া অন্যান্য প্রদেশে নারীরা ভোটকেন্দ্রে আসতে তেমন আগ্রহান্বিত হন না। এবার ৪৫ শতাংশ নারী ভোটার ভোটকেন্দ্রে এসেছেন। নির্বাচনে শতাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। দেশটির বৃহত্তম শহর করাচি ও আরও কিছু এলাকার ভোটকেন্দ্র ভোট গ্রহণে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনেছে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ। করাচির নির্বাচন কয়েকটি দল শেষ মুহূর্তে বর্জন করেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, নির্বাচনের পদ্ধতিগত ত্রুটি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলতে পারে, তবে পাকিস্তানে যে একটা নির্বাচন হতে পেরেছে, গণতন্ত্রের জন্য সেটাই বড় প্রাপ্তি। পাকিস্তানের ৬৬ বছরের ইতিহাসে সে দেশের সামরিক-বেসামরিক আমলাদের ষড়যন্ত্রের কারণে গণতন্ত্র বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। এই ষড়যন্ত্রের কাছেই গণতন্ত্র সব সময় বলি হয়েছে এবং এর ফলে পাকিস্তান সারা বিশ্বে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাকিস্তানে গণতন্ত্রকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন সেই পঞ্চাশের দশকে একজন বাঙালি, মৌলভি তমিজুদ্দিন খান। করাচির একটি প্রধান সড়ক এখনো তাঁর নামে নামাঙ্কিত আছে ।

পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদেরও প্রেসিডেন্ট  (স্পিকার) ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর গণপরিষদের বাঙালি সদস্য মৌলভি তমিজুদ্দিন খানকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হয়। ফরিদপুরের সন্তান তমিজুদ্দিন খান কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষে কলকাতায় আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদেরও একজন সদস্য ছিলেন। দেশ ভাগ হলে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন।

 জিন্নাহর মৃত্যুর পর পাকিস্তান গণপরিষদ নতুন দেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নে হাত দেয়। যেহেতু পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের জনগণের মাঝে ধর্ম ছাড়া আর কোনো মিল ছিল না, সেহেতু সংবিধান প্রণয়নটা ছিল বেশ কঠিন। তার ওপর ছিল পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আর আমলাতন্ত্রে পাঞ্জাবের আধিপত্য আর সেহেতু পাঞ্জাব থেকে নির্বাচিত সদস্যরা চাইছিলেন এমন একটা সংবিধান প্রণয়ন করতে, যাতে তাঁদের আধিপত্য খর্ব না হয়। শেষ পর্যন্ত সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সংবিধানের একটা খসড়া প্রস্তুত হলো, যাতে পাঞ্জাবের আধিপত্য কিছুটা হলেও খর্ব হয়। কথা ছিল, ১৯৫৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর (জিন্নাহর জন্মদিন) থেকে দেশের প্রথম সংবিধান বলবৎ হবে। বিধি বাম। পাঞ্জাবি বংশোদ্ভূত গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ তা মানবেন কেন? তিনি পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আইয়ুব খানকে ডেকে পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করার হুকুম দিলেন। এতে আইয়ুব খান রাজি না হওয়ায় গোলাম মোহাম্মদ অক্টোবর মাসের ২৪ তারিখ পাকিস্তানের গণপরিষদ ভেঙে দেন। এর বিরুদ্ধে মৌলভি তমিজুদ্দিন খান সিন্ধু হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন দাখিল করলে হাইকোর্ট তাঁর পক্ষে রায় দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ফেডারেল সরকার সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে এবং ইংল্যান্ড থেকে অনেক জাঁদরেল আইনজীবীকে মামলা লড়ার জন্য হাজির করে। প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ মুনিরের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের রায় বাতিল করে দেন। বিচারপতি কর্নেলিয়াস এই রায়ের একমাত্র ভিন্নমতাবলম্বী বিচারপতি ছিলেন। বিচারপতি মুনির বলেছিলেন, জনগণের প্রয়োজনে অন্যায়কেও ন্যায় হিসেবে গণ্য করা যায়। তিনি সেই রায়ে ডকট্রিন অব নেসেসিটি (প্রয়োজনের বাধ্যবাধকতা) ব্যবহার করেছিলেন। পরবর্তীকালে যখন প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান বেনজির ভুট্টো ও নওয়াজ শরিফকে অপসারণ করেন, পাকিস্তানের উচ্চ আদালত তা জায়েজ করার জন্য বিচারপতি মুনিরের এই রায়কে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করেছেন। পাকিস্তানের গণতন্ত্র হত্যায় সে দেশের বিচারপতিরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বিচারপতি মুনির পরিবর্তীকালে তাঁর এসব নাজায়েজ কাজে আফসোস করে তাঁর গ্রন্থ Highways and Byways of Life-এ লিখেছেন ‘ওই মামলাটি (তমিজুদ্দিন খান) ছিল পাকিস্তানের দুর্ভাগ্যের শুরু।’ পাকিস্তানের সুধী সমাজ এখনো মৌলভি তমিজুদ্দিন খানকে সম্মানের চোখে দেখেন।

সদ্য সমাপ্ত পাকিস্তানের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান ও তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের উত্থান। যদিও রাজনীতিতে ইমরান খানের আবির্ভাব গত নির্বাচনের সময়, সেই নির্বাচনে তিনি বা তাঁর দল তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি। এবার মনে করা হয়েছিল পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হবে। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে তা প্রত্যাশিতভাবে হয়নি। মোট ২৬৭টি আসনের মধ্যে তাঁর দল সর্বসাকল্যে পেয়েছে ৩২টি আসন। কিন্তু খাইবার পাকতুনখাওয়া (উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ) প্রদেশে তিনি একটি কোয়ালিশন সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সরকার গঠন করতে হলে সঙ্গে জামায়াত-ই ইসলামিকে নিতে হতে পারে। কারণ, এখানকার অন্য বড় দল জামিয়াতে ওলামায়ে ইসলাম ইমরান খানের সঙ্গে না-ও যেতে পারে। জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে জামায়াত মাত্র চারটি আসনে জয়ী হলেও এই প্রদেশে তারা সাতটি আসন পেয়েছে। প্রদেশটি তালেবানদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত।

এবার নিয়ে নওয়াজ শরিফ তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হবেন। আগের দুবার তিনি তাঁর মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। একবার প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান এক বেসামরিক অভ্যুত্থানে তাঁকে অপসারণ করেন আর দ্বিতীয়বার জেনারেল পারভেজ মোশাররফ সামরিক অভ্যুত্থানে তাঁকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেন। পারভেজ  মোশাররফ নিজে এবার স্বেচ্ছানির্বাসন থেকে দেশে ফিরেছিলেন নির্বাচন করবেন বলে। মনোনয়নপত্রও জমা দিয়েছিলেন। সেসব তো বাতিল হয়েছেই, তার ওপর তিনি এখন পুলিশি হেফাজতে আছেন। আর যে দলটি নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ক্ষমতায় পাঁচ বছর টিকে ছিল, সেই পিপলস পার্টিকে এই নির্বাচনে মাত্র ৩১টি আসনে বিজয়ী হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে, যদিও সিন্ধু প্রদেশে তারা সরকার গঠন করতে যাচ্ছে।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে ভুট্টো পরিবারের একটা দাপট ছিল। আপাতত সেই দাপট শেষ হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বেনজির ভুট্টোর স্বামী, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সেই অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অস্বীকার করায় উচ্চ আদালতের রায়ে প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে পদ থেকে সরে যেতে হয়েছে। জারদারি ক্ষমতায় না থাকলে তখন তাঁর কী হবে, তা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে।

ইতিমধ্যে পিপিপি আর তেহরিক-ই-ইনসাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা নওয়াজ শরিফের সরকারে যোগ দিচ্ছে না। এতে নওয়াজ শরিফের তেমন সমস্যা হবে না। কারণ, স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ৩১ জন। তাঁদের অনেকেই সরকারে যোগ দিতে এক পায়ে খাড়া। পিপিপি আর তেহরিক মিলে নওয়াজের সামনের বিরোধী দলটি বেশ শক্তিশালী হবে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। তবে নওয়াজ নানামুখী চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন। প্রথম সমস্যা তালেবানি ও জাতিগত সন্ত্রাস। এমন কোনো দিন নেই যেদিন কোথাও না কোথাও বোমা বিস্ফোরণে নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছে না। তার ওপর আছে আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তে নিয়মিত যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলা এবং তাতে নিরীহ মানুষের প্রাণহানি। এই সমস্যা সহজে দূর হওয়ার নয়। দেশে জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সংকট প্রকট। করাচি-লাহোরের মতো শহরে দিনে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হয়। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের নিচে আর মুদ্রাস্ফীতি ১১ শতাংশের ওপর। কোনো কোনো মাসে তা ২৫ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে অনেক আগেই। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। দুর্নীতি পাকিস্তানে একটি শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে।

 তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা রেখে চলা। গত পাঁচ বছর সেনাবাহিনী বেশ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। আগামী দিনে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক কতটা ইতিবাচক হয়, তা-ও দেখার বিষয়। সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো। সবকিছু মিলিয়ে নওয়াজ শরিফ সরকারকে বেশ কিছু সময় একটা নাজুক সময় পার করতে হবে। তবে তাঁর সরকার যদি চ্যালেঞ্জগুলো সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারে, তাহলে সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন বাড়বে। কারণ, পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ দীর্ঘ ৬৬ বছরের দুঃশাসন আর অপশাসনে অতিষ্ঠ। উপমহাদেশের সবগুলো দেশে যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে, তাহলে সম্মিলিতভাবে এই দেশগুলো পরাশক্তি হয়ে উঠতে পারে। এখন দেখার অপেক্ষা, কেমন হবে আগামী দিনের পাকিস্তান।

এটি ঠিক, পাকিস্তান বাংলাদেশের জন্য কোনো উদাহরণ হতে পারে না। পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ সব আর্থসামাজিক সূচকে এগিয়ে। বর্তমানে বাংলাদেশে যে কিছুটা রাজনৈতিক সংকট চলছে, তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। দেশের মানুষ আশা করে, রাজনৈতিক নেতারা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই সংকট সমাধান করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

আবদুলমান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রামবিশ্ববিদ্যালয়।