মতামত

কাতার অবরোধ প্রত্যাহার, বিন সালমানের পরাজয়

সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমান
সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমান

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ট্রাম্পের চমক থামছে না। কাতারের ওপর সৌদি বলয় তিন বছরের যে অবরোধ দিয়েছিল তার অবসান হয়েছে। অবরোধ অবসানে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তাঁর জামাতা ও হালের মধ্যপ্রাচ্যের অলিখিত ভাগ্যবিধাতা জ্যারেড কুশনার। শুরুর দিকে ট্রাম্প অবরোধকে সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছিলেন এবং টুইট করেছিলেন। কিন্তু সেই ট্রাম্পই আবার অবরোধ অবসানের নায়ক।

মৌসুমি বাতাসের ন্যায় মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির গতিপথ পরিবর্তন হয়। বোঝা দায়। আর মৌসুমি বাতাসের এই পরিবর্তনে ফুলে ফেঁপে স্বাস্থ্যবান হয়ে ওঠে পশ্চিমের কোষাগার। তবে এই অবরোধ প্রত্যাহারে নিশ্চিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সৌদি বলয়ের, বিশেষ করে বিন সালমানের গ্রহণযোগ্যতা। ইতিহাসের পাতায় এই অবরোধ প্রত্যাহারকে বিন সালমানের প্রথম রাজনৈতিক পরাজয় হিসেবে লেখা হবে।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে প্রথাগতভাবে কাতার প্রথম শ্রেণির মার্কিন মিত্র। ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে আমলে না নিলেও সৌদি বলয়ের কাতার অবরোধের সময়কাল ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

২০১৭ সালের জুন মাসের ৭ তারিখ। গ্রীষ্মের সকালে কাতারিদের ঘুম ভেঙেছিল সৌদি-আমিরাত বলয়ের অবরোধের সংবাদ শুনে। অবরোধ অবসানে মোট শর্তের সংখ্যা ছিল ১৩টি। প্রধান শর্তগুলোর মধ্যে ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রধান গণমাধ্যম আল–জাজিরার দরজা সিলগালা করা, ইরানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ছিন্ন করা, ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ মুসলিম ব্রাদারহুডকে অর্থসাহায্য এবং রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেওয়া। তবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক শর্ত ছিল দোহায় তুরস্কের সেনাঘাঁটি বন্ধ করার শর্ত। এই শর্তের মধ্যে সৌদি বলয়ের আচমকা হামলা করে কাতার দখলের হুমকি ছিল। আপাতদৃষ্টিতে কাতার কোনো শর্ত মানেনি। বরং আগের পথেই হেঁটেছে, সৌদি বলয়ের বিরোধীদের একত্র করেছে এবং তুরস্ক, তিউনিসিয়া, মালয়েশিয়া এবং স্বল্প পরিসরে পাকিস্তানকে কাছে টেনে নিজস্ব বলয়ের শক্তি বৃদ্ধি করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে প্রথাগতভাবে কাতার প্রথম শ্রেণির মার্কিন মিত্র। ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে আমলে না নিলেও সৌদি বলয়ের কাতার অবরোধের সময়কাল ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এই অবরোধ ঘটেছিল ট্রাম্প ক্ষমতা পাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই। দ্বিতীয়ত, ২০১৭ সালের জুনের ৫ তারিখে যখন সৌদি বলয় কাতার অবরোধের ঘোষণা দেয়, তার ছয় মাস পরই ডিসেম্বরের ৬ তারিখ ট্রাম্প মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে হস্তান্তরের ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার মাধ্যমে মার্কিনরা মূলত জেরুজালেমকে ইসরায়েলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। দ্বি-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা, আরব লিগ অনুমোদিত ২০০২ সালের আরব পিস ইনিশিয়েটিভসহ ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা সম্পর্কিত সব চুক্তিকে মাড়িয়ে ট্রাম্প এককভাবে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।

অনেকে মনে করেন, মার্কিনরা সৌদি বলয়কে ব্যবহার করে কাতার অবরোধের সঙ্গে সিরিয়া এবং লিবিয়ার গৃহযুদ্ধকে ব্যবহার করে গণমানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে রেখে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। অথচ এই জেরুজালেমের জন্য আরবরা প্রায় ছয় দশক ধরে যুদ্ধ জারি রেখেছিল। গত এক শ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির এমন প্যাঁচালো খেলা চলছে। পটকা ফোটে এক জায়গায় ধোঁয়া ওড়ে অন্য জায়গায়।

তবে এই অবরোধ পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যসহ ‘মুসলিম বিশ্ব’ সৌদি বলয়ের জন্য এক হবে না। সৌদি-আমিরাত বলয়ের গ্রহণযোগ্যতা এবং শক্তিমত্তা প্রশ্নের মুখে পড়বে। বিশেষ করে যাঁরা ইয়েমেন, লিবিয়া, সিরিয়া, সুদান ও ইরিত্রিয়ায় সৌদি-আমিরাত বলয়ের আর্থিক সাহায্য নিয়ে যুদ্ধরত এবং যাঁরা বিন সালমানকে ঘিরে নিজেদের ভবিষ্যৎ রচনা করেছেন, তাঁদের উদ্বেগের পরিধি প্রশস্ত হবে। এই অবরোধ প্রত্যাহার মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বেশ কয়েকটি পরিবর্তন আনতে পারে।

ট্রাম্প চলে গেলেও ট্রাম্প পরিবার বিশেষ করে কুশনার আগামীর মার্কিন রাজনীতির একটি বিশাল অংশ বর্তমানের মতোই প্রভাবিত করবেন। তাই নিন্দুকেরা বলে থাকেন কুশনারের ইচ্ছাতেই বিন সালমান হুট করেই সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকার হয়েছেন, ইয়েমেন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, ফিলিস্তিনের দাবি ছেড়ে দিয়েছেন

প্রথমত, ব্যর্থ অবরোধের দরুন ব্যক্তিগতভাবে বিন সালমান এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সৌদি আরবের ইমেজ সংকট বাড়বে। অবরোধের একটি শর্তও কাতারকে মেনে নিতে বাধ্য করাতে পারেননি বিন সালমান এবং আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স শেখ জায়েদ। অর্থপূর্ণ রাজনীতির ময়দানে বিন সালমান এবং শেখ জায়েদ ক্রমাগত হেরে যাচ্ছেন। ম্রিয়মাণ হয়েছে আরব বিশ্বের একক কণ্ঠস্বর হওয়ার স্বপ্ন। অটোমান–পরবর্তী সময় থেকেই ‘মুসলিম বিশ্বের’ সর্বত্র সৌদি প্রভাব ছিল। কিন্তু পশ্চিমা মদদে সৌদির ক্রমাগত যুদ্ধযাত্রা, ফিলিস্তিন প্রশ্নে নীরবতা, সাম্প্রতিক সময়ের বিন সালমানের খাসোগি হত্যাকাণ্ড এবং আধুনিকতার নামে পশ্চিমা জীবনযাত্রাকে সৌদিতে টেনে আনার দরুন ‘মুসলিম বিশ্বে’ সৌদির প্রভাব আক্ষরিক অর্থে ক্ষুণ্ন হয়েছে। শূন্যস্থান কিঞ্চিৎ পূরণ করে চলেছে কাতার-তুরস্ক বলয়।

দ্বিতীয়ত, দোহার অবস্থান পরিষ্কার হয়েছে। দিনে দিনে সালমান যতটাই ফ্যাকাশে হয়েছেন, কাতারের আমির শেখ তামিম ততটাই নির্ভীক হয়ে চলেছেন। দোহা দুর্দান্তভাবে সৌদি বলয়ের অবরোধ মোকাবিলা করেছে। ইরান, আল-জাজিরা, ব্রাদারহুড প্রশ্নে নিজেরদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। সুন্নি হওয়া সত্ত্বেও দোহা তেহরানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক মজবুত। যার দরুন এই সৌদি বলয়ের প্রদত্ত ১৩ শর্তের অগ্রভাগে ছিল ইরান ত্যাগের বিষয়টি। ত্যাগ হয়নি বরং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। দোহার এই অটল ভূমিকায় ভর করে ব্রাদারহুডও সংগঠিত হচ্ছে। ইরানকে দিয়ে সৌদি আরবকে বিব্রত রেখে দোহা যদি উত্তর আফ্রিকায় বিশেষ করে মিসরে ব্রাদারহুডকে সংগঠিত করতে পারে, তাহলে পশ্চিমের পছন্দের স্বৈরশাসক সিসির আরাম বিঘ্নিত হতে পারে। সিসির আরাম ভঙ্গ হওয়ার অর্থই যুদ্ধবাজ এমানুয়েল মাখোঁর অশান্তি বৃদ্ধি পাওয়া।

কাতার অবরোধের পুরো তত্ত্ব ট্রাম্প এবং তাঁর জামাতা কুশনারকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। ট্রাম্পের আমলে শুরু হওয়া অবরোধ ট্রাম্পের আমলেই নিষ্ফলভাবে শেষ হয়েছে। ইতিহাসবিদেরা আজ পর্যন্ত সাদ্দামের কুয়েত দখলের কোনো যুক্তিসংগত কারণ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। ঠিক একইভাবে হয়তো ভবিষ্যতে বিন সালমানের নেতৃত্বে কাতার অবরোধের কারণ খুঁজতে গিয়ে তাঁরা ব্যর্থ হবেন। শুধুই আর্থিকভাবে নয়, রাজনৈতিকভাবেও এই অবরোধ থেকে লাভবান হয়েছে ট্রাম্প পরিবার। আর্থিকভাবে, দলে দলে উপসাগরীয় দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ট্রাম্পের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে আর রাজনৈতিকভাবে কুশনারকে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন ভাগ্যবিধাতা বানিয়েছে।

ট্রাম্প চলে গেলেও ট্রাম্প পরিবার বিশেষ করে কুশনার আগামীর মার্কিন রাজনীতির একটি বিশাল অংশ বর্তমানের মতোই প্রভাবিত করবেন। তাই নিন্দুকেরা বলে থাকেন কুশনারের ইচ্ছাতেই বিন সালমান হুট করেই সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকার হয়েছেন, ইয়েমেন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, ফিলিস্তিনের দাবি ছেড়ে দিয়েছেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোকে ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপনে চাপ প্রয়োগ এবং কাতার অবরোধ করেছেন। আবার সুবিধামতো প্রত্যাহার করিয়েছেন। কুশনার-বিন সালমান জুটি বারবার তাঁদের কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে শরিফ হোসাইন-থমাস লরেন্স জুটির কথা মনে করিয়ে দেয়। শরিফ হোসাইন-থমাস লরেন্স অটোমানদের বিরুদ্ধে আরবদের খেপিয়ে বিদ্রোহ করিয়েছিলেন। যার দরুন অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হয়েছিল অশেষ যুদ্ধ। কুশনার-বিন সালমান মধ্যপ্রাচ্যসহ ‘মুসলিম বিশ্বকে’ কোথায় নিয়ে থামাবেন, তা সময়ই বলে দেবে।

রাহুল আনজুম মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক।