গণপরিবহন

কারও ভাবনাতেই নেই!

বনানীতে চলন্ত সিঁড়ির ওভারপাস নিয়ে সাধারণ এক মানুষের মন্তব্যে সেদিন সত্যিই চমকে উঠেছিলাম। ‘অটোমেটিক সিঁড়ির ওভারপাস চালু করে কী লাভ? ঢাকায় তো চড়ার মতো বাসই নেই।’ মন্তব্যটি শুনে আমার চমকে ওঠার কারণ, সাধারণ মানুষও আজ কত সহজেই এই শহরটির মূল সমস্যাটি ধরতে পারছে। অথচ আমাদের নীতিনির্ধারকেরা যেন এ ব্যাপারে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন এক নিরন্তর ঘুমে। কোনো আওয়াজ, কোনো চিৎকারই তাঁদের ঘুম ভাঙাতে পারছে না।
ঢাকা বোধ হয় পৃথিবীর একমাত্র মেট্রোপলিটন শহর, যেখানে ভদ্রোচিত কোনো গণপরিবহন নেই। আমরা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ উপলক্ষে রাজধানীর সৌন্দর্যবর্ধনের নামে আলোকসজ্জা করি, শত শত কোটি টাকা খরচ করি অথচ ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণে আমাদের নিদারুণ অনীহা। আমাদের এখানে বাস চলে কিন্তু তাতে উঠতে পারেন না শহরের বেশির ভাগ মানুষ। পরিবার-পরিজন নিয়ে সেগুলোতে ওঠার কথা তো ভাবতে পারেন না অনেকেই। নিরুপায় অনেকেই ওঠেন, কিন্তু তাঁদের দুর্ভোগ চোখে দেখা যায় না। আমাদের এখানে অটোরিকশা চলে, কিন্তু সেটাও কোনো নিয়মকানুনের মধ্যে থেকে নয়। ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের ওপর চলে জুলুম। বছরান্তে যখন এই শহরটি পৃথিবীর নিকৃষ্টতম বসবাস-উপযোগী শহরের খেতাব লাভ করে, তখন আসলে তা আমাদের খুব একটা অবাক করে না। একটা জনবহুল শহরে শহরবাসীর মৌলিক স্বাচ্ছন্দ্যের যে ব্যাপারটি, সেটাই যখন এই ঢাকায় অনুপস্থিত, তখন এমন তালিকায় ঢাকার নাম থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
মহাজোট সরকারের প্রথম মেয়াদে রাজধানীর যানজট নিরসনে বেশ কিছু ভালো কাজ হয়েছে—এ কথা তাদের ধন্যবাদ দিয়েই স্বীকার করতে হয়। সেই সঙ্গে এটাও বলতে হয়, তাদের প্রথম মেয়াদে গণপরিবহনের সমস্যাটি অবহেলিতই থেকেছে। বরং তাদের এই মেয়াদে কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হাতে গণপরিবহন ব্যবস্থা পুরোপুরি জিম্মি হয়ে গেছে। এটা সরকারের ব্যর্থতা নাকি আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই আলোচনায় না গিয়েও বলা যায়, সরকার এই সমস্যাটির ব্যাপারে একেবারে মনোযোগী ছিল না।
তবে মহাজোট সরকারের প্রথম মেয়াদে বিআরটিসির জন্য যে পরিমাণ নতুন বাস আমদানি করা হয়েছে, সেটা অতীতে আর কখনো হয়েছে কি না, সেটা নিয়ে ভাববার বিস্তর অবকাশ আছে। কিন্তু ওই যে গোষ্ঠীস্বার্থ! সেই গোষ্ঠীস্বার্থের কারণেই বিআরটিসির এই বাসগুলো রাজধানীর গণপরিবহন সমস্যা সমাধানে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। চীন থেকে নিম্নমানের বাস আমদানি করা (যার বেশির ভাগই এই মুহূর্তে লক্কড়ঝক্কড়ে পরিণত), সঠিক রুট বিন্যাস না হওয়া, বেসরকারি পরিবহন মালিকদের অনৈতিক চাপ—সরকারের সদিচ্ছাকে সঠিক পথ দেয়নি। এই মুহূর্তে যদি একটা হিসাব নেওয়া যায় যে গত মেয়াদে আমদানি হওয়া বাসগুলোর কয়টি এখন ঢাকার রাস্তায় চলছে, তাহলে নিশ্চিত বিআরটিসির বাসের ব্যাপারে একটা হতাশার চিত্রই নগরবাসীর চোখের সামনে দেওয়া যাবে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলের আধুনিক ভলভো বাসগুলোর আলাপ এখানে না-ই বা করলাম!
গণপরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে সরকারের অবহেলার সবচেয়ে বড় নমুনা হচ্ছে মেট্রোরেল নিয়ে অযথা সময়ক্ষেপণ। রাজধানী ঢাকার যানজট সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে আসা, ঢাকার গণপরিবহন সমস্যার সমাধান, যা-ই বলি না কেন, এই এক মেট্রোরেলের মাধ্যমেই করা সম্ভব ছিল। জাপানি সাহায্য সংস্থা জাইকার সিংহভাগ আর্থিক অনুদানে এখনো পরিকল্পনার মধ্যে থাকা মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শুরু করে দেওয়া মহাজোট সরকারের প্রথম মেয়াদকালেই সম্ভব ছিল। কিন্তু সেটা হয়নি। সরকার ঢাকায় যে ফ্লাইওভারগুলো তৈরি করেছে, সেগুলোর একটিও তৈরি না করে যদি মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শুরু করতে পারত, সেটাই হতো ঢাকাবাসীর সবচেয়ে বড় স্বস্তির কারণ।
মেট্রোরেলের পাশাপাশি ঢাকার গণপরিবহন সমস্যা সমাধানের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি। ঢাকার জন্য যে বিশেষ কৌশলগত পরিবহন ব্যবস্থার (স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান বা এসটিপি) পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, তাতে কয়েকটি মেট্রোরেল লাইনের (এমআরটি) পাশাপাশি আছে দুটি বিআরটি লাইন। যার একটি জয়দেবপুর থেকে শাহজালাল বিমানবন্দর ও অপরটি বিমানবন্দর থেকে সদরঘাট পর্যন্ত হওয়ার কথা। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এই প্রকল্প দুটিও বহু বছর হতে যাচ্ছে হিমাগারেই। মাঝেমধ্যে মন্ত্রী মহোদয়রা প্রকল্পসংক্রান্ত উপস্থাপনায় মিডিয়ার সামনে আওয়াজ-টাওয়াজ দিয়ে হুলুস্থুল করলেও কাজের কাজটা এখনো করতে পারেননি। এই প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়িত হলে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসত, সেটা নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু এগুলোর নির্মাণকাজ সরকার কেন শুরু করতে পারছে না, তার কোনো সদুত্তর সত্যিই কারও কাছে নেই।
মহাজোট সরকার নতুন করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তিন মাসের বেশি হতে চলল। এটা অনস্বীকার্য যে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পগুলোকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসার পুরো কৃতিত্ব সরকারের। কিন্তু নির্মাণকাজটা যেন নতুন মেয়াদে সরকার দ্রুত শুরু করতে পারে, এটাই এখন ঢাকাবাসীর প্রাণের দাবি। মেট্রোরেল ও বিআরটির পাশাপাশি ঢাকার মধ্য দিয়ে বিদ্যমান রেললাইনটিকে (যা উত্তরে জয়দেবপুর ও দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত) কেন্দ্র করে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন স্টেশন স্থাপন করে কমিউটার রেল ব্যবস্থার প্রবর্তন করা যায়, তাহলে ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থার দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব।
নীতিনির্ধারকেরা, ব্যাপারগুলো একটু যত্ন নিয়ে ভেবে দেখবেন কি!

নাইর ইকবাল: সাংবাদিক।
nayirdhaka@gmail.com