বহুল আলোচিত কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনাটি বছর গড়িয়ে যুগে এসে ঠেকেছে৷ দেড় যুগ পরও রাষ্ট্র এ অপহরণ ঘটনার প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে৷ এ মামলা নিয়ে ১৮ বছর ধরে কেবল তদন্ত-পুনঃ তদন্ত খেলা চলছে৷ ঘটনার ১৪ বছর পর মামলাটির প্রথম চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছিল৷ ১৪ বছর পর জনগণ জানল, কল্পনা অপহরণ মামলার আসামিরা অজ্ঞাতনামা! পরবর্তী সময়ে মামলাটি সিআইডির হাত ঘুরে বর্তমানে রাঙামাটির পুলিশ সুপারের ওপর অধিকতর তন্তের জন্য ন্যস্ত রয়েছে৷
সিআইডি মামলাটি দুই বছর ধরে তদন্ত করে আবারও আসামি অজ্ঞাত রেখে আদালতে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে৷ মামলার বাদী কল্পনার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা সিআইডির এ প্রতিবেদনের ওপর নারাজি দেন৷ এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৩ সালের ১৬ জানুয়ারি রাঙামাটির মুখ্য বিচারিক আদালত এ মামলার আরও অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দিয়ে রাঙামাটির পুলিশ সুপারকে এ দায়িত্ব দেন৷
তদন্ত-পুনঃ তদন্ত করতে করতে ১৮টি বছর পেরিয়ে গেল৷ অধিকতর তদন্ত দেড় বছর ধরে চলছে৷ ইতিমধ্যে এ অধিকতর তদন্তের সময় ১০ দফা বাড়ানো হয়েছে৷ কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা এখনো কোনো প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেননি৷
কল্পনা বাঘাইছড়ির প্রত্যন্ত গ্রামের এক শ্রমঘনিষ্ঠ পরিবারে জন্মেছিলেন৷ তবে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা কখনো তাঁর ক্ষুরধার মেধা ও সংগ্রামী চেতনাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি৷ যেখানে অন্যায়-অবিচার, সেখানেই কল্পনার প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিল অনিবার্য৷ উর্দি পরা লোকের চোখরাঙানি কিংবা বন্দুকের নলের মুখেও তিনি কখনো মাথা নত করেননি৷ অপহরণের আগ পর্যন্ত তাঁর প্রতিবাদী চেহারা বাঘাইছড়িসহ পাহাড়ের মানুষ দেখেছে৷
কল্পনা আজ বাঘাইছড়ি তথা সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন৷ কল্পনাকে অপহরণ করে শাসকগোষ্ঠী তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠকে রোধ করতে চেয়েছিল৷ কিন্তু আজ পাহাড়ে হাজারো কল্পনার প্রতিবাদী কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে৷ বাঘাইছড়ি-সাজেক থেকে ঘিলাছড়ি, রুমা-থানচি থেকে ফেনী-তাইন্দং সর্বত্রই আজ প্রতিবাদী নারীদের আওয়াজ তীব্রতর হচ্ছে৷ তাই কল্পনার চেতনা পাহাড়ে কখনো বিস্মৃত হবে না৷ যত দিন কল্পনার প্রিয় মাতৃভূমি নিউ লাল্যাঘোনার অস্তিত্ব থাকবে, হাজলং নদী বহমান থাকবে, তত দিন কল্পনার চেতনা পাহাড়ে জাগ্রত থাকবে৷
মেয়ে হারানোর বেদনা নিয়ে কল্পনার মা বাঁধুনি চাকমা পরলোকগমন করেছেন৷ বাঁধুনি চাকমা বেঁচে থাকাকালে দেখা গেছে, রাতারাতি গজিয়ে ওঠা তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠন এবং বিশেষ গোষ্ঠী নিজ উদ্যোগে হেলিকপ্টারে লিফলেট বিতরণ, পুরস্কার ঘোষণা, বিভিন্ন স্থানে কল্পনার অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে বলে যখন নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ করছিল, তখন তিনি ঢাকায় এসে জাতীয় প্রেসক্লাবে চোখের জল ফেলতে ফেলতে সংবাদ সম্মেলন করে বিভ্রান্তি না ছড়িয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁর অপহৃত মেয়েকে ফেরত দেওয়ার আহ্বান জানান৷ কল্পনার মা যত দিন বেঁচে ছিলেন, সরকার তাঁকে মিথ্যা আশ্বাস আর বিভ্রান্তিকর তথ্য ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি৷ একমাত্র মেয়ের অপহরণকারীদের বিচার ও শাস্তি—কোনোটিই তিনি দেখে যেতে পারেননি৷
কিন্তু অনেক হতাশার মধ্যেও আশার বিষয় হলো, কল্পনা অপহরণের ১৮ বছর পেরিয়ে গেলেও এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবিতে এখনো আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারণা অব্যাহত রয়েছে৷ ২০১৩ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনাটি নিয়ে ক্যাম্পেইন করলে বিশ্বব্যাপী আবারও ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়৷ ইতিমধ্যে কল্পনা চাকমার পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাঁচ সহস্রাধিক চিঠি ও কার্ড এসেছে৷ দেশের ভেতরে কল্পনা অপহরণ ঘটনা নিয়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও সরকারের মধ্যে কোনো অপরাধবোধ কাজ না করলেও বহির্বিশ্বে কল্পনার অপহরণ ঘটনাটি যে এখনো দাগ কেটে রয়েছে, সেটি নতুন করে আবার প্রমাণিত হলো৷ ভিনদেশি বন্ধুদের এ আন্তরিকতা ও সহমর্মিতার সাড়া দেখে কল্পনার পরিবারের সদস্যদের প্রিয়জন হারানোর বেদনা নিশ্চয় কিছুটা হলেও লাঘব হবে৷
শ্রমঘনিষ্ঠ পরিবারের অংশ হিসেবে দারিদ্র্য নিত্যদিনের সঙ্গী হলেও কল্পনার ভাইয়েরা এখনো একমাত্র বোনের অপহরণের সুষ্ঠু বিচারের দাবি নিয়ে এখানে-ওখানে ছুটে বেড়াচ্ছেন৷ এ নিয়ে তাঁদের বিভিন্ন ধরনের হয়রানির মুখোমুখিও হতে হচ্ছে৷ কিছুদিন আগে আদালতের নির্দেশে কল্পনার ভাইদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের জন্য বাঘাইছড়ি থানা থেকে পুলিশ পাঠানো হয়েছিল৷
আমরা ইয়াসমিন-সীমা হত্যাকাণ্ডের বিচার দেখেছি৷ কিন্তু কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার বিচারের জন্য আমাদের আর কত যুগ অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে? তাই আমাদের একটাই দাবি, আর কালক্ষেপণ না করে অবিলম্বে কল্পনা অপহরণ রহস্য উদ্ঘাটন করা হোক এবং তাঁর অপহরণের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত চিহ্নিত অপরাধীদের অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে বিচার করা হোক৷
ইলিরা দেওয়ান: কল্পনা চাকমার সহযোদ্ধা৷
ilira.dewan@gmail.com