বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা

কী মিলবে বালি সম্মেলন থেকে?

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যভুক্ত দেশগুলোর বাণিজ্যমন্ত্রীরা আজ ইন্দোনেশিয়ার বালিতে যাচ্ছেন ৩ থেকে ৬ ডিসেম্বরের বৈঠকে যোগ দিতে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা রাউন্ড আলোচনা ২০০১ সালে শুরু হওয়ার পর এটি হবে মন্ত্রী পর্যায়ের নবম বৈঠক। দোহা রাউন্ডের অধীনে সদস্যদেশগুলোর যেসব চুক্তিতে উপনীত হওয়ার কথা ছিল, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে (১) কৃষি, (২) অকৃষিজাত পণ্যের বাজারসুবিধা, (৩) সেবা খাত, (৪) বাণিজ্যসংক্রান্ত মেধাস্বত্ব ও (৫) অন্যান্য। দোহা রাউন্ড আলোচনা ২০০৫ সালে সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও গত ১২ বছরে এ ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যরা দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া মূল চুক্তিগুলোয় কোনো মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেননি। মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক ছাড়াও সারা বছর জেনেভায় বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ধারিত কমিটিগুলো যে আলোচনা করে আসছে, তাতে সদস্যদেশগুলোর অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। সেখানে নিয়ে যাওয়ার মতো কিছু নেই।
প্রথমেই দেখা যাক, কৃষি চুক্তিটির কী অবস্থা। এ ক্ষেত্রে খাদ্যনিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ খাদ্যসাহায্য ব্যবহার, কৃষিপণ্যের ওপর শুল্ক হারের কোটা, রপ্তানি প্রতিযোগিতার জন্য ভর্তুকি কমানো ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য খাদ্যনিরাপত্তা খুবই জরুরি। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যের প্রাপ্যতা ও দাম বিবেচনা করে খাদ্য আমদানিকারক স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর রপ্তানি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে। অন্যদিকে, তুলা উৎপাদনকারী পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর জন্য কৃষিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তুলার বাজারসুবিধা পাওয়া। অভ্যন্তরীণ সহায়তা ও রপ্তানি প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বাণিজ্যের অনুপযোগী নীতিমালা দূর করার জন্য তারা আহ্বান জানিয়ে এলেও, উন্নত দেশগুলো এ ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তুলা উৎপাদনকারীদের ভর্তুকি দেওয়া অব্যাহত রেখেছে।
স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য অকৃষিজাত পণ্যের ক্ষেত্রে উন্নত ও অগ্রগামী উন্নয়নশীল দেশগুলোয় শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা পাওয়ার দাবিটি এখনো অপূর্ণ রয়ে গেছে। ২০০৫ সালে হংকংয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার পঞ্চম মন্ত্রী পর্যায়ের সভায় উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় সব উন্নত দেশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে তাদের প্রায় সব পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুযোগ দিলেও যুক্তরাষ্ট্র শুধু ৯৭ শতাংশ শুল্করেখার অন্তর্ভুক্ত পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে। অথচ স্বল্পোন্নত দেশের প্রধান প্রধান পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে উচ্চ শুল্ক দিয়ে প্রবেশ করছে। যেমন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করছে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে। আসন্ন বালি সম্মেলনে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর দাবি হচ্ছে, বাকি ৩ শতাংশ শুল্করেখার পণ্যের ক্ষেত্রেও তাদের শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা দেওয়া হোক। শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা পাওয়ার পরও স্বল্পোন্নত দেশগুলো তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারে না অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, পণ্যের কতটুকু অংশ নিজ দেশে উৎপাদিত হচ্ছে (রুলস অব অরিজিন), সে ব্যাপারে কঠিন নিয়ম থাকার কারণে। উন্নত দেশে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে উৎপাদিত পণ্যটি স্বল্পোন্নত দেশের ভেতরে কতখানি মূল্য সংযোজন করেছে, এ ব্যাপারে বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ করে আসছে স্বল্পোন্নত দেশগুলো। তাদের সরবরাহজনিত ও উৎপাদনের সক্ষমতা মাথায় রেখে সহজ একটি পন্থা অবলম্বনের অনুরোধ করছে এই দেশগুলো।
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র সেবা খাতে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। ‘বিশেষ এবং ভিন্ন আচরণের’ (স্পেশাল অ্যান্ড ডিফারেনসিয়াল ট্রিটমেন্ট) আওতায় স্বল্পোন্নত দেশগুলো থেকে সেবা ও সেবা প্রদানকারীদের উন্নত দেশগুলোয় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাজারসুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। স্বল্পোন্নত দেশে সেবা খাতের ভূমিকা ক্রমেই বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও সেবা খাতের অংশ বাড়ছে। সেদিক থেকে এ ঘোষণার তাৎপর্য অনেক। তবে এ প্রস্তাব বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রথমত, এ ঘোষণা কোনো আইনগত অঙ্গীকার নয়। তাই উন্নত দেশগুলোর সদিচ্ছার ওপরও সেবা খাতে বাজারসুবিধা পাওয়াটা নির্ভর করবে। দ্বিতীয়ত, সেবা খাতের বাজারসুবিধা পুরোপুরি ব্যবহার করার জন্য স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নিজেদের সেবা খাতের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা। তৃতীয়ত, বিভিন্ন ধরনের অশুল্ক বাধা দূর করা প্রয়োজন। যেমন উন্নত দেশে কাজের অনুমতি পাওয়ার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক প্রয়োজনে পরীক্ষা (ইকোনমিক নিডস টেস্ট) দিতে হয়। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর দাবি হচ্ছে, তাদের সেবা খাতের জন্য উন্নত ও সক্ষম উন্নয়নশীল দেশগুলো দ্রুত ও অর্থপূর্ণ বাজারসুবিধা
দেবে। স্বল্পোন্নত দেশের জন্য আগ্রহের জায়গাটি হচ্ছে তাদের দেশ থেকে উন্নত দেশে শ্রমশক্তির চলাচল, যেহেতু তাদের দেশে বর্ধিত জনসংখ্যা রয়েছে। কিন্তু সেবা খাতে কিছুটা অগ্রগতি সত্ত্বেও অনেক অমীমাংসিত বিষয় এখনো সামনে রয়েছে।
বালি সম্মেলনের জন্য আরেকটি বিষয় হলো বাণিজ্য সহজীকরণ চুক্তি। এর বাস্তবায়ন করা হলে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়বে, সন্দেহ নেই। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশের পক্ষে এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন, যাতে তারা বাণিজ্যের জন্য উপযোগী অবকাঠামো তৈরি করতে পারে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাণিজ্যবিষয়ক মেধাস্বত্ব চুক্তি (ট্রিপস)। স্বল্পোন্নত দেশের জন্য এটি বাস্তবায়নের সময়সীমা বেশ কয়েকবার বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি এটি বাড়িয়ে ২০২১ সালের ১ জুলাই পর্যন্ত করা
হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে অনেক দেশ তাদের জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য এর সুবিধা নিতে পারে। কেননা, যেসব দরিদ্র দেশের ওষুধ প্রস্তুত করার ক্ষমতা নেই, তারা সস্তায় অন্য দেশ থেকে ওষুধ কিনতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদশে ওষুধ তৈরির যে সক্ষমতা রয়েছে, তার আরও বিকাশ ঘটিয়ে দরিদ্র দেশগুলোয় আমরা ওষুধ রপ্তানি করতে পারি।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আসন্ন বালি সম্মেলন বিগত সম্মেলনগুলো থেকে ভিন্ন কিছু উপহার দেবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নবম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনটি এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। দোহা রাউন্ড তাই এবারও আলোর মুখ দেখতে পাবে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা তথা বহুপক্ষীয় বাণিজ্যব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়েও অনেকে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। সামনের দিনগুলোয় হয়তো বা এই আলোচনাই মুখ্য
হয়ে উঠবে।
ড. ফাহমিদা খাতুন: গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।